ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

যেভাবে লেখা হলো তিস্তা উপন্যাস

হারুন পাশা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:২৫, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
যেভাবে লেখা হলো তিস্তা উপন্যাস

‘তিস্তা’ উপন্যাস লেখার গল্প লিখতে বসে অনেক কথাই মনে ভাসছে। বলছি কিছু। জন্মের পর থেকে যে তিস্তার সাথে আমার পরিচয়, সেই তিস্তা আমার বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বড় না হয়ে ছোট হতে থাকল। হয়ে গেল নালার মতো।

বর্ষার দুমাস বাদে বছরের অন্য সময়গুলোয় নদীতে থাকে বালু। যে নদীর গর্জন শুনে ভয় পেতাম, সেই নদীর বুকে হাঁটা যায়। একপাশ থেকে আরেক পাশে যাওয়া সম্ভব। স্কুলের টিফিনে কিংবা স্কুল ছুটি হলে বন্ধুরা মিলে নদী দেখতে যেতাম। দেখেছি ভরা তিস্তায় কেমন করে কচুরিপানা পাঁক খায়। মাছ ধরছে মাঝি। ধানের জমিতে পলি জমা হচ্ছে। বাড়ছে ফলন। নদীতে মাছ আছে, ঘরে ধান আছে, মানে ভাত আছে। ফলে সংসারে হাসি-খুশিও আছে। চরের মানুষেরা ভুট্টা, আখ, মরিচ, তরমুজ, বাদাম আবাদ করছে।

শৈশব-কৈশরের সমৃদ্ধ স্মৃতি নিয়ে বড়বেলায় নদীতে যাই, দেখার চেষ্টা করি নদীকে আশ্রয় করে বেঁচে থাকা মানুষের জীবন। দেখি আর যন্ত্রণায় আচ্ছন্ন হই। মিলাতে পারি না শৈশবের তিস্তার সঙ্গে যৌবনে দেখা তিস্তা। এ তিস্তার বুকে রস নেই। কষ্ট তীব্র হয় নিজের ভেতর। দেখতে পাই নদীতে পানি নেই বলে তিস্তাকে আশ্রয় করে বেঁচে থাকা মানুষ ঠিক মতো আবাদ করতে পারছে না, মাছ ধরতে পারছে না। দেখি তাদের ক্ষয়, হতাশা, না খেয়ে থাকা, পেশা বদলের মিছিল। তিস্তার পাড় দিয়ে হাঁটি, ব্যথা বড় হতে থাকে। তাদের ভাগ্যবদল তো আমি করতে পারবো না, কারণ সেই ক্ষমতা আমার নেই। তাদের বর্তমান জীবন নিয়ে লেখার চেষ্টায় নিজেকে যুক্ত করতে থাকি।

ঢাকা থেকে রাতে গ্রামে ফিরলে পরেরদিন সকালেই চলে যেতাম তিস্তায়। আলাপ করতাম নদীর মানুষদের সঙ্গে। দেখতাম এবং জানতাম তাদের সুখ-দুঃখের গল্প। তারা গলগল করে বলে যেত নিজেদের যন্ত্রণার কথা। অনুধাবন করতে পেতাম তাদের কথাগুলো শত ক্ষতে আক্রান্ত। ক্ষত সংক্রামিত হয় আমার মনেও। পর্যবেক্ষণ শেষে লিখতে বসি ‘তিস্তা’। লিখি তাদের পরিবর্তিত জীবনের আখ্যান। নদী সম্পর্কে ধারণা বদলে গেল। নদী মানে পানিতে কানায় কানায় ভরা থাকবে, মাঝিরা মাছ ধরবে। না, তিস্তায় এসব নেই। পদ্মা, তিতাস, গঙ্গায় পানি থাকলেও ‘তিস্তা’য় পানি নেই। পানিহীন মানুষের আর্তনাদ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়। নদী ও মানুষের সমৃদ্ধ অতীত হয় দরিদ্র। দারিদ্র্যের আখ্যানে পূর্ণ হয় জীবন। তিস্তাবাসী দেশের নানাপ্রান্তে, বিশেষত শহরে রিকশা চালাতে যায়, ব্লকের কাজ করতে যায়, ঘর-বাড়ি মেরামত এবং ধান কাটার কাজ করে, বেছে নেয় হকারির জীবন।

পানি না থাকায় মানুষ, প্রকৃতি, পশু-পাখি আক্রান্ত হয় নানা ধরনের অসুখ-বিসুখে। তিস্তা ব্যারেজ হয়েছিল মানুষের কল্যাণ সাধনের লক্ষ্যে। কিন্তু পানিহীন ব্যারেজ হয় অশুভের অংশ। তিস্তা ব্যারেজ ও তিস্তা ক্যানেলে থাকে পানির বদলে বালুর আয়োজন। মিছিল-মিটিং, মানববন্ধনে কাজ না হলে তিস্তাবাসী স্ব উদ্যোগে পানির জন্য আন্দোলনে নামে। উন্নয়নের এ যুগে যেখানে সবকিছু সহজলভ্য, সেখানে মানুষ পানির জন্য আন্দোলন করে। ঘটনা কতটাই না বেদনার। তবুও তারা পানি পায় না, অপেক্ষা করে তিস্তা চুক্তির। চুক্তি তো একদিকে হচ্ছেই না, অন্যদিকে চুক্তি হলেও তারা কি নিশ্চিতভাবে পানি পাবে, এ নিয়েও সংশয় কাটে না।

তিস্তা নদী, তিস্তা ব্যারেজ ও সংশ্লিষ্ট মানুষের দুর্বিষহ জীবন আমাকে ভেতর থেকে তাগাদা দেয় তাদের নিয়ে লিখতে। দীর্ঘ স্মৃতি এবং বাস্তবতা আমাকে কঠিন ভাবে আঘাত করতে থাকে বাক্য লিখতে। লিখতে থাকি একের পর এক বাক্য। দুঃখক্রান্ত হই, কিন্তু ক্লান্তি আসে না চিন্তা এবং লেখায়। লিখি তিস্তাবাসীর ব্যবহৃত ভাষায়। ব্যবহার করি রংপুর ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের মানুষের মুখের ভাষা। প্রশ্ন আসতে পারে রংপুরের প্রেক্ষাপটে লেখা উপন্যাসে ময়মনসিংহ অঞ্চলের ভাষা কেন? হ্যাঁ, এর কারণও আছে। চরে যারা বসবাস করে তাদের অধিকাংশই ময়মনসিংহের ভাষায় কথা বলে। ফলে চরিত্রের মুখে সে ভাষাই ব্যবহার করেছি।

আমি পুরো উপন্যাস লেখার পরিকল্পনা মাথায় নিয়ে ঘুরেছি দিনের পর দিন। লিখতে পারিনি সময়ের অভাব এবং পারিপার্শ্বিক অনেক কারণে। উপন্যাসটি যখন লেখা শেষ করি, তখন চারপাশে ঈদের আমেজ। সে সময় সকাল ৭টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত টানা লিখেছি ‘তিস্তা’ উপন্যাস। তারপর দুপুর তিনটা থেকে রেস্টে ছিলাম। এনার্জি যোগ করে পরেরদিন সকাল থেকে আবার পূর্ণ শক্তি নিয়ে লিখতে বসি। ঈদের দিন কোথাও বেরোই না। কেউ কেউ ফোন করে বলে তিস্তা ব্রিজে যেতে। আমি যাই না, বলি শরীরটা ভালো নয়। আজ থাক, কালকে যাব। পরেরদিন এলে বলি পরেরদিন যাব। অসুস্থতা থাকলেও মাথায় কেবল লেখার চিন্তা। লিখলাম ঈদের দিন রাত অবধি। এর মধ্যে দেখতে পাই অনেকেই ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। কিন্তু কারোরি মেসেজের রিপ্লে দেওয়া হয়নি। তারা হয়তো আমাকে আনসোস্যাল ভেবেছেন। কিন্তু আমি যে এ সময় যাপন করছি তারা তো তা জানে না।

‘তিস্তা’ উপন্যাসে নিরীক্ষা করেছি, লেখক হিসেবে উপন্যাসে আমার কোনো উপস্থিতি নেই। এখানে চরিত্ররাই যাপিত জীবনের ব্যাখ্যাকারক। তারাই বলেছে তাদের কথা এবং তাদের কথনেই উপন্যাসটি এগিয়ে গেছে শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত।

উপন্যাসটি লিখতে গিয়ে মায়ের কাছে বেশি কৃতজ্ঞ। মা রান্না শেষ হলেই খেতে ডেকেছেন, খেয়েছি। শহরে থাকলে খাওয়ার কষ্টটাই বেশি হয়। বাড়িতে মা এ কষ্ট ফিল করতে দেননি। আর যারা আমার উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি পড়ে বিভিন্নভাবে পরামর্শ ও সহযোগিতা করেছেন, তাদের প্রতিই বা কৃতজ্ঞতা না প্রকাশ করি কেমন করে। ধন্যবাদ ময়েন, শারমিন, সমীর ভাই, মাওলা ভাই, হামীম ভাই। পাঠকদের জন্য শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা।

অমর একুশে বইমেলায় (২০১৮) অনিন্দ্য প্রকাশনী থেকে বের হয়েছে তিস্তা। প্রচ্ছদ করেছেন ধ্রুব এষ।

আরো পড়ুন :

* যেভাবে লেখা হলো ‘ধানমন্ডি ৩২ নম্বর’

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়