ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

বাংলাদেশের নেইমার হতে চায় বাকপ্রতিবন্ধী হাসিব

মহিউদ্দিন অপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৫১, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বাংলাদেশের নেইমার হতে চায় বাকপ্রতিবন্ধী হাসিব

মহিউদ্দিন অপু : অভাব আর পেটের প্রয়োজন মেটাতে যে পরিবারের পিতামাতার সমগ্র দিন কাটে সেই পরিবারের শিশুদের অনেক স্বপ্ন যেন স্বপ্নই থেকে যায়। তেমনি এক অভাব অনটনের পরিবারের শিশু হায়দায় হোসেন হাসিব। বরগুনা জেলা ক্রীড়া সংস্থার একজন খুদে ফুটবলার হাসিব জন্মগত বাক ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী। নিজের শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে পেছনে ফেলে সে একদিন বাংলাদেশের নেইমার হতে চায়।

বরগুনা সদর উপজেলার ৩নং ওয়ার্ডের কড়ইতলা আশ্রয়ণ প্রকল্পে ছোট্ট একটি ঘরে মা-বাবাসহ মাথা গোঁজার ভাগ্য হলেও কখনো স্পষ্ট কন্ঠে মনের ভাব প্রকাশ করে কথা বলার ভাগ্য হয়নি শিশু হাসিবের। হাসিবের মা হাসিনা বেগম জানান, মাতৃগর্ভাবস্থায় রুবেলা নামক ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মূক ও বধির হয়েই জন্ম নেয় হাসিব।

একজন মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনের অপরিহার্য অঙ্গ ‘বাক ইন্দ্রিয় ও শ্রবণেন্দ্রিয়’, যা হাসিবের সম্পূর্ণই বিকল। কিন্তু অপরিচিত লোকজন তা বুঝতে পারেনা। সাধারণত মূক ও বধিরতা বাইরে থেকে দৃষ্টিগোচর নয়। দেখতে সম্পূর্ণ সুস্থ্ সবল একজন মানুষ। স্বাভাবিক ভাবে যার চলাফেরা। তাকে কেউ প্রতিবন্ধী বলে মনে করবেনা। এ কারণে হাসিবের মতো মূক ও বধিরদের পথেঘাটে অনেক বিড়ম্বনার সম্মুখীন হতে হয়।

বরগুনা পৌরসভাধীন স্থানীয় কড়ইতলা গগন আলী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণী পড়ুয়া হাসিবের তেমন কোনো বন্ধু নেই। ক্লাসেও কারো সঙ্গে ভালো বন্ধুত্ব হয় না তার। লেখাপড়ায় মেধাবী হলেও লেখাপড়া ভালো লাগেনা তার। ক্লাসে শিক্ষকরা যা পাঠদান করেন অন্য শিক্ষার্থীদের মতো সে তা বুঝতে পারেনা বলে লেখাপড়ায় তার অনীহা। শুধুমাত্র ইশারা ইঙ্গিতে পাঠদান কিংবা কিছু বললে সে তা ভালো বুঝতে পারে বলে জানান হাসিবের বাবা মো. নূর মিয়া।

 



স্কুলের বাইরে বরগুনা সদর স্টেডিয়াম সংলগ্ন একটি ছোট চায়ের দোকানেই বেশিরভাগ সময় কাটে হাসিবের। চায়ের দোকানই হাসিবের লেখাপড়ার খরচ ও দু’বেলা ভাতের একমাত্র ভরসা। মা-বাবা দুজনই দিনরাত পরিশ্রম করে তাদের একমাত্র আয়ের উৎস চায়ের দোকানঘরে। তাই হাসিবও তাদের সঙ্গে দিনরাত চায়ের দোকানেই থাকে।

হাসিবের লেখাপড়া, বিনোদন সবকিছুই হয় তাদের চায়ের দোকানে। মা-বাবার অনুপস্থিতিতে ক্রেতাদের সামলাতে বিব্রত হওয়া তার নিত্যদিনের অভ্যাস। সাইন ল্যাংগুয়েজ (আকার ইঙ্গিতে মনের ভাব প্রকাশ করা) ব্যবহার করে তাকে কিছু ক্রয়ের কথা জানালে খুব খুশি হয় বলে জানান, হাসিবদের দোকানের পরিচিত নিয়মিত ক্রেতারা।

বিকেল হতে যতটুকু সময়। কারো সাধ্য নেই হাসিবকে ঘর কিংবা দোকানে বসিয়ে রাখার। বরগুনা সদর স্টেডিয়াম মাঠে সিনিয়র ফুটবলারদের ফুটবল প্র্যাকটিস না দেখলে পেটের ভাত যেন হজম হয় না তার। প্র্যাকটিস দেখতে কেউ বাধা দিলে হাউমাউ কন্ঠে রাগ প্রকাশ করলেও প্রকাশ করতে পারেনা স্বাভাবিক কণ্ঠস্বরে মনের কথা।

বাবার কাছে বায়না করে একটা ফুটবল কিনেছে সে। ইদানিং বল নিয়ে স্টেডিয়ামের খুদে ফুটবলারদের সঙ্গে মাঠে খেলতে যায় হাসিব। স্থানীয় ফুটবল খেলোয়াড়দের প্র্যাকটিস শেষে ফেলে দেয়া একজোড়া বুট জুতো মাঠে কুড়িয়ে পেয়েছে হাসিব। সেই খেলার বুট নিয়ে নতুন স্বপ্ন সঞ্চার হয়েছে শিশু হাসিবের মনে।

 



ঘড়ির কাটায় আনুমানিক রাত প্রায় ১২টা। একদিকে চায়ের দোকান সাজিয়ে গুছিয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে বন্ধ করতে ব্যস্ত হাসিবের মা-বাবা। অন্যদিকে হাসিবকে দেখা গেল ঘুমঘুম চোখে কুড়িয়ে পাওয়া সেই বুট জোড়া সাবান পানিতে মনোযোগ দিয়ে নিখুঁত ভাবে পরিষ্কার করছে। সাবান পানিতে জুতো জোড়া পরিষ্কার শেষ হলে জুতোর দিকে তাকিয়ে আনমনে হেসে ওঠে হাসিব। হাসির কারণ জানতে চাইলে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে খানিকক্ষণ। হাউমাউ করে অনেক কিছু বললেও শুধুমাত্র বাংলাদেশ শব্দটাই বোঝা যাচ্ছিল। কাছেই হাসিবের মা দাঁড়িয়ে আছে। হাউমাউ করে যা সে নিজে বোঝাতে পারেনি তা তার মায়ের হাত ধরে বোঝানোর জন্য নিয়ে আসলে মা হাসিনা বেগম জানান, ক্রিকেট ও ফুটবল দুটোই খুব পছন্দের খেলা হাসিবের। ক্রিকেটে হাসিবের প্রিয় দল বাংলাদেশ। হাসিব একদিন বড় খেলোয়াড় হতে চায়। তবে ক্রিকেটার না, বড় মাপের ফুটবলার। ব্রাজিলের বিখ্যাত ফুটবলার নেইমারের মতো খেলোয়াড় হতে চায় হাসিব।

হাসিব সম্পর্কে স্থানীয় সাংবাদিক সুমন শিকদার বলেন, ‘হাসিব খুব মেধাবী। সে চায় খেলাধুলা নিয়ে অনেক দূর এগিয়ে যেতে। তার ইচ্ছাশক্তিকে প্রাধান্য দিয়ে তাকে এই বিষয়ে এগিয়ে নিতে ক্রীড়া সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় গণ্যমান্যদের এগিয়ে আসা উচিৎ।’

হাসিবকে নিয়ে কথা হলে স্থানীয় মানবাধিকারকর্মী সাইমুল ইসলাম রাব্বি বলেন, ‘মূক ও বধিরতা কোনো অভিশাপ নয়। রোগব্যাধি বা দুর্ঘটনার কারণে যে কেউ মূক ও বধির হতে পারে। মূক-বধির শিশুকে অবজ্ঞা বা অবহেলা না করে তাদের জন্য যথাসময় উপযুক্ত চিকিৎসা এবং শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলে মূক ও বধিরগণ পরিবারের বোঝা না হয়ে নিজেদের কর্মদক্ষতার গুণে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে সক্ষম হবে।

ব্রাজিলভক্ত হাসিবের স্বপ্ন নেইমার কিংবা ব্রাজিলের হলুদ জার্সি নয়। লাল সবুজের বাংলাদেশ ফুটবল দলের নেইমার হবার স্বপ্ন তার। হাসিবের মতো মূক ও বধির শিশুদের অবজ্ঞা বা করুণার পাত্র বিবেচনা না করে তাদের মানুষ হিসেবে বিবেচনা করলেই তাদের প্রতি যথোপযুক্ত সম্মান জানানো হবে। অপরদিকে বাক ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী হাসিবদের চিকিৎসা ও সাহায্য সহায়তার মাধ্যমে তাদের ইচ্ছা পূরণে সরকার এবং সকল দায়িত্বশীল নাগরিকগণ আন্তরিকতার সঙ্গে এগিয়ে আসলে একদিন এমন হাসিবরা হয়ে উঠবে বাংলাদেশের নেইমার।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়