ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

নদী ভাঙনে নিঃস্ব মানুষের পাশে দাঁড়ান

জাফর সোহেল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৩৮, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
নদী ভাঙনে নিঃস্ব মানুষের পাশে দাঁড়ান

জাফর সোহেল: শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার নাম নড়িয়া হলো কেন? কপালের লিখনই কি গায়ে এঁটে দিয়েছিল এর নামকরণকারি? কৌতূহল জাগে মনে। ৭ বছর ধরে নড়তে থাকা নড়িয়াকে মানুষ দেখছে গত দু’সপ্তাহ ধরে; যখন সে একেবাড়েই নড়বড়ে; যখন তার বিনাশ অনেকটাই অবধারিত। গত দুই সপ্তাহের খবরাখবরে যা উঠে আসছে তাতে মূলত নড়িয়া আছে মৃত্যুশয্যায়। সবাই এখন দোয়া দুরুদ পড়ছে, চিকিৎসার জোড়ালো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। কারণ, ধরেই নেয়া হয়েছে চিকিৎসায় আর লাভ নেই, যা হবার উপরওয়ালার ইচ্ছেতেই হবে। সম্মুখপানে ছুটে চলাতেই নদীর সুখ। গানে আছে ‘নদীর কূল নাই-কিনার নাই, নাইরে দরিয়ার পাড়ি।’ অর্থাৎ তার কোনো সুনির্দিষ্ট কিনার নেই, সে যেখানে ইচ্ছা, যতদূরে ইচ্ছা কিনার বানাবে, যেখানে খুশি সেখানে গিয়ে সে থামবে।

কিন্তু একটি প্রশ্ন মনে খুব জোরেশোরে ওঠে- মুমূর্ষু অবস্থায় পৌঁছানোর আগে নড়িয়ার চিকিৎসা কি যথাযথ হয়েছে? গত ৭ বছর ধরে যে ভাঙন চলছে, একবছর আগ পর্যন্ত হিসাবে যার ১১ কিলোমিটার জমি আর বাড়ি খেয়েছে নদী, তার ভাঙন রোগ সারাতে কে কী ব্যবস্থা নিয়েছে? নদী নিয়ে গবেষণাকারীরা বলছেন, তারা সঠিক সময়ে সঠিক পূর্বাভাস সরকারকে জানিয়েছেন। তাহলে সরকার কী করেছে নড়িয়ার মাটি-সম্পদ আর অস্তিত্ব রক্ষায়? উত্তরগুলো মানুষের কাছে মোটামুটি পরিষ্কার- কাজের কাজ কিছুই হয়নি। ফলে কী হয়েছে? নড়িয়া নামের একটি জনবহুল-ঘটনাবহুল-সহস্র মানুষের কোলাহলমুখর জনপদ অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। সেখানকার মানুষের টুকরো টুকরো সব সুখ-দুঃখের স্পর্শে ভরা মাটি গিলে খাচ্ছে সর্বগ্রাসী পদ্মা। মানুষ আহাজারি করছে তার প্রিয় ঘরের জন্য, এক টুকরো উঠোনের জন্য, একটি সজনে ডাটার গাছের জন্য। হিন্দু রমণীরা প্রিয় তুলসি গাছটার জন্য কতদিন শোক করবে- কে জানে। কবরে শুয়ে থাকা প্রিয়জনের জন্যও মানুষের কষ্টের সীমা নেই- ‘আহারে মায়ের কবরটাও বুঝি আর দেখমু না জীবনে।’ বলছে নড়িয়াপাড়ের মানুষ।

টেলিভিশনে দেখছিলাম, এক মা তার সন্তানের কাছে টেলিফোনে বলছে, নদী কী করে কেড়ে নিয়েছে তার সর্বস্ব, এখন তারা কোথায় থাকবে, কী করবে, কী খাবে- ইত্যকার নানা বিষয়ের উদ্বেগ ঝরে পড়ছে তার বিলাপে। এক কিশোরীকে দেখলাম ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে পদ্মার দিকে। কী ভাবছে মনে মনে সে- ‘ভালোবাসার এই প্রতিদান দিলি তুই নদী’! সত্যিই নদীতীরের মানুষ তো নদীকে ভালোবাসে। নদী তাদের জবীন-জীবিকারও একটা উপায়। নদীর সঙ্গে তাদের কত লেনা-দেনা, কত সুখ-দুঃখের গল্প। হঠাৎ কেন ক্ষেপে গেল নদী? এ প্রশ্নের উত্তর নদীতীরের মানুষের হয়ত কমই জানা। কিন্তু যাদের জানা আছে তারা কি নদীর সঙ্গে মানুষের এই চির বিচ্ছেদের দুঃখের খবর রাখে?            

বাংলাদেশ এখন অনেক এগিয়ে গেছে। বিশ্ব তাকে বলছে, তুমি একটা রোল মডেল। হোক আর না হোক, কখনো কখনো সম্মান পেয়ে গেলে তা মেনে নিতে হয়। রক্ষাও করতে হয়। আমরা সম্মান পেয়ে, স্বীকৃতি পেয়ে যতটা উচ্ছ্বসিত, উদ্ভাসিত- বিনয়ের সঙ্গে জানতে ইচ্ছে করে, সম্মান রক্ষায় ততটা তৎপরতা কি আছে আমাদের? আমরা একদিকে মহাকাশে বিচরণ করছি, অন্যদিকে আমাদের মানুষ উদ্বাস্তু হচ্ছে। তাদের বাস্তভিটা রক্ষায় কোনো উদ্যোগ নেই। এই শীতেও নড়িয়া এলাকায় পদ্মা ছিল বাজার আর স্থাপনাগুলো থেকে অন্তত ২ কিলোমিটার দূরে। মাটিও ছিল শুকনো। মানুষের ঘরবাড়ি, জমিজমা, দেকানপাট সরকারি স্থাপনা সব যে হুমকির মুখে তা জানানেওয়ালারা জানিয়েছেও আগে থেকে। তারপরও দুই কিলোমিটার আগে পদ্মার লাগাম টেনে ধরার সুযোগ কেউ নিতে চায়নি। এই ব্যর্থতার জবাব কে দেবে? জবাব দানকারিরা তো আছেন নির্বাচনী ট্রেনে। যে সময়ে নড়িয়ায় পদ্মা গিলে খায় মানুষের বাড়ি-মসজিদ-স্কুল, অমরা দেখি ঠিক সেই সময়ে জনগণের প্রতিনিধিরা কেউ নির্বাচনী ট্রেনে চড়ে বসেছে আর কেউ দলীয় প্রধানের ‘মুক্তি’ জপ করছে। বিরোধী শক্তির মনে হচ্ছে ম্যাডাম মুক্তি পেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে, নড়িয়ার আগ্রাসী পদ্মাও থেমে যাবে। তাই দেশের কোথায় কী হচ্ছে, মানুষের কী সমস্যা, ছাত্রদের কী সমস্যা, চাকরিপ্রার্থীদের কী সমস্যা- কোনো কিছু দেখার প্রয়োজন তাদের নেই। আবার তারাই আশাবাদী- জনগণ ভোট দিয়ে তাদের ভাসিয়ে নয়ে যাবে! 

জবাবদিহিতার সংস্কৃতি এদেশে নেই, কবে হবে তারও ঠিক নেই। এবং তারই একটি কুফল হলো এই মুহূর্তে নড়িয়াবাসীর পোড়া কপাল। পদ্মা যেভাবে, যে রূপে আঘাত হেনে চলেছে তাতে বাস্তবতা হলো, কিছুদিনের মধ্যেই অর্ধেক নড়িয়া স্মৃতি হয়ে যাবে। আশ্চর্যের বিষয়, এতগুলো দিনে এতগুলো মানুষ ঘরহারা, সম্পদহারা হলো, নড়িয়ায় পা পড়েছে সরকারের একজন মাত্র মন্ত্রীর। বন্যা, ঘুর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস হলে অনেক মানুষ ও সম্পদের হানি হয়, তাই আমরা এসব ঘটনাকে দুর্যোগ বলি। নদী ভাঙনের ঘটনাকে আমরা দুর্যোগ বলি না কেন? এমনকি গণমাধ্যমেও বলা হয় না! নদী ভাঙনে কি বন্যা-জলোচ্ছ্বাসের চেয়ে কম ক্ষতি মানুষের? যে চিত্র এবার দেখা গেছে নড়িয়ায়, তা তো অন্যসব দুর্যোগের চেয়ে বরং বেশি মাত্রায় পোড়াচ্ছে মানুষকে। কোটি কোটি টাকার অর্থমূল্যের সম্পত্তি, বহুতল ভবন, হাসপাতাল, স্কুল-মসজিদ নদীতে বিলীন হচ্ছে। যার একটিমাত্র বাড়ি ছিল, তার বাড়িটা যেমন গেল, গেল বাড়ি ঘিরে থাকা সব সুখও। এখন উদ্বাস্তু জীবনের গ্লানি হঠাৎ কী করে বয়ে বেড়াবে?

নদী কেবল মানুষের ঘর ভাঙে না, ভাঙে মন, ভাঙে হৃদয়। প্রতিটি পরিবারের প্রতিটি মানুষের আছে ভিন্ন ভিন্ন গল্প। সব গল্পই মাঝপথে হারিয়ে যাচ্ছে নদীতে। সুতরাং নদী ভাঙনের শিকার মানুষদের দুর্যোগ কবলিত হিসেবে ধরে নেয়া এবং স্বীকৃতি দেয়া সরকারের জন্য দায়িত্ব হয়ে পড়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিটি মানুষকে ঘর দেয়া, খাদ্য দেয়া, কর্ম দেয়া সরকারের জন্য কর্তব্য। কারণ, এই দুর্যোগ প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়। ইচ্ছে করলে এ দুর্যোগ ঠেকানো যেত। এখন সরকারকেই ব্যবস্থা নিতে হবে। শুধু নড়িয়ায় নয়, বাংলাদেশের যত জায়গায় যত নদী ভেঙে নেয় মানুষের বাড়ি, ফসল, দোকানপাট- সবকিছুর জন্য ক্ষতিপূরণ বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। জনগণ, তাদের সম্পদ রক্ষা করা সরকারের দায়িত্ব। ভোট দিয়ে, ট্যাক্স দিয়ে জনগণ সে দায়িত্ব সরকারকে দিয়েছে। দেশের কোথায় কোন নদী ভাঙবে, কতটুকু ভাঙবে, কতদিন ভাঙবে- তাতে কী কী ক্ষতি হবে, কত মানুষ ঘর ও সম্পদ হারাবে তা সকারকেই হিসাব করে ব্যবস্থা নিতে হবে। আপাতত নড়িয়ার ঘরহারাদের থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থায় জরুরি পদক্ষেপ নেয়া হোক। যে মানুষগুলো সব হারিয়েছে, মন যাদের একেবারে মরে গেছে, তাদের কাছে সরকারের এতটুকু তৎপরতা একটু শান্তি ও স্বস্তির বিষয় হবে। দয়া করে নদী ভাঙন কবলিত এলাকায় গিয়ে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ান।

লেখক: সাংবাদিক

 

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়