ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

নাইট ওয়াচ এবং ছবির রাজ্যে || শান্তা মারিয়া

শান্তা মারিয়া || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:২৭, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
নাইট ওয়াচ এবং ছবির রাজ্যে || শান্তা মারিয়া

(লক্ষ্মণরেখার বাইরে: ২য় পর্ব)

দেয়ালজোড়া একটি বিশাল পেইন্টিং। প্রায় চারশ’ বছর আগের আঁকা। তবু আলোছায়ার খেলা দেখে মন ভরে যায়। এই ছবিটির সামনে দাঁড়িয়ে চোখের জল ফেলছে এক নারী। ঘটনা কী? কেনই বা একটি পুরনো পেইন্টিংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে কান্নাকাটি? বলাবাহুল্য মেয়েটি আমি। পেইন্টিংটির নাম ‘নাইট ওয়াচ’। শিল্পী রেমব্রান্ট ভ্যান রিন।

১৬৪২ সালে আঁকা এই ছবিটি আমি দেখছিলাম ২০০৭ সালে আমস্টারডামের রিকস মিউজিয়ামে। কান্নার বিষয়টি বুঝাতে হলে অবশ্য একটু পেছনে তাকাতে হবে। আমার বাবার সংগ্রহে শিল্পকলা বিষয়ক একাধিক বই ছিল। তার মধ্যে একটি হলো, পাশ্চাত্য চিত্রশিল্পের ইতিহাস। সেই বড় মোটা বইটি ছোটবেলায় আমি খুব আগ্রহ নিয়ে পড়তাম। সেখানেই পড়েছিলাম পাশ্চাত্য চিত্রশিল্পের ইতিহাসে ডাচ শিল্পীদের গৌরবময় ভূমিকার কথা। অনেক বড় বড় শিল্পীর জন্ম হয়েছে হল্যান্ডে, যাদের মধ্যে আছেন ভ্যানগঘ, রেমব্রান্টের মতো ভুবনজয়ীরা। রেমব্রান্টের নাইট ওয়াচ ছবিটির বর্ণনাও বইটিতে ছিল। আরও ছিল এই ছবির ইতিহাস।

নাইট ওয়াচকে বলা হয় ডাচ স্বর্ণযুগের সবচেয়ে বিখ্যাত ছবি। এই ছবিটিতে শিল্পী আলোছায়ার যে ব্যবহার করেছেন তা এককথায় অপূর্ব। ছবিটির আকৃতিও একটা আলোচিত বিষয়। ছবিটি ৩৬৩ গুণ ৪৩৭ সেন্টিমিটার (১১.৯১ ফুট গুণ ১৪.৩৪ ফুট) আকৃতির। বিশাল এই ছবিটি অন্য কোনো ছবির সঙ্গে না রেখে আলাদা একটি রুমে রাখা হয়েছে। কত বছর ধরে এই ছবির কথা শুনছি। কত রকম বর্ণনা পড়েছি ছবিটির। আর আজ আমি এই বিখ্যাত ছবিটির সামনে দাঁড়িয়ে আছি। কোনোদিন ভাবতে পারিনি নিজের চোখে মূল ছবিটি দেখতে পাবো। আবেগে তাই কান্না এসে যাওয়াটা ছিল অতি সাধারণ বিষয়। তাছাড়া চিরদিনই আমি একটু বোকাটে ধরনের আবেগপ্রবণ মানুষ। নাইট ওয়াচ দেখার সঙ্গে সঙ্গে যেন মনে ফিরে এসেছিল আমার কিশোরবেলা আর বাবার কাছে চিত্রশিল্পের গল্প শোনার স্মৃতি। আহা, বাবা যদি এখানে আসতে পারতেন।

 


রিকস মিউজিয়াম বিষয়ে আগেই আমার কিছুটা পড়া ছিল। জানতাম আমস্টারডামে গেলে এই মিউজিয়াম না দেখে ফেরা ঠিক হবে না। অক্সফ্যাম নভিবের কারেন কামেরাথ এবং তার বস (অসাধারণ স্মিতহাসির অধিকারী এই নারীর নাম আমি হঠাৎ করে ভুলে গেছি। কিছুতেই মনে করতে পারছি না) যখন আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন আমস্টারডামে আমি বিশেষ করে কী দেখতে চাই, তখন আমি এই মিউজিয়ামটির নাম বললাম। যদিও আমার উচ্চারণে তাদের বিষয়টি বোঝাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। ইংরেজি বানানটি হলো RIJKS. আমি তাই বলেছি রিজকস। পরে তাদের কাছে শুনলাম ডাচ উচ্চারণে হবে রিকস।

রিকস মিউজিয়াম হলো ডাচ ন্যাশনাল মিউজিয়াম।  বিশাল একটি প্রাসাদে এর অবস্থান। এই প্রাসাদটি তৈরি হয়েছিল ১৮৮৫ সালে। এটি হল্যান্ডের সবচেয়ে বড় মিউজিয়াম। দশ বছর রিনোভেশন কাজের পর ২০১৩ সালের ১৩ এপ্রিল রানী বিয়েট্রিক্স এটি নতুনভাবে উদ্বোধন করেন। তখন সংগ্রহশালায় আরও অনেক কিছু যোগ করা হয়। আমি যখন সেখানে যাই তখনও এর সংগ্রহে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে যাই। রিনোভেশনের কাজ তখনও চলছিল। শিল্পকলা ও ইতিহাসের বিপুল প্রদর্শন সামগ্রীর জন্য রিকসের মূল খ্যাতি।

এখানে রয়েছে রেমব্রান্ট, ফ্রান্স হালস এবং জোহানেস ভারমিরের মতো কিংবদন্তি শিল্পীদের মাস্টারপিস চিত্রকর্ম। এই মিউজিয়ামে ডাচ স্বর্ণযুগের শিল্পীদের ২ হাজারের বেশি শিল্পকর্ম রয়েছে। জোহানেস ভারমিরের দ্য মিল্কমেইড (১৬৫৭-৫৮), ফ্রান্স হালস এর পোট্রেইট অফ এ ইয়াং কাপল (১৬২২),  ফ্রান্স হালস ও পিটার কোদের দ্য মিয়াগ্রে কোম্পানি (১৬৩৩-৩৭) ছবিগুলো দেখে মুগ্ধ হতে হয়। রেমব্রান্টের নাইট ওয়াচ তো আছেই, আরও আছে দ্য জুইশ ব্রাইড (১৬৬৭), জেরেমিয়াহ ল্যামেনটিং দ্য ডেসস্ট্রাকশন অফ জেরুজালেম (১৬৩০)।

এই দুটি ছবি বাইবেলের ঘটনা অনুসারে আঁকা। মিথোলজির উৎসাহী পাঠক হিসেবে তাই ছবি দুটি আমাকে আবিষ্ট করেছিল। জ্যান আসেলিনের দ্য থ্রেটেনড সোয়ান (১৬৫০) ছবিটিও ছিল মুগ্ধকর। একটি ভয়চকিত রাজহংসের ছবি মানবিক হয়ে উঠেছে শিল্পীর কুশলতায়। আরও একটি ছবি এখনও চোখে লেগে আছে। সেটি হলো সেলিনি ও অ্যান্ডিমিয়নের। গ্রিক মিথোলজির এই কাহিনীটি এমনিতেই আমার খুব প্রিয়। যারা ভুলে গেছেন তাদের জন্য সংক্ষেপে মনে করিয়ে দিচ্ছি। চন্দ্রদেবী সেলিনি ভালোবাসতেন মর্ত্যমানব এন্ডিমিয়নকে।  দেবরাজ জিউসের কাছে প্রেমের অমরত্ব প্রার্থনা করেন দেবী। জিউস তখন চিরদিনের জন্য সুখনিদ্রায় আবিষ্ট করে দেন যুবক অ্যান্ডিমিয়নকে। অ্যান্ডিমিয়ন ঘুমিয়ে থাকেন। প্রতিরাতে সেলিনি তাকে জাগিয়ে তুলে ভালোবাসায় মগ্ন হন। তারপর আবার তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখেন। এই কাহিনী যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছিল মধ্যযুগের সেই ছবিটিতে।

 


আমি যখন রিকস মিউজিয়ামে যাই তখন সেখানে ভ্যান গঘ প্রদর্শনী চলছিল। ফলে এক ঢিলে দুই পাখি মারার কাজটা হয়ে যায়।  ক্যারেন আমাকে বলেছিল, হয় রিকস মিউজিয়াম নয়তো কাছাকাছি অবস্থিত ভ্যান গঘ মিউজিয়াম দেখাতে নিয়ে যাবে। একদিনে দুটিতে যাওয়া যাবে না। ইমপ্রেশনিস্ট যুগের প্রিয় শিল্পী ভ্যান গঘের শিল্পকর্ম দেখার ইচ্ছা তো ছিলই। তবু আমি রিকসকেই বেছে নেই। তো, সেখানে ভ্যান গঘ প্রদর্শনী চলায় ফাও হিসেবে ভ্যান গঘের বিখ্যাত শিল্পকর্মগুলোও দেখা হয়ে যায়। ভাবছেন এটা কাকতালীয়? মোটেই নয়। আমি জাতে সাংবাদিক। খবরাখবর রেখেই রিকসের পক্ষে ভোট দিয়েছিলাম।

রিকস মিউজিয়ামে শুধু শিল্পকর্ম নয় ডাচ ইতিহাসের অসাধারণ সব নিদর্শনও ছিল বৈকি। ডাচ বণিকদের ব্যবহৃত অস্ত্র, পোশাক, ডাচ রাজারানীদের অলংকার, তাদের তৈজসপত্র, আসবাব, পোশাক আশাক, দরবারী চালচলনের উপযোগী জিনিসপত্র সবকিছুই নজর কেড়ে নেয়, মন ভরিয়ে দেয়।

রিকস মিইজিয়ামে আমরা কাটাই দুই ঘণ্টা। মাত্র দুই ঘণ্টায় এই বিশাল জাদুঘরের অনেক কিছুই দেখা বাকি রয়ে যায়। আফশোস হয়, আহা সারাদিনটা যদি এখানে কাটাতে পারতাম। কিন্তু উপায় নেই বন্ধু।

সেদিন আমরা ছিলাম ক্যারেন, তার বস, পার্থ, আমি এবং ক্যারেনের এক বছরের মেয়ে লাইলা। পাঁচজনে মিলে বেরিয়ে এলাম সেই প্রাসাদ থেকে। দুপুরের মিষ্টি রোদ তখন উষ্ণতা ছড়িয়ে দিয়েছে আমস্টারডাম শহরের বুকে। সেই রোদ সঙ্গী করে এগিয়ে চললাম নতুন গন্তব্যে। (চলবে)

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭/তারা 

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়