ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

সাজেকে ভিন্ন রকমের একুশে ফেব্রুয়ারি

ফিরোজ আলম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৩৩, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সাজেকে ভিন্ন রকমের একুশে ফেব্রুয়ারি

রুইলুই জুনিয়র স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের তৈরি অস্থায়ী শহীদ মিনার

|| ফিরোজ আলম ||

সাজেক বর্তমানে ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে খুব আকর্ষণীয় নাম। রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলায় অবস্থিত ৭০২ বর্গমাইল আয়তনের সাজেক হলো বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইউনিয়ন।

সাজেকের উত্তরে ভারতের ত্রিপুরা, দক্ষিণে রাঙামাটির লংগদু, পূর্বে ভারতের মিজোরাম, পশ্চিমে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা। যদিও সাজেক রাঙামাটি জেলায় অবস্থিত তবুও খাগড়াছড়ি দিয়ে এর যাতায়াত সহজ।

সাজেকের পর্যটন মূলত রুইলুই পাড়াকেন্দ্রীক। রুইলুই পাড়ার রাস্তাটি বেশ সুন্দর। রাস্তাসহ ফুটপাতগুলো বেশ পরিচ্ছন্ন। চেকপোস্ট পেরিয়ে প্রথমেই পড়বে সেনাবাহিনী পরিচালিত ‘সাজেক রিসোর্ট’। এটিই মূলত এখানকার আধুনিক রিসোর্ট। আরেকটি আধুনিক রিসোর্ট আছে ‘রুন্ময়’, যেটি পর্যটন এলাকার একেবারে শেষ প্রান্তে।

সাজেক রিসোর্ট থেকে একটু এগোলেই অনেকগুলো ছোট কটেজ, কিছু রেস্টুরেন্ট ও দোকানপাটের মাঝে একটি ছোট স্কুল। নাম ‘রুইলুই জুনিয়র স্কুল’। গতকাল ২০শে ফেব্রুয়ারি সাজেক এসে স্কুলটি দেখেই কিছুটা আগ্রহ হয়েছিল। আগ্রহটা আরো বেড়ে গেল যখন দেখলাম কিছু কিশোর-তরুণ মিলে বাঁশ দিয়ে সুন্দর অস্থায়ী শহীদ মিনার বানাচ্ছে। এক তরুণ তাদের কাজের তদারকি করছে। এই তরুণটিই স্কুলের প্রধান শিক্ষক। কাছে গিয়ে কথা বললে পরদিন সকালে অনুষ্ঠানে আসার আমন্ত্রণ জানালেন।



আজ সকালে স্কুলে গেলে প্রধান শিক্ষক ববীন্দ্র লাল ত্রিপুরা স্বাগত জানালেন। ছোট স্কুলটি যতটা সম্ভব সাজানো হয়েছে। সারিবদ্ধভাবে ছেলেমেয়েরা দাঁড়িয়ে আছে। সবার হাতে বিভিন্ন রকমের পাহাড়ি ফুল। স্কুলের মোট চারজন শিক্ষক রয়েছেন। এদের একজন নারী। সবাই মিলে দাঁড়িয়ে প্রথমে ভাষা আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিলেন। এরপর সুশৃঙ্খলভাবে একে একে সব ছাত্রছাত্রী শহীদ বেদিতে ফুল দিল। বেদির কাছাকাছি কেউ জুতো পায়ে হাঁটছিল না। পুষ্পস্তবক দেওয়ার সময় ছেলেমেয়েদের যে শ্রদ্ধাবোধ দেখেছি তেমন আজকাল অনেক বাংলাভাষী মানুষের মাঝেও দেখি না। এরপর ভাষা শহীদদের সম্মানে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।

এবার জাতীয় সংগীত গাওয়ার পালা। এই স্কুলে মূলত তিন জাতির ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করে। ত্রিপুরা, চাকমা ও লুসাই। জাতীয় সংগীত গাওয়ার সময় এদের সঙ্গে যোগ হলো কিছু বাঙালি পর্যটক। সবাই যখন এক সঙ্গে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গাওয়া শুরু করল তখন এক অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্যের অবতারণা হলো। আমরা ভিন্ন ভিন্ন জাতির মানুষ হলেও আমাদের দেশ তো এক। ভিন্ন ধর্ম-বর্ণের মানুষ হলেও আমরা একই মায়ের সন্তান। গান গাইছিলাম আর শিহরণে গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর গর্বে।


স্কুলের প্রধান শিক্ষক ববীন্দ্র লাল ত্রিপুরা


অনুষ্ঠান শেষে প্রধান শিক্ষক ববীন্দ্র লাল ত্রিপুরা অফিস কক্ষে নিয়ে বসালেন। চারদিকে বইয়ের আলমারি ঘেরা ঘরটিতে বসে অতিথিপরায়ণ এই তরুণ তার স্কুলের গল্প বলতে লাগলেন। স্কুলটিতে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ দান করা হয়। স্কুলের ধারণক্ষমতা প্রতি ক্লাসে ১৮ জন করে ৫৪ জন হলেও বর্তমানে মোট ৯৪ জন ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা করছে। ২০১৪ সালে ১৮ জন, ২০১৫ সালে ২০ জন আর ২০১৬ সালে ১৪ জন পরীক্ষার্থী এই স্কুল থেকে জেএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে প্রতিবারই শতভাগ পাশের গৌরব অর্জন করে।



বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এর ৩৯ ব্যাটেলিয়নের মরিশ্যা জোন এই স্কুল প্রতিষ্ঠা করে। ২০১৩ সালের ৩১ শে ডিসেম্বর এটি উদ্বোধন করা হয়। এর সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে আরো পাঁচটি বেসরকারি এবং চারটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। রুইলুই জুনিয়র স্কুলের যাবতীয় ব্যয় বহন করছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ।  স্কুলটি প্রতিষ্ঠার আগে এই এলাকার ছেলেমেয়েরা ১৮ কিলোমিটার দূরের মাছালং হাই স্কুলে অথবা ৩৪ কিলোমিটার দূরের বাঘাইছড়ি হাই স্কুলে যেত। রুইলুই জুনিয়র স্কুল প্রতিষ্ঠার ফলে পাহাড়ি এই জনপদের শিক্ষা গ্রহণের আগ্রহ বেড়েছে। যদিও জেএসসি পাসের পর ছেলেমেয়েদের এখনো মাছালং অথবা বাঘাইছড়ি পাঠাতে হয় এখানকার পাহাড়িদের। তবুও পশ্চাৎপদ এই জনগোষ্ঠীর জন্য শিক্ষার যেটুকু আলোর ব্যবস্থা করেছে সেজন্য বিজিবি তথা বাংলাদেশ সরকার ধন্যবাদ পেতেই পারেন। সরকার এই অঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে তার চেয়ে বড় হয়ে উঠছে শিক্ষাক্ষেত্রের নীরব বিপ্লব।

 

ছবি: লেখক


 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭/সাইফুল/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়