ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

ডায়াবেটিস ডাক্তাররা যা মেনে চলেন (প্রথম পর্ব)

এস এম গল্প ইকবাল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:০৭, ২৬ এপ্রিল ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ডায়াবেটিস ডাক্তাররা যা মেনে চলেন (প্রথম পর্ব)

প্রতীকী ছবি

এস এম গল্প ইকবাল : যারা ডায়াবেটিস রোগে ভুগেন তাদেরকে ডায়াবেটিক বলা হয়। ডায়াবেটিকদের জীবনযাত্রায় কিছু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে হয়, অন্যথায় তাদের রক্ত শর্করা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। রক্ত শর্করার মাত্রা বৃদ্ধি পেলে শরীর বিপদসীমার মধ্যে প্রবেশ করে। অনিয়ন্ত্রিত রক্ত শর্করা শরীরে মারাত্মক জটিলতা সৃষ্টি করে জীবনকে দুর্বিষহ পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়, একারণে ডায়াবেটিকদের রক্ত শর্করা নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে সচেতন থাকা অত্যাবশ্যক।

ডায়াবেটিসের ডাক্তাররা রক্ত শর্করা নিয়ন্ত্রণের জন্য ডায়াবেটিকদেরকে যেসব পরামর্শ দেন, তা তারা নিজেরাও মেনে চলার চেষ্টা করেন। ডায়াবেটিসের ডাক্তাররা নিজেদের রক্ত শর্করা নিয়ন্ত্রণের জন্য যা করেন, তা নিয়ে দুই পর্বের প্রতিবেদনের আজ থাকছে প্রথম পর্ব।

* ঘরে রান্না করা খাবার খান
অফিসে দীর্ঘসময় কাটানোর পর ঘরে প্রস্তুতকৃত খাবার খাওয়ার চেয়ে ভালো কিছু নেই। এতে শুধুমাত্র আপনার পাকস্থলিই আপনাকে ধন্যবাদ জানাবে না, আপনার রক্ত শর্করাও কৃতজ্ঞ থাকবে। মন্টিফিয়োর জ্যাক ডি. ওয়েলার হসপিটালের ক্লিনিক্যাল ডায়াবেটিস সেন্টারের পরিচালক ও আলবার্ট আইনস্টাইন কলেজ অব মেডিসিনের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক জোয়েল জনসজেন বলেন, ‘আমার পরিবার ও আমি ঘরের খাবার খাই। সেলফোন, টেলিভিশন অথবা কম্পিউটারের সঙ্গ ছেড়ে খাবার টেবিলে স্ত্রী ও সন্তানের সঙ্গে কথা বলা গুরুত্বপূর্ণ।’ প্রকৃতপক্ষে, নার্সেস হেলথ স্টাডি অ্যান্ড হেলথ প্রফেশনাল ফলো-আপস স্টাডি নামক গবেষণায় ৯৯,০০০ পুরুষ ও নারীদের কাছ থেকে ৩০ বছরেরও বেশি সময়ের খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। যেসব লোক প্রতিদিন অন্তত দুবেলা ঘরের খাবার খেয়েছিল তাদের ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি সেসব লোকদের তুলনায় গড়ে ১৩ শতাংশ কম ছিল যারা প্রতিসপ্তাহে ছয় বেলার চেয়ে কম ঘরে প্রস্তুতকৃত খাবার খেয়েছিল। টাইপ ২ ডায়াবেটিস প্রতিরোধের একটি সহজ উপায় হলো ঘরে খাবার তৈরি করা।

* প্রতিসপ্তাহে কয়েকবার ৩০ মিনিট ব্যায়াম করেন
ব্যায়াম রক্ত শর্করার মাত্রাকে নিচের দিকে পাঠায় এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ব্যায়ামের রক্ত শর্করা হ্রাসের ক্ষমতা আছে বিধায় নিয়মিত ব্যায়াম চর্চা করা গুরুত্বপূর্ণ। বোস্টনে অবস্থিত জোসলিন ডায়াবেটিস সেন্টারের ডায়াবেটিস এডুকেটর জেন লিব্লাঙ্ক (তার টাইপ ১ ডায়াবেটিস আছে) বলেন, ‘দৌঁড়ের মতো অ্যারোবিক ব্যায়াম আমার রক্ত শর্করার মাত্রাকে নিম্ন রাখে, কারণ এ ধরনের শরীর চর্চায় দ্রুত বেশি শর্করা পোড়ে। অন্যদিকে অ্যানারোবিক ব্যায়ামে শর্করা পোড়ে ধীরে, এতে আমার রক্ত শর্করার মাত্রা কমাতে কয়েক ঘন্টা লেগে যায়।’ লিব্লাঙ্ক ৩০ মিনিটের একটি বুট ক্যাম্প ফিটনেস ভিডিও তৈরি করেছেন, যেখানে হাই ইন্টেনসিটি অ্যাক্টিভিটি এবং লাঞ্জেস ও স্কোয়াটের মতো স্ট্রেংথ ট্রেনিংয়ের সমন্বয় আছে।

* সকালে শ্বেতসারযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলেন
কেউই চাইবে না যে রক্ত শর্করা বৃদ্ধি পায় এমন খাবার খেয়ে দিন শুরু করতে, কারণ এটি দিনের অবশিষ্ট সময় ভোগাতে থাকে। সকালে আপনাকে জাগাতে আপনার শরীরে হরমোনের জোয়ার আসে- এটাকে বলে ডন ফেনোমেনন। যখন বেশি পরিমাণে হরমোন উৎপন্ন হয়, তখন রক্ত শর্করার মাত্রা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। ডায়াবেটিকদের জন্য ডন ফেনোমেনন বিপজ্জনক হতে পারে, কারণ অতিরিক্ত রক্ত শর্করার প্রতি তাদের ইনসুলিন সঠিকভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে না। ইউনিভার্সিটি অব মিশিগান হেলথ সিস্টেমের এন্ড্রোক্রাইনোলজিস্ট বিভাগের সহকারী অধ্যাপক স্কট সোলেমানপার (তার টাইপ ১ ডায়াবেটিস আছে) বলেন, `আমি লক্ষ্য করি যে সকালে কিছু খেলে তা ডন ইফেক্টের সমন্বয়ে আমার রক্ত শর্করার মাত্রাকে শীর্ষে পৌঁছে দেয়।‘ তিনি ও লিব্লাঙ্ক উভয়েই সকাল শুরু করেন নিম্ন কার্বোহাইড্রেটের খাবার খেয়ে, যেমন- এক গ্লাস গ্রিক দই অথবা প্রোটিন শেকের সঙ্গে একটি সিদ্ধ ডিম। এসব ব্রেকফাস্ট তাদের পেট ভরিয়ে তোলে, কিন্তু রক্ত শর্করার মাত্রাকে আকাশে তোলে না।

* আঁশ সমৃদ্ধ খাবার খান
আঁশযুক্ত খাবার শরীরে শর্করা শোষণকে বিলম্বিত করে দ্রুত রক্ত শর্করার মাত্রা বৃদ্ধি প্রতিরোধ করে। ডা. সোলেমানপার বলেন, ‘পেট ভরতে আমি লাঞ্চে আঁশ সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার চেষ্টা করি, যার ফলে পরবর্তীতে স্ন্যাকস খাওয়ার প্রবণতা কমে। একারণে খাওয়ার পর আমি উচ্চ রক্ত শর্করা ও নিম্ন রক্ত শর্করার রোলারকোস্টারে উঠি না।’ তিনি লাঞ্চে ঘরে প্রস্তুতকৃত পাতাকপির স্মুদি খান, যেখানে কয়েক বাটি পাতাকপি, পাঁচ থেকে ছয় কাপ পানি এবং সুস্বাদু করতে অর্ধ বা এক বাটি আনারস থাকে। যদি তিনি কোনো কারণে পেট ভরপুর লাঞ্চ করতে না পারেন, তাহলে রক্ত শর্করা নিয়ন্ত্রণে রাখতে দুই টেবিল চামচ দ্রবণীয় আঁশ এক গ্লাস পানিতে মিশিয়ে পান করেন।

* এক খন্ড টোস্ট খান
এক খন্ড টোস্ট, এমনকি এটি হোল গ্রেন না হলেও, তৎক্ষণাৎ আপনার রক্ত শর্করার মাত্রাকে শীর্ষে পৌঁছাবে না, বিশেষ করে পরিমিত পরিমাণে খেলে। প্রকৃতপক্ষে, টোস্টেড হোয়াইট ব্রেডে ফ্রেশ হোয়াইট ব্রেডের তুলনায় গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কম থাকতে পারে, ইংল্যান্ডের একটি ছোট গবেষণা অনুসারে। ডা. জনসজেন বলেন, ‘সাধারণ ব্রেডের চেয়ে টোস্টেড ব্রেড ভালো, কারণ এতে অল্প কার্বোহাইড্রেট থাকে।’ তিনি ব্রেকফাস্টে পরিমিত পরিমাণে কার্বোহাইড্রেট খাওয়ার চেষ্টা করেন, যেমন- ব্যাগেল অথবা একখন্ড হোয়াইট ব্রেড টোস্ট। কিন্তু ডায়াবেটিকদের জন্য সবচেয়ে ভালো পছন্দ হলো হোল গ্রেন। অন্যতম ডায়াবেটিস মিথ হলো ব্রেড বা পাউরুটি সম্পূর্ণরূপে বর্জন করা।

* অল্পসময়ে শিথিল করে এমন কাজে যুক্ত থাকেন
আজকালকার বিশ্বে ব্যস্ত জীবনযাপনের একটি অনাকাঙ্ক্ষিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলো স্ট্রেস বা মানসিক চাপ। যদি আপনি স্ট্রেস কমানোর পদক্ষেপ গ্রহণ না করেন, তাহলে আপনার শরীরে ‘ফাইট অর ফ্লাইট’ অর্থাৎ ‘লড়াই করো অথবা পালিয়ে যাও’ মোডের সময় উৎপন্ন অত্যধিক হরমোনের প্রতিক্রিয়ায় রক্ত শর্করা বেড়ে যেতে পারে। মারাত্মক মাত্রার স্ট্রেসের সময় আপনার শরীর প্রচুর পরিমাণে হরমোন নিঃসরণ জনিত ক্ষতিপূরণ করতে অধিক শর্করা তৈরি করে, যা ডায়াবেটিকদের জন্য সমস্যার কারণ হতে পারে, কারণ তাদের ইনসুলিন তাদের কোষকে ব্যবহারের জন্য অতিরিক্ত শক্তি শোষণে সক্ষম করতে পারে না। লিব্লাঙ্ক স্নায়ুকে শান্ত করতে হেডস্পেসের মতো মেডিটেশন অ্যাপস ও প্রশান্তিদায়ক সংগীতের ওপর নির্ভর করেন। স্ট্রেস হলো দৈনিক কাজের একটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, যা ডায়াবেটিসকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যেতে পারে।

* ডায়াবেটিক-বান্ধব পরিকল্পনার জন্য পুষ্টিবিদের সাহায্য নেন
ডা. সোলেমানপার বলেন, ‘আমার সমগ্র ক্যারিয়ার জুড়ে আমি অনেক সনদপ্রাপ্ত ডায়াবেটিস শিক্ষক ও পুষ্টিবিদের সঙ্গে কাজ করেছি। আমি তাদের কাছ থেকে কোন খাবারটি কেন ভালো বা খারাপ তা জেনে নিতাম। কিন্তু এ ধরনের তথ্য পেতে আপনার কোনো এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট বা ডায়াবেটিস সমন্বয়কারীর কাছে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।’ আপনার জন্য ডায়াবেটিক-বান্ধব ডায়েট পরিকল্পনা করতে কোনো অভিজ্ঞ পুষ্টিবিদের কাছে যেতে পারেন। এ বিষয়ে যত বেশি জানবেন, তত বেশি সফলতার সঙ্গে ডায়াবেটিসকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন।

(আগামী পর্বে সমাপ্য)
 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৬ এপ্রিল ২০১৯/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়