ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

হাসির চাবুক ও হুমায়ূন আহমেদ

মুম রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:০৭, ১৩ নভেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
হাসির চাবুক ও হুমায়ূন আহমেদ

|| মুম রহমান ||

বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয়তম লেখক হুমায়ূন আহমেদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য তাঁর রসবোধ। নির্মল হাস্য রসের পাশাপাশি তাঁর রচনায় ব্যঙ্গ, বিদ্রূপ ও প্রহসনের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ‘আলালের ঘরের দুলাল’, ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’র ঐতিহ্য ধরে বাংলা ছোটগল্পে বিদ্রূপ-ব্যঙ্গর ঐতিহ্য যথেষ্ট প্রাচীন। বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথের হাত হয়ে বাংলা ছোটগল্পে হাস্য-কৌতুকের আড়ালে সামাজিক অসঙ্গতি তুলে ধরার নজির কম নয়। এমনকি নারী জাগরণের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়াও লিখেছেন ‘বিয়ে পাগলা বুড়ো’র মতো প্রহসন। ইব্রাহীম খাঁ’র ‘ক্ষ্যান্তমাসী’, আবুল মনসুর আহমদের ‘ফুড কনফারেন্স’, ‘গো-দেওতা-কা দেশ’, আবদুস শাকুরের ‘ক্রাইসিস’-এর মতো শিল্প সফল গল্প আমরা পেয়েছি।

পূর্বসূরীদের ধারাবাহিকতায় হুমায়ূন আহমেদও ছোটগল্পে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের চর্চা করেছেন। এরমধ্যে তিনটি ছোটগল্প বিস্তৃত পরিসরে আলোচনার দাবি রাখে বলে মনে করি। ‘হিমুর একান্ত সাক্ষাৎকার’, ‘মন্ত্রীর হেলিকপ্টার’ এবং ‘ফজলুল করিম সাহেবের ত্রাণকার্য’ গল্প তিনটিতেই হাসির আড়ালে সামাজিক অসঙ্গতি উঠে এসেছে। আপাত হাসির এই গল্পগুলোর নিরীক্ষণ এক চাবুক বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় আমাদের। এ দেশের কথিত রাজনীতিকদের চরিত্র উন্মোচিত হয়েছে হুমায়ূন আহমেদের দুটি গল্পে। ‘মন্ত্রীর হেলিকপ্টার’ এবং ‘ফজলুল করিম সাহেবের ত্রাণকার্য’ শিরোনামের দুটো গল্পে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ভণ্ডামি চিত্রিত হয়েছে। এ দেশের দুইজন মন্ত্রীর লোক দেখানো কার্যক্রম তুলে ধরা হয়েছে সেখানে। দুটো গল্পই তীব্র শ্লেষ ও ব্যঙ্গে পরিপূর্ণ।

‘মন্ত্রীর হেলিকপ্টার’ গল্পে দেখা যায় মন্ত্রী হওয়ার পর আব্দুল কাদের জোয়ারদার সরকারি সফরে গ্রামের বাড়ি যাবেন। এই সফরে তিনি গ্রামের উন্নয়ন স্বচোক্ষে দেখবেন, জনগণের উদ্দেশ্যে স্কুল মাঠে বক্তৃতা করবেন এবং একটি মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করবেন। নিজ গ্রাম এবং নিজের ভোট এলাকা বলেই তিনি সফরটি জাঁকজমকের সাথে করতে চান। তাই এই সফরের প্রধান শর্ত হয়ে ওঠে হেলিকপ্টার। পিএসকে তিনি জানিয়ে দেন, হেলিকপ্টার ছাড়া যাবেন না তিনি। অবশেষে হেলিকপ্টার নিয়ে তিনি গ্রামে পৌঁছান।  গ্রামের লোকদের বাড়ি বাড়ি যান তিনি এবং স্কুলের শিক্ষকদের পা ছুঁয়ে সালাম করেন। সর্বোপরী চমৎকার বক্তৃতাও তিনি দেন। পাশাপাশি আরেকটি অভিনব কাজ করেন তিনি। ঢাকায় চিকিৎসা করানোর জন্য হেলিকপ্টারে করে একজন শঙ্কটাপন্ন রোগিকে আনার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু হেলিকপ্টার ছাড়ার দশ মিনিটের মাথায় রোগীর অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়। পিএস জানায়, ‘ঘাটের মরা তুলে দিয়েছে স্যার।’ এ রোগী মারা গেলে ডেডবডি নিয়ে ঝামেলা হবে। অতএব হেলিকপ্টার ফিরে এলো। ‘‘হেলিকপ্টার আবার নামল স্কুলের মাঠে। রোগি মারা গেল তারো কিছুক্ষণ পর। নামাজের জানাজার শেষে মন্ত্রী সাহেব অসাধারণ একটি বক্তৃতা দিলেন। অনেকেই কেঁদে ফেলল। ফেরার পথে তিনি পিএস-কে বললেন, ‘প্রোগ্রামটা শেষ পর্যন্ত ভালোই হয়েছে, কি বলেন? সব ভালো যার শেষ ভালো।’’

সমালোচক চঞ্চল কুমার বোস যথার্থই ব্যাখ্যা করেছেন- ‘মন্ত্রীর হেলিকপ্টার’ গল্পের ফর্ম স্যাটায়ারিক। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ট হয়ে একজন মন্ত্রীর আত্মম্ভরিতা এবং নিজের গ্রামের মানুষের সামনে তার ঐশ্বর্য এবং ক্ষমতা প্রদর্শনের অভিলাষ ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গিতে উপস্থাপিত হয়েছে। শুধু চটুল জনপ্রিয়তার লোভে মন্ত্রী হেলিকপ্টারে অসুস্থ রোগীকে তুলে নেন। পথিমধ্যে তার অবস্থার আরও অবনতি, পুনরায় তাকে নিয়ে গ্রামে প্রত্যাবর্তন। কিছু সময় পর রোগীটির মৃত্যু এবং জানাযায় অংশ নিয়ে মন্ত্রীর রাজধানী যাত্রার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রনেতাদের ভণ্ডামি, শঠতা ও অমানবিকতাকে তীব্রভাবে বিদ্রূপ করা হয়েছে।’ (চঞ্চল কুমার বোস, ২০০৯, বাংলাদেশের ছোটগল্পের শিল্পরূপ, বাংলা একাডেমি, ঢাকা)। এই গল্পটি সর্ম্পকে হুমায়ূন গবেষক সালেহ চৌধুরী বলেন, ‘বিনোদন সাহিত্যের অন্যতম উপজীব্য, সন্দেহ নাই। একই সঙ্গে তা সামাজিক দায়বদ্ধতার চাহিদাও মেটাতে হয়। ‘মন্ত্রীর হেলিকপ্টার’ তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। মন্ত্রী আব্দুল কাদের জোয়ারদার নিজের গ্রামে যাবেন। এ জন্য তার হেলিকপ্টার চাই। লোকজনকে দেখাতে হবে তো! হেলিকপ্টারে করে একজন রোগীকে ঢাকায় নিয়ে আসতে পারলে নিজ মহানুভবতার প্রচার হয়। গল্প তো এই। কিন্তু তা এমনভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, এ যেন ক্ষমতাবানের প্রদর্শন বাতিক আর দাপটের উপর তীব্র কষাঘাত। গল্পটির প্রথম প্রকাশের পর স্থান বিশেষে সে আঘাত লেগেছিল। তবে সে প্রসঙ্গ এখানে অবান্তর।’ (বাছাই গল্প, হুমায়ূন আহমেদ, ২০১২, অন্যপ্রকাশ, সালেহ চৌধুরীর ভূমিকা অংশ)

বলাবাহুল্য ‘মন্ত্রীর হেলিকপ্টার’ গল্পের চাবুক যথাযথ স্থানেই আঘাত হেনেছিল। প্রায় একই ধরণের রাজনৈতিক কপটতা লক্ষ্য করা যায় ‘ফজলুল করিম সাহেবের ত্রাণকার্য’ গল্পের নাম চরিত্রের মধ্যে। গল্পের শুরুতেই, ‘ফজলুল করিম সাহেব গম্ভীর মুখে বললেন, ‘মাঝে মাঝে বড় ধরনের ক্যালামিটির প্রয়োজন আছে। বন্যার খুব দরকার ছিল।’ বন্যাটাকে প্রতিমন্ত্রী ফজলুল করিম একটা সুযোগ হিসেবেই ব্যবহার করতে চান। তিনি নিজে তাই ত্রাণকার্যে রওনা দেন। কিন্তু শুরুতেই ঝামেলা। সারেংকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অবশেষে ভর দুপুরে লঞ্চ ছাড়লো। ফজলুল করিম এমন জায়গায় পৌঁছতে চান যেখানে এখনও সাহায্য পৌঁছায়নি। তার ত্রাণসামগ্রীর তালিকায় আছে বায়ান্নটা তাঁবু, এক হাজার কনসানট্রেটেড টমেটো জুস, পাঁচশ বোতল ডিস্টিল ওয়াটার। তবে এর সঙ্গে রান্না করা খিচুড়িও আছে। ইতোমধ্যে খিচুড়ি টক হয়ে গেছে। খিচুড়ি ফেলে দিতে হলো। লঞ্চ মাঝ নদীতে চলে এসেছে কিন্তু সাহায্য দেয়ার মতো কাউকে পাওয়া গেলো না। ফেরার সময় নদী পথে কলাগাছের ভেলায় একটি পরিবার পাওয়া গেলো। তিন বাচ্চা, বাবা-মা, একটি ছাগল এবং চারটা হাঁস। তাদেরকে শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা দেয়া হলো। আর ক্যাশ সাতাশি টাকা তেপ্পান্ন পয়সা দেয়া হলো। উল্লেখ্য, ত্রাণের জন্যে আনা পাঁচ হাজার টাকার বাকীটা খরচ হয়ে গেছে সারেং ও তার দুই অ্যাসিস্ট্যান্টের বেতন, ভিডিও ভাড়া, চা-নোনতা বিস্কুট ও কলা কেনার জন্যে। পরিবারটিকে একটি তাঁবু দিতে চাইলে তারা তা নিলো না, বরং লঞ্চে উঠে এলো। এগারো-বারো বছরের একটি মেয়ে লঞ্চে উঠেই হড়বড় করে বমি করল। ফজলুল করিম ভয় পেলেন, কলেরা কি না? মেজাজ খারাপ করে বাকি সময়টা ক্যাবিনে দরজা আটকে বসে থাকলেন।

‘পরদিনের খবরের কাগজে ফজলুল করিম সাহেবের ত্রাণকার্যের একটি পূর্ণ বিবরণ ছাপা হয়- অত্যন্ত প্রতিকূল অবস্থায় জনশক্তি দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী জনাব ফজলুল করিম একটি ত্রাণদল পরিচালনা করে বন্যা মোকাবিলায় বর্তমান সরকারের অঙ্গীকারকেই স্পষ্ট করে তোলেন। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় পুরো চব্বিশ ঘণ্টা অমানুসিক পরিশ্রম করে তিনি নিজেই অসুস্থ হয়ে বর্তমানে মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসাধীন। জনশক্তি মন্ত্রী জনাব এখলাস উদ্দিন হাসপাতালে তাঁকে মাল্যভূষিত করে বলেন- বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের ফজলুল করিম সাহেবের মতো মানুষ দরকার। পরের জন্যে যাঁরা নিজের জীবন উৎসর্গ করতে পিছপা নন। এই প্রসঙ্গে রবি ঠাকুরের একটি কবিতার চরণও আবেগজড়িত কণ্ঠে আবৃত্তি করেন- ‘কেবা আগে প্রাণ করিবেক দান, তার লাগি কাড়াকাড়ি।’

প্রতিমন্ত্রী ফজলুল করিম ও মন্ত্রী আব্দুল কাদের জোয়ারদার- দুইজনই জনসেবার চেয়ে প্রচারে অধিক বিশ্বাসী। তারা দুজনেই তাদের সকল কাজকর্ম থেকে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চান। হুমায়ূন আহমেদ এই দুই গল্পে রাজনৈতিক ভণ্ডামির সাহসী চিত্র তুলে ধরেছেন।

সরসতা হুমায়ূন আহমেদের লেখনীর একটি বড় বৈশিষ্ট্য। হাস্যরস, কৌতুক তাঁর বহু গল্পের পরতে পরতে বিদ্যমান। সমালোচক এই দুটি গল্প সম্পর্কে বলছেন- ‘তার গল্পের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হাস্যরস ও ব্যঙ্গরূপ। খুব কঠিন কথাও হাস্যরস ও ব্যঙ্গরূপের মাধ্যমে প্রকাশ পায়।’ (মোহাম্মদ নূরুল হক, দৈনিক ইত্তেফাক, ২০১২)। কথাসাহিত্যিক আহমাদ মোস্তফা কামাল তাঁর সম্পাদিত ‘বাংলা সাহিত্যের সেরা গল্প’ গ্রন্থের ভূমিকায় উল্লেখ করেন: ‘ ‘পলিটিক্যাল স্যাটায়ার হিসেবে বাংলা সাহিত্যে এটি একটি উজ্জ্বল সংস্করণ। তার ‘ফজলুল করিম সাহেবের ত্রাণকার্য’ গল্পটি কোথায় যেন আবুল মনসুর আহমদের ‘রিলিফওয়ার্ক’ গল্পের কথা মনে করিয়ে দেয়। দুটি গল্পের বিষয়বস্তুর মিল এবং বিদ্যমান তীব্র শ্লেষ এই তুলনার সুযোগ করে দেয়।

জনপ্রিয়তার নিরিখে হিমু চরিত্রের সমতুল্য চরিত্র বাংলা সাহিত্যে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তরুণ প্রজন্মের কাছে মিসির আলি’র চেয়ে হিমু জনপ্রিয়তর চরিত্র হলেও হিমুকে নিয়ে সে অর্থে হুমায়ূন আহমেদের ছোটগল্প প্রায় নেই বললেই চলে। হিমুকে নিয়ে ২২টি উপন্যাস লেখা হলেও তার একটি ছোটগল্প সংকলনের শিরোনাম ‘হিমুর একান্ত সাক্ষাৎকার ও অন্যান্য’। এই গ্রন্থের ‘হিমুর একান্ত সাক্ষাৎকার গল্পটি’ স্যাটায়ারধর্মী। হুমায়ূন আহমেদের রসবোধের সঙ্গে এ গল্পে যোগ হয়েছে প্রহসনের তীব্র চাবুক। হিমুর সাক্ষাৎকার নিতে যাবেন এক সাংবাদিক। সে শেষ পর্যন্ত হিমুকে খুঁজে পান না। কিন্তু হিমুর পরিচিত নানা লোককে পেয়ে তাদের সাক্ষাৎকার তুলে ধরেন এবং আগামী সংখ্যায় হিমুর একান্ত সাক্ষাৎকার ছাপা হবে প্রতিশ্রুতি দেন। এই গল্পে গণমাধ্যমকর্মীর চরিত্র, মাজেদা খালা, হিমুর খালু (বাদলের বাবা), লাক্স সুন্দরীসহ হুমায়ূন আহমেদ নিজে এবং তার ছোট ভাই ‘উন্মাদ’ পত্রিকার সম্পাদক, রম্যলেখক আহসান হাবীব ও  লেখকের স্ত্রী অভিনেত্রী শাওন গল্পের চরিত্র হয়ে এসেছেন। গল্পের সূচনা কথনটিতে এ গল্পের সুর ধরা পড়ে: ‘আমরা পাঠকদের কথা দিয়েছিলাম ঈদ সংখ্যায় হিমু এবং মিসির আলি সাহেবের একান্ত সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হবে। দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, মিসির আলি অসুস্থ হয়ে বক্ষব্যাধি হাসপাতালে বর্তমানে চিকিৎসাধীন তার অবস্থা সংকটাপন্ন ছিল, তবে তিনি এখন ভালো আছেন। তারপরেও তার চিকিৎসকরা তাকে পরিপূর্ণ বিশ্রাম নিতে বলছেন। তার কোনো সাক্ষাৎকার এ কারণেই প্রকাশ করতে পারছি না।

হিমুর সাক্ষাৎকারটি পত্রস্থ করা হলো। তার কোনো ছবি দেওয়া গেলা না। আমাদের নিজস্ব ফটোগ্রাফার সৈয়দ সদরুল তাকে নিয়ে ফটোসেশন করিয়েছিলেন। অজ্ঞাত কারণে একটি ছবিও প্রিন্ট হয়নি। আমরা পাঠকদের আশ্বস্ত করছি, অতি শিগগিরই হিমুকে নিয়ে আরেকটি সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে। সেখানে তিনি পাঠকদের প্রশ্নের উত্তর দেবেন। শ্রেষ্ঠ প্রশ্নকর্তা পাবেন এক হাজার টাকার প্রাইজবন্ড। এর সঙ্গে তিনি পাবেন আমাদের পত্রিকার ছয় মাসের ফ্রি গ্রাহক সুবিধা।’ (হুমায়ূন আহমেদ ২০১৬: ৮৭)

শুরুতে প্রতিবেদক হিমুর সাক্ষাৎকারটি পত্রস্থ করার কথা বললেও আদতে হিমুকে পাওয়াই যায়নি। ফলে ‘হিমুর একান্ত সাক্ষাৎকার’ গল্পে হিমুর কোনো সাক্ষাৎকারই নেই, বরং আমাদের সাংবাদিকদের সাক্ষাৎকার নেয়ার ধরন ও প্রবণতা নিয়ে যথেষ্ট প্রহসন আছে গল্পজুড়ে। প্রতিবেদক সপ্তাহব্যাপী ঢাকা শহরের অলিতে-গলিতে অনুসন্ধান করেও হিমুকে পাননি। অবশেষে তারা হিমুর পরিচিতজনদের সাক্ষাৎকার নেন। রূপা তার সঙ্গে অসহযোগিতামূলক আচরণ করে, তবে মাজেদা খালা উৎসাহ সহকারে সাক্ষাৎকার দেয়। হিমুর একান্ত অনুচর বাদলের সাক্ষাৎকার নিতে গেলে বাদলের বাবা তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠেন, সে বাড়িতে হিমুর নাম উচ্চারণ করাও নিষেধ। তিনি হুমকি দেন তারা এই মুহূর্তে বের না হয়ে গেলে তাদের কুকুর দিয়ে তাড়ানো হবে। মাজেদা খালার ঠিক করা হিমুর পাত্রী মিস কনার চরিত্র বর্ণনা এবং তার সাক্ষাৎকার অংশটি যথেষ্ট হাস্যরস ও শ্লেষের সৃষ্টি করে। প্রাসঙ্গিক বিবেচনা এই অংশটি উদ্ধৃত করছি: ‘মিস কনা এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে বর্তমানে ইন্টারে পড়ছেন। আমরা যখন তার বাসায় উপস্থিত হই, তখন তিনি কদবেলের ভর্তা খাচ্ছিলেন। তার পরনে ছিল ফিরোজা রঙের একটা কামিজ। মিস কনার উচ্চতা ৫ ফুট ৩ ইঞ্চি। ওজন ৫৮ কেজি। গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামলা। তিনি ধনু রাশির জাতিকা। তার পছন্দের রং সবুজ। পছন্দের খাবার শুঁটকি। চলচ্চিত্র জগতে তার পছন্দের নায়ক রিয়াজ। নায়িকা পূর্ণিমা। নাট্যজগতে তার প্রিয় অভিনেতা মাহফুজ, অভিনেত্রী শমী কায়সার। তিনি লাক্স-চ্যানেল আই সুপার স্টার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। থার্ড রাউন্ডে দর্শকদের এসএমএসে বাদ পড়ে যান। তার প্রিয় কবি শেক্সপিয়ার। প্রিয় ঔপন্যাসিক ইমদাদুল হক মিলন।’

এই  উদ্ধৃতাংশ আমাদের সাংবাদিকদের মেধা, ক্লিশে ও একঘেয়ে প্রতিবেদনের ভাষাকেই কটাক্ষ্য করে। হুমায়ূন আহমেদের প্রবল জনপ্রিয় দুই চরিত্র হিমু ও মিসির আলি ছোটগল্পে প্রায় অনুপস্থিত। মিসির আলিকে নিয়ে কয়েকটি গল্প থাকলেও হিমুকে নিয়ে এটিই একমাত্র ছোটগল্প। আর হুমায়ূন আহমেদ সাক্ষাৎকারধর্মী এই গল্পেও হাসির ছলে চাবুক চালিয়েছেন মিডিয়ার অসারতার দিকে। শ্লেষ, ব্যঙ্গ, বিদ্রূপ, কৌতুক, হাস্যরসের মাধ্যমে সামাজিক অসঙ্গতি, অন্যায়-অবিচার তুলে ধরা হলে সেটি অনেক বেশি কার্যকর মনে হয়। সেই বিবেচনায় এই তিনটি ব্যাঙ্গাত্মক গল্পের আদলে হুমায়ূন আহমেদ তার সামাজিক ও রাজনৈতিক দায়বদ্ধতাই তুলে ধরেছেন এবং হাসির আড়ালে অসঙ্গতিকে চাবুক পেটা করেছেন।





রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ নভেম্বর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়