ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

মৃত্যু এতো কাছ থেকে আগে দেখিনি

ইকরামুল হাসান শাকিল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:১৪, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মৃত্যু এতো কাছ থেকে আগে দেখিনি

নিদারুণ এক ভয়ংকর নির্ঘুম রাত গেলো আমাদের। সকালে হাইক্যাম্প থেকে কাঠমান্ডুতে মিংমার সঙ্গে মুহিত ভাইয়ের কথা হলো। তিনি জানালেন আগামী তিনদিন আবহাওয়া এমন খারাপ থাকবে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস। তাই আর এখানে আবহাওয়া ভালো হওয়ার অপেক্ষায় বসে থাকার কারণ নেই। সঙ্গে যে পরিমাণ খাবার আছে কাল পর্যন্ত হবে। আর আবহাওয়া যদি এমন থাকে তাহলে অ্যাভালান্সের ঝুঁকি বেড়ে যাবে। তখন আমাদের নিচে নেমে যাওয়াটাও কঠিন হয়ে পড়বে। তাই দেরি না করে ক্যাম্প গুছিয়ে ফেললাম। এখনো বাতাসের গতি অনেক বেশি। যদিও তুষারপাত হচ্ছে না। নিচে নামার পথে যেসব ক্রেভাস দেখেছিলাম এখন সেগুলো আর দেখা যাচ্ছে না। বরফে ঢেকে আছে। তাই পথটা বিপজ্জনক হয়ে গেলো আমাদের জন্য। খুবই সতর্কতার সাথে আস্তে আস্তে নামতে শুরু করলাম। উপরে ওঠা থেকে নামাটা আরো বেশি কঠিন ও ঝুকিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। যেখানেই পা রাখি বরফ সরে যায়। প্রতি মুহূর্ত ভয়ে ভয়ে নামতে হচ্ছে। হঠাৎ মুহিত ভাইয়ের ডান পা দুই পাথরের ফাঁকে আটকে গেলো। প্রথমে আমি অনেক চেষ্টা করলাম কিন্তু পাথর সরাতে পারলাম না। পেছন থেকে নুর ভাই ও বিপ্লব ভাই এসে মুহিত ভাইয়ের পা বের করে আনলেন।

বেসক্যাম্পে চলে এলাম। সবারই মন খারাপ সামিট না করে ফিরে আসার কারণে। আমরা সবাই দারুণভাবে অ্যাক্লামাটাইজ ছিলাম। তারপরও দলের সবাই পুরোপুরি সুস্থ থাকার পরও শুধু আবহাওয়ার খামখেয়ালির কারণে ফিরে আসতে হলো আমাদের। তবে সান্ত্বনার বিষয় এই, সবাই সুস্থভাবে দুর্ঘটনা ছাড়াই ফিরে আসতে পেরেছি। আমরা প্রায় পনেরো ঘণ্টা ছিলাম উপরে। সেই পনেরো ঘণ্টার প্রতিটা মুহূর্ত ছিলো বাঁচা-মরার টানটান উত্তেজনা। তখন অনেকবার মনে হয়েছে আর বোধহয় ফিরে যাওয়া হবে না। খুব বেশি করে তখন মাকে, বাবাকে আর ছোট দুই ভাইকে মনে পড়ছিলো। একাধিকবার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়েছে। আবার সঙ্গে সঙ্গে চোখের জলে বরফ জমেছে গালে। মৃত্যু এতোটা কাছ থেকে আগে কখনো দেখিনি। 

সন্ধ্যার পরিষ্কার নীল আকাশে এক ফালি চাঁদ দেখা দিলো। সেই চাঁদ দেখে আমাদের মন আরো ভেঙে গেলো। এ যেনো কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা। হঠাৎ করেই দিন শেষে আবহাওয়া ভালো হয়ে গেলো। পরিষ্কার আকাশে হাজারো তারার মেলা! সেই ভয়ংকর বাতাসের লেশ মাত্র নেই। অথচ আগামী তিনদিনই খারাপ আবহাওয়ার পূর্বাভাস ছিল। আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনায় আমাদের অভিযান অসম্পূর্ণ রেখেই আসতে হলো। ভাগ্যটা আমাদের সাথে ছিনিমিনি খেললো।

সেই ২০০৪ সাল থেকে প্রতি বছর হিমালয়ে অভিযান করছে ক্লাব বিএমটিসি। এই লারকে অভিযানটি ক্লাবের ২৯তম অভিযান। সফলতার সাথে ব্যর্থতার মুখও দেখেছে অনেক। সেই অভিজ্ঞতা আছে বলেই টিম বিএমটিসি সামলে নিতে সময় লাগেনি। দলনেতা দেশের অভিজ্ঞতম পর্বতারোহী এম এ মুহিতের সময় উপযোগী সিদ্ধান্তই হয়তো বড় কোন দুর্ঘটনা ছাড়া ফিরে আসতে পেরেছি। পর্বতে এটাই স্বাভাবিক- মেনে নিলাম সবাই। এই যেমন মুহিত ভাই হাই ক্যাম্প থেকে যখন খারাপ আবহাওয়ার কারণে সামিট পুশ করা যাচ্ছে না খবরটি স্যাটেলাইট ফোনে ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ইনাম আল হককে দিলেন, তখন তিনি সঙ্গে সঙ্গে আমাদের নেমে আসতে বললেন। পর্বতে সব কিছু স্বাভাবিকভাবে নেয়াও পর্বতারোহণের একটি শিক্ষা।

ভিমতাং থেকে সন্ধ্যার দিকে পোর্টাররা ফিরে এলো। সকালের নাস্তা সেরে বেসক্যাম্প গুছিয়ে ফেলা হলো। এদিকে একটি স্প্যানিশ টিম তাঁবু ফেলেছে। তারাও এসেছে লারকে পর্বত শিখর অভিযানে। আমরা তাদের শুভ কামনা জানিয়ে লারকে পাসের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। আধ ঘণ্টা পর আমরা ৫,১০৬ মিটার উচ্চতার লারকে পাসে এসে দাঁড়ালাম। যেসব ট্রেকাররা মানাসলু সার্কিট ট্রেকিং-এ আসেন তদের প্রধান বাধা হলো এই লারকে পাস। এই সার্কিটের সবচেয়ে উঁচু জায়গাও এই গিরিপথ। অসংখ্য প্রেয়ার ফ্ল্যাগে রঙিন লারকে পাস। সবাই নাম ফলকের কাছে এসে ছবি তুলছেন। আমরাও লাল সবুজের পতাকা নিয়ে ছবি তুললাম। এই লারকে পাসের পর আর কোন চড়াই নেই তেমন। শুধুই নামা।  দূরে দেখা যাচ্ছে হিমলুং রেঞ্জ। আমরা নামছি তো নামছিই। এ নামার যেন আর কোনো শেষ নেই। প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টার মধ্যেই আমরা ভীমতাং নেমে এলাম। এর উচ্চতা ৩,৭৫০ মিটার। মজার ব্যাপার হলো যে উচ্চতা আমরা দুই দিনে অতিক্রম করেছি বেস ক্যাম্পে আসার সময়, সেই একই দূরত্ব মাত্র কয়েক ঘণ্টায় নেমে এলাম। ভীমতাং-এর চারপাশে আকাশ ছোঁয়া পাহাড় আর পর্বতে ঘেরা। বিশাল সমতল ভূমিতে এই গ্রাম। গ্রামের ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে বয়ে গেছে ছোট্ট একটা খাল। কতদিন পানিতে পা ভিজাই না। লোভ সামলাতে পারলাম না। বুট আর মোজা খুলে নেমে পরলাম স্বচ্ছ পানিতে। আজকের দুপুরের খাবার এখানেই খাওয়ার ব্যবস্থ হয়েছে। এই ভীমতাংয়ে আমরা বেশ কয়েকদিন পর পেট ভরে ভাত খেলাম। তারপর চলে এলাম সুরকী খোলা। রাতটা এখানে কাটিয়ে পরদিন চলে এলাম দারাপানি। এই দারাপানিই হলো আমাদের অভিযানের ট্রেইলের শেষ রাত। দারাপানি থেকে জিপে চলে এলাম বেসিশহর। এখান থেকে বাসে কাঠমান্ডু।

পর্বতের খামখেয়ালিতে শিখর ছোঁয়ার শূন্যতা নিয়ে ফিরে এলাম ঘরে। পর্বত কখনো তার আরোহীকে ব্যর্থ ফিরিয়ে দেয় না। ফিরিয়ে দেয় শিক্ষা দিয়ে। যে শিক্ষা আবার পর্বতে ফিরে আসার শক্তি জোগায়।পবর্ত পর্বতের জায়গায় থাকবে। সে আর বড় হবে না। কিন্তু আমরা আবার আসবো নিজেদের প্রমাণ করতে। 

 




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়