ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

শুভ জন্মদিন সেলুলয়েড কবি

রুহুল আমিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৩০, ৬ ডিসেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শুভ জন্মদিন সেলুলয়েড কবি

রুহুল আমিন  : আজ ৬ ডিসেম্বর। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের মাস্টার ফিল্মমেকার তারেক মাসুদের জন্মদিন। শুভ জন্মদিন সেলুলয়েড কবি।

 

তারেক মাসুদ আমাদের চলচ্চিত্রের বিকল্প ধারার পুরোধা ব্যক্তিত্ব। তারেক মাসুদের পুরো নাম আবু তারেক মাসুদ। ১৯৫৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ফরিদপুরের ভাঙ্গার নূরপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তারেক মাসুদ। তার মায়ের নাম নুরুন নাহার ও বাবার নাম মশিউর রহমান মাসুদ।

 

আমরা তাকে চিনি বিকল্প ধারার চলচ্চিত্রকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ফেরিওয়ালা হিসেবে। তারেক মাসুদ ছিলেন একজন স্বাধীন চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার, লেখক ও গীতিকার।

 

ভাঙ্গা ঈদগাঁ মাদ্রাসায় প্রথম পড়াশোনা শুরু করেন । পরবর্তীতে ঢাকার লালবাগের একটি মাদ্রাসা থেকে মৌলানা পাস করেন। পরে ভাঙ্গা পাইলট উচ্চবিদ্যালয় থেকে প্রাইভেট পরীক্ষার মাধ্যমে প্রথম বিভাগে এসএসসি পাস করেন। আর আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজে ছয় মাস পড়াশোনার পর বদলি হয়ে নটরডেম কলেজ থেকে মানবিক বিভাগ থেকে এইচএসসি পাস করেন । পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন।

 

১৯৮২ সালের শেষ দিকে নির্মাতা হিসেবে তারেক মাসুদের যাত্রা শুরু। এ সময় তিনি প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের জীবনের ওপর প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন। ১৯৮৯ সালে মুক্তি পায় ওই  প্রামাণ্যচিত্রটি। এর আগে ১৯৮৭ সালে সোনার বেড়ি নামে নির্যাতিত নারীদের ওপর ২৫ মিনিট স্থায়ীত্বের একটি তথ্যচিত্রও নির্মাণ করেছিলেন তিনি।

 

এরপর থেকে তিনি বেশ কিছু প্রামাণ্যচিত্র, এনিমেশন, স্বল্পদৈর্ঘ্য ও পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। ২০০২ সালে তার প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র মাটির ময়না মুক্তি পায়। মাটির ময়নার জন্য তিনি ২০০২-এর কান চলচ্চিত্র উৎসবে ডিরেক্টর' ফোর্টনাইটসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেন। 

 

এ ছাড়া মাটির ময়না বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র হিসেবে, সেরা বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্রের জন্য একাডেমি পুরস্কারে মনোনীত হয়েছিল।  তার সর্বশেষ পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র রানওয়ে মুক্তি পায় ২০১০ সালে। তারেক মাসুদের অপর চলচ্চিত্রগুলো হলো অন্তর্যাত্রা (২০০৬) ও নরসুন্দর (২০০৯)। তিনি ১৯৯৫ সালে স্ত্রী ক্যাথরিনে সঙ্গে যৌথভাবে নির্মাণ করেন তথ্যচিত্র মুক্তির গান।

 

তারেক মাসুদ বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই চলচ্চিত্র আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। দেশে-বিদেশে চলচ্চিত্রবিষয়ক অসংখ্য কর্মশালা এবং কোর্সে অংশ নিয়েছেন তিনি। বাংলাদেশের বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সংগঠন শর্ট ফিল্ম ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য তিনি। ১৯৮৮ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রথম আন্তর্জাতিক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র উৎসবের কো-অর্ডিনেটর হিসেবে কাজ করেছেন।

 

তিনি স্ত্রী ক্যাথরিনকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকায় একটি চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন, যার নাম অডিওভিশন। এই দম্পতির 'বিংহাম পুত্রা মাসুদ নিশাদ' নামে এক ছেলে আছে।

 

আজকে যখন আমাদের সিনেমার দুর্দিন। বস্তাপঁচা গল্প আর দায়বোধহীন নির্মাতাদের বগলদাবায় পড়ে পুরো সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির মরি মরি অবস্থা, তখন একজন তারেক মাসুদের অভাব অনুভব হয়। তারেক মাসুদ যে কয়টা সিনেমা নির্মাণ করেছেন, তার চেয়ে বেশি অবদান সিনেমা নিয়ে মানুষকে স্বপ্ন দেখাতে পেরেছিলেন। একদল তরুণকে তিনি এই নির্মাতা হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। বর্তমান সময়ে যে কয়জন স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা আছেন তারা কোনো না কোনোভাবে তারেক মাসুদের কাছে ঋণী। মূল ধারার চলচ্চিত্রের বাইরে যেসব নির্মাতা সিনেমা নির্মাণ করছেন তারা কোনো না কোনোভাবে তারেক মাসুদ দ্বারা প্রভাবিত। অনেকে তারেক মাসুদের সঙ্গে সরাসরি কাজও করেছেন।  

 

তারেক মাসুদ আমাদের চলচ্চিত্রের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো তারেক মাসুদ। চলচ্চিত্রকে একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে দাঁড় করতে চেয়েছিলেন তিনি। যেখানে নিজস্ব ভাষা থাকবে। কিন্তু তিনি তা করে যেতে পারেননি। কাজ সমাপ্ত হওয়ার আগেই ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট তার স্বপ্নের সিনেমা ‘কাগজের ফুল’ সিনেমার শুটিংস্পট নির্বাচন করে ফেরার পথে মানিকগঞ্জের ঘিওরে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন।

 

তারেক মাসুদ মাত্র কয়েকটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন। কিন্তু যে কয়টা নির্মাণ করেছেন সেখানে নিজের বক্তব্যকে তুলে ধরেছেন নির্ভয়ে। দৃষ্টি শক্তিকে নিয়ে গেছেন মানব মনের অতল তলে। দেখাতে চেয়েছেন মানব মনের গভীরের যাতনা, মর্মবেদনা, ক্রন্দন, জিজ্ঞাসা, ঘৃণা। সৃষ্টি করতে চেয়েছেন চলচ্চিত্রের কাব্যিক ঢং। যার জন্য আমরা এখনো সংগ্রাম করে যাচ্ছি। তারেক মাসুদ দর্শকের মনে প্রশ্ন তৈরি করেছেন, দ্বিধায় ফেলেছেন, করেছেন আত্মসচেতন।  যাদুকরের মতো সমাজ বাস্তবতায় নিয়ে গেছেন দর্শকদের। চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছেন জীবনের নির্মম সত্যকে।

 

তারেক মাসুদকে ২০১২ সালে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান একুশে পদক প্রদান করা হয়।

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৬ ডিসেম্বর ২০১৬/রুহুল/শান্ত

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়