ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

পর্যটনকেন্দ্র কুয়াকাটায় নজর দিন

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:১৯, ১০ জানুয়ারি ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পর্যটনকেন্দ্র কুয়াকাটায় নজর দিন

রফিকুল ইসলাম মন্টু : সাগরকন্যা কুয়াকাটা। নাম শুনলেই চোখে ভাসে বিশাল জলরাশি। ঢেউয়ের পর ঢেউ আছড়ে পড়ছে বেলাভূমিতে। দিনের শেষ প্রান্তে সূর্য দিগন্তে পৌঁছানোর আগেই বেলাভূমিতে পর্যটকের ভিড় বাড়তে থাকে। সন্ধ্যায় জেলেদের ঘরে ফেরার ডাক, দু’চাকায় ভর করে নৌকাগুলো রাত্রিযাপনের নিরাপদ গন্তব্যে রেখে আসে তারা। তখনই আবার সৈকতের ব্যবসায়ীরা পর্যটক টানতে প্রস্তুত হয়। সন্ধ্যা নামে, রাত হয়, আবার ভোর হয়। কুয়াকাটা সৈকত যেন ফুরসত পায় না। অন্যান্য বারের মতো এবার কুয়াকাটা সমুদ্র পাড়ে ঘাটলা সড়কের শেষ সীমানায় দাঁড়িয়ে এই দৃশ্যগুলোই চোখে পড়ে। সমুদ্র দেখি। ঢেউয়ের শব্দ শুনি। ঘাটলায় দাঁড়িয়ে বারবারই আমার মাথায় একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খায়- কুয়াকাটার কী কোনো অভিভাবক নেই? দেখার কেউ থাকলে সম্ভাবনাময় এই সৈকতের এ অবস্থা কেন? যে নান্দনিক বিকালের গল্প দিয়ে লেখাটা শুরু হলো তা নিমিষেই ম্লান হয়ে যায় এখানকার অব্যবস্থাপনা দেখে।

কুয়াকাটার ঘাটলা সড়কের শেষ মাথায় দাঁড়ালেই এখানকার দৈন্যদশা ভেসে ওঠে। সড়ক থেকে সৈকতে নামার পথে যত্রতত্র ইট পড়ে আছে। ইট-বালুতে একাকার হয়ে থাকায় পর্যটকদের ওঠানামায় বেশ অসুবিধা হচ্ছে। সেদিন মাত্র পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে থেকেই বেশ কয়েকজন নারী-পুরুষের ভোগান্তির দৃশ্য দেখলাম। ছোট্ট এক শিশুকে ধরে সড়কের উপরে তুলে একজন বললেন, ‘আমি না ধরলে তো বাবু পড়েই গিয়েছিল!’ সৈকতের দিকে তাকালে মন খারাপ হয়ে যায়। আহারে! এত চমৎকার সৈকতের এ কী হাল! পড়ে থাকা গাছের টুকরো, ইটের টুকরো, হেলে পড়া পাকা ভবনের দেয়াল সৈকতকে বেশ এলোমেলো করে রেখেছে। ভাঙনের কারণে কুয়াকাটা সৈকত তীরের গাছপালা ভেঙে পড়ছে সৈকতে। কিন্তু সেগুলোর যথাযথ ব্যবস্থাপনা কিংবা সৈকত রক্ষার দায়িত্বে কেউ আছে বলে মনে হয় না। সেদিন রাতের সৈকত দেখতে বের হয়েছিলাম। লম্বালম্বিভাবে সৈকতের মাঝ বরাবর যে নালা তৈরি হয়েছে- সেটা দিনের বেলায় তত স্পষ্ট দেখা না গেলেও রাতে স্পষ্ট দেখা যায়। ঘাটলার নিকটে এই নালার ওপরে দেওয়া হয়েছে সাঁকো। সাথে থাকা একজন মজা করে বললেন, ‘এটা আমাদের পদ্মা সেতু!’

সময়ের ধারাবাহিকতায় এককালের জঙ্গলাকীর্ণ পরিবেশ থেকে কুয়াকাটা পর্যটন কেন্দ্রে উন্নীত হয়েছে। সেই সুবাদে এখানে ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছে। পর্যটকের সংখ্যাও বাড়ছে দিন দিন। অলিগলি ঘুরলে অসংখ্য আবাসিক হোটেল চোখে পড়ে। অনেকে বাসার দু’টো কক্ষ ছেড়ে দিয়েছেন হোটেলের জন্য। আছে অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও। গত কয়েক বছরে সরকারি পর্যায়ে বেশকিছু উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এখানে চোখে পড়েছে। ইকো পার্ক হয়েছে, ঝাউ বাগান হয়েছে, পর্যটন করপোরেশনের মোটেল তো অনেক আগেই হয়েছে। রাখাইন বৌদ্ধমন্দির, কুয়াকাটার ‘কুয়া’ দর্শনে এসেছে ভিন্নতা। প্রাচীন নৌকা এখানে সংরক্ষিত হয়েছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের উদ্যোগে। কুয়াকাটার বিকাশের লক্ষ্য সামনে রেখে ব্রীজ ও রাস্তাঘাটের উন্নয়নের পাশাপাশি এখানে করা হয়েছে পৌরসভা। কিন্তু কী লাভ হলো? কুয়াকাটা কী স্বাভাবিক পরিবেশে ফিরে এসেছে? ব্যবসা বাণিজ্য প্রসার কিংবা সৌন্দর্য্য বিকাশে কী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে? নেওয়া হয়ে থাকলে তার কী ফল আমরা দেখতে পাচ্ছি? কুয়াকাটাকেন্দ্রিক উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে না। আবার ব্যবসায় মন্দার কারণে এখানকার অনেক উদ্যোক্তা ব্যবসা ছেড়ে চলেও গেছেন। সমুদ্রপাড়ে বেড়ানোর ইচ্ছা থেকে একবার হয়তো পর্যটক এখানে আসেন। কিন্তু দ্বিতীয়বার ক’জন আসতে চান? আমরা কী খতিয়ে দেখেছি?

 



পরিকল্পনা ছাড়াই যে কুয়াকাটা গড়ে উঠেছে, তা যে কেউ এখানে এসে অনুধাবন করতে পারবেন। বাঁধের ভেতরে-বাইরে যত্রতত্র আবাসিক হোটেল, দোকানপাট। রাস্তার ওপরে ভাসমান দোকানপাট তো আছেই। সৈকতের বাঁধে ওঠার প্রধান সড়ক প্রশস্ত করা হয়েছে ভালো কথা। কিন্তু বাসস্ট্যান্ড বাঁধের ওপরের চৌরাস্তায় রাখা হয়েছে কোন যুক্তিতে আমার মাথায় ঢোকে না। সৈকতে যাওয়ার সড়কে ওঠার পথটি অনেক উঁচু হওয়ায় এমনিতেই ঝুঁকি নিয়ে যানবাহন চলাচল করে। তার ওপর বাঁধের চৌরাস্তা থেকেই বাসগুলো ঘোরানো হয়। বাসস্ট্যান্ডের জন্য কোন জায়গাই কী নেই কুয়াকাটায়? এটি অন্যত্র সরিয়ে নিতে পারলে পর্যটকেরা এখান দিয়ে নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারবেন। বাসস্ট্যান্ড নয়, বরং কুয়াকাটার বাঁধের ওপরের এই চৌরাস্তাটিতে থাকা উচিত একটি দৃষ্টিনন্দন ফোয়ারা কিংবা কুয়াকাটার কোন প্রতীকের ভাস্কর্য। এতো গেল চৌরাস্তার কথা! আচ্ছা, পর্যটক যখন সৈকত ভ্রমণে আসেন তার জন্য মুদি দোকান কি খুব বেশি প্রয়োজন? সৈকতে প্রবেশ পথে ডানপাশে এতগুলো মুদি দোকানের কেন প্রয়োজন হলো- বুঝতে পারি না।

কুয়াকাটায় রয়েছে প্রায় আঠারো কিলোমিটার দীর্ঘ সৈকত। এই সৈকত প্রতিদিন হাজারো পর্যটকের ভিড়ে মুখরিত হলেও রক্ষণাবেক্ষণ নেই। সৈকত ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে। ভাঙছে তীর। ময়লা-আবর্জনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সৈকতজুড়ে। সৈকতে পড়ে থাকা উচ্ছিষ্ট মাছ আর শুঁটকি পল্লীর উৎকট গন্ধ এখন পর্যটকদের সবচেয়ে বিরক্তির কারণ। এ যেন অভিভাবকহীন এক পর্যটন। সম্ভাবনা বিকাশে নেই কোন ধরণের পদক্ষেপ। পড়ন্ত বেলায় পশ্চিম আকাশে তেজ কমে যাওয়া সূর্যটা সৈকতের প্রান্তজুড়ে ছড়িয়ে দেয় রক্তবর্ণ আভা। ভেজা বালুতে পর্যটকের পায়ের ছাপ আর ছড়িয়ে থাকা শামুক-ঝিনুক যেন এক ভিন্নমাত্রা যোগ করে। জীবিকার প্রয়োজনে সমুদ্রগামী জেলেরা তখন হয়তো ঘরে ফেরে; কিন্তু গোধূলির আবছা আলো পর্যটকদের তখন নিয়ে যায় ভিন্ন আবেশে। ঊষালগ্নে সৈকতে আরেক হই-হুল্লোড় ছড়িয়ে পড়ে। ভোরে সমুদ্র স্নান অনেকের কাছে যেন পূণ্যতা লাভের সামিল। সমুদ্রের পানিতে সব ধুয়ে মুছে মানুষগুলো ফিরে যায় আপন ঠিকানায়। এতটা উৎসবমুখর পরিবেশের মাঝেও শুধুমাত্র অব্যবস্থাপনার কারণে পর্যটকদের চাহিদা পুরোপুরি মেটাতে পারছে না কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত। সৈকতের বেলাভূমিতে পঁচা মাছের উৎকট গন্ধে পর্যটকেরা নির্বিঘ্নে ঘোরাফেরা করতে পারছেন না। আছে আরও অনেক সমস্যা। এতটুকু নির্মল বাতাসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে আসা মানুষগুলো যেন অস্বস্তির মধ্যে ডুবে যান এখানে এসে।

কুয়াকাটার ‘মহাপরিকল্পনা’র প্রসঙ্গটি আর বলার প্রয়োজন আছে কিনা বুঝতে পারছি না। এর কথা শুনে আসছি বহু বছর ধরে; কিন্তু বাস্তবায়নের নাম নেই। কুয়াকাটাকে আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র হিসাবে গড়ে তুলতে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে আছে দীর্ঘমেয়াদি মাস্টারপ্ল্যান বা মহাপরিকল্পনা অনুমোদন না হওয়া। কুয়াকাটা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এখনও গঠিত হয়নি। আর এ কারণেই পর্যটন কেন্দ্র ঘোষণার প্রায় কুড়ি বছর পেরিয়ে গেলেও কুয়াকাটা সেভাবে বিকশিত হতে পারেনি। পরিকল্পনা ছাড়াই গড়ে উঠছে আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন। হাটবাজার, দোকানপাট যত্রতত্র। পরিকল্পনাহীন এক নগর গড়ে উঠছে এখানে। আর এটাই বিকাশমান পর্যটনে এক সময় বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিতে পারে। পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটা ঘুরে চোখে পড়ে বহুমূখী অনিয়মের চিত্র। ভূমিগ্রাসীদের খাসজমি দখল থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আবাসন বাণিজ্য, সবই আছে এখানে। পর্যটনকেন্দ্রের আশপাশে ফসলি জমিতে সাইনবোর্ড লাগিয়ে চলছে রমরমা আবাসন বাণিজ্য। এর প্রভাবে শত শত একর ফসলি জমি নিঃশেষ হতে চলেছে। এখানে খাসজমি বণ্টনে রয়েছে অব্যবস্থাপনা। সৈকত রক্ষণাবেক্ষণের অভাব তো আছেই। অথচ যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণের মধ্য দিয়ে কুয়াকাটায় আরও আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা সম্ভব।

 



কুয়াকাটা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠনের আগে মহাপরিকল্পনা তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন মহাপরিকল্পনা তৈরির লক্ষ্যে ১০ সদস্যের কমিটি গঠন করেছিল। ২০১০ সালের ১৯ মে এই পরিকল্পনা তৈরির পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে শেলটেক কনসালট্যান্ট প্রাইভেট লিমিটেডকে নিয়োগ দেয়া হয়। পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার লতাচাপলী, গঙ্গামতি, কাউয়ার চর ও চরচাপালী এই চারটি মৌজা কুয়াকাটা পর্যটনের মহাপরিকল্পনার আওতায় আনা হয়। জানতে পেরেছি, কুয়াকাটার পর্যটন বিকাশে সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে ‘কুয়াকাটা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ’ গঠনের। পর্যটকদের আকৃষ্ট করা, জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও সৈকত নগরীর উন্নয়ন হবে এই কর্তৃপক্ষের কাজ। উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠনের লক্ষ্যে সরকারি প্রজ্ঞাপনে পটুয়াখালী জেলা প্রশাসককে সভাপতি ও জেলা গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীকে সদস্য সচিব করে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠনের কথাও বলা হয়। কিন্তু উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আজও আলোর মুখ দেখেনি। কুয়াকাটা আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন ‘কুয়াকাটা ইনভেস্টরস অ্যাসোসিয়েশন’ সূত্র বলেছে, কুয়াকাটার মহাপরিকল্পনা অনুমোদন না হওয়ায় এখানে বহুমূখী সমস্যা দেখা দিয়েছে। ব্যবসা বাণিজ্য স্তিমিত হয়ে পড়েছে। বিনিয়োগেও ভাটা পড়েছে।

কুয়াকাটার শৃঙ্খলা ফেরাতে, এখানকার পরিবেশ আরেকটু নির্মল রাখতে কোন মহাপরিকল্পনার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। সদিচ্ছা থাকলে এখানকার পৌরসভা, উপজেলা প্রশাসন এবং জেলা প্রশাসনই অনেক কিছু করতে পারে। শুধু দরকার মানসিকতার। মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই যে কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত পরিচ্ছন্ন হয়ে যাবে, এখানে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে- এমন ভাবার কারণ নেই। পৃথিবীর বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারসহ বাংলাদেশের অনেক পর্যটন স্পট দেখার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, অন্যান্য স্থানের চেয়ে কুয়াকাটার সম্ভাবনা অনেক বেশি। একইসঙ্গে এখানে অনেক কিছু দেখার আছে। পর্যটক আকর্ষণের সুযোগ অনেক বেশি। কিন্তু এখানে প্রকৃতি যেটুকু দিয়ে রেখেছে সেটুকু নিয়েই আমরা আছি। সেটা সুরক্ষার দায়িত্ব আমরা সকলেই ভুলে যেতে বসেছি। কুয়াকাটাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখার একজন মানুষের খুব অভাব। সে স্বপ্নটা সবার আগে দেখতে পারে এখানকার পৌরসভা।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১০ জানুয়ারি ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়