ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

গলে নির্ঘুম এক রাত

ইয়াসিন হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৫১, ২৮ মার্চ ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
গলে নির্ঘুম এক রাত

ইয়াসিন হাসান, কলম্বো থেকে : ‘ব্যাংকক কখনো ঘুমায় না’-যারা ব্যাংকক বেড়িয়ে আসেন কিংবা কাজ শেষ করে ফিরে আসেন তারা সবাই এ কথাটাই বলেন। ব্যাংকক সম্পর্কে এমন কথা আমি প্রচুর মানুষের কাছে শুনেছি। ইচ্ছে আছে ব্যাংকক যাবার কিন্তু কেন যেন মনে হচ্ছে সেই শখ অনেকটাই পূরণ হয়েছে শ্রীলঙ্কার গলে এসে।

গল, সমুদ্রে পাওয়া এক শহর। পুরো শহরটাই তিন দিক থেকে ঘিরে রেখেছে ভারত মহাসাগর। পুরো চিত্রটাই মনে হলো চিত্রকরদের সবচেয়ে আরাধ্য ক্যানভাস! শিল্পীর তুলিতে রাঙানো এক সময়ের শিল্পকর্ম এখন ফুটে উঠেছে বাস্তবে। এমনিতে গল শহর খুব তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে। রাত আটটার পর এখানে খুব কম মানুষকে রাস্তায় পাওয়া যায়। তবে সেদিন রাতে গল জেগে ছিল পুরোরাত। নির্ঘুম রাত কাটায় ওয়ানাটুনা বিচ।

গত ৯ মার্চ, বৃহস্পতিবার। বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার প্রথম টেস্টের তৃতীয় দিনের খেলা কভার করে আমার হোটেল হ্যাপি বানানায় ফিরলাম রাত ৯টায়। হোটেলে ফ্রেশ হয়ে বের হলাম খেতে। আমার হোটেলের রেস্টুরেন্ট বিচ ঘেঁষে নির্মিত। রেস্টুরেন্ট দিয়ে বিচে যেতেই নিরাপত্তাকর্মী হাসি মুখে বলল, ‘১২টার আগে কিন্তু ফিরে আইসেন। আজ ডিসকো নাইট।’ এর আগে দুই একদিন তার সঙ্গে কথা হওয়াতে খাতির হয়েছে বেশ। ভিতরের কথা জানতে চাইলাম। বলল, ‘আজ সপ্তাহের বিশেষ দিন। এখানে প্রচুর পরিমাণে পর্যটক আসে। সারারাত পার্টি হয়। দিনের আলো ফুটলে ঠান্ডা হয় শহর।’ তার কথা বিশ্বাস জন্মাল, আগ্রহ হলো রাত উপভোগ করার। নতুন অভিজ্ঞতা পাবার।



গলে বাঙালি এক বাবুর্চি বকুলের সঙ্গে পরিচয় হয় আমার সফরসঙ্গী উৎসব সরকারের মাধ্যমে। পরিচিত হওয়ার পর রাজশাহীর ছেলে বকুল তার রেস্টুরেন্টে আমাদের একদিন খেতে বলেছিল। আমরাও রাজী হয়েছিলাম। ভাগ্যক্রমে সেই রাতেই বকুলের হোটেলে খেতে যাই আমরা। বকুলও খুশি। বিচের কোল ঘেঁষে তার রেস্টুরেন্ট কোরমারান বিচ ক্লাব। প্রচুর দামী রেস্টুরেন্ট তা মেন্যু দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। উঠে যে চলে আসব তারও উপায় নেই। এতে বকুলের অপমান! আমি অর্ডার করলাম মিক্সড ফ্রাইড ন্যুডলস, আমার সাথের চারজন খেলেন নাসি গোরাং। নাসি গোরাং হচ্ছে ইন্দোনেশিয়ান ভাতের চালের সঙ্গে দুই ধরণের সি ফুড, চিংড়ি মাছ, দুটি ডিম, চিকেন, সবজি ও পিনাট সস দিয়ে বানানো এক খাবার। আর আমার মিক্সড ফ্রাইড ন্যুডলসের সঙ্গে সি ফুড আর চিকেন। দাম ৮০০ শ্রীলঙ্কান রূপি। মজাদার খাবার। মুখে দেওয়ার পরই আমার পাশে থাকা রবিউল ইসলাম রবির প্রতিক্রিয়া, ‘পয়সা উসুল।’ দুই বড় ভাই শামীম চৌধুরী ও মহিউদ্দিন পলাশ খাচ্ছিলেন গোগ্রাসে। শামীম চৌধুরী বরাবরের মতো বললেন, ‘আমি তো আগেই বলছিলাম খাওয়াটা এত মজার হবে।’ তিনি আবার নিচে থাকা বিড়াল ছানাকেও কিছু খাবার দিলেন। বললেন, ‘মায়া লাগে ওদের জন্য।’ বিল মিটিয়ে বাড়তি ৩০০ রূপি টিপস দিয়ে খেয়ে বের হবার পর গেলাম আমাদের হোটেলের বিচে।

সেখানে তখন উৎসব। কী নেই সেখানে! পুরো রেস্টুরেন্ট আলোকসজ্জায় সজ্জিত। রেস্টুরেন্টের বাইরে মানে বিচের উপরে ছাতির নিচে ৫০-৬০টি চেয়ার পাতা। প্রতিটি প্রায় ভরা। একটু পাশে চোখ নিতেই দেখলাম টেবিলের ওপর সারি সারি সামুদ্রিক মাছ। লবস্টার, কাঁকড়া, অক্টোপাস, কোরাল, টুনা, কালমারি, কেলাস, জেলি ফিস, হাঙর, কামিলে, কচ্ছপসহ আরও অনেক মাছ। এগুলো বারবিকিউ করে বিক্রি করা হয়। চাইলে কারি ও থাই স্টাইলেও বানিয়ে দিতে পারবে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসা পর্যটকদের পছন্দের খাবার এগুলো। সাথে চিকেন, বিফ, মাটন ও শূকরের গোশত। মুখরোচক এ খাবারগুলো খেতে খরচ করতে হবে ৩ থেকে ১০ হাজার ‍রূপি।



ঘুরতে ঘুরতে কানে বাজল মিউজিক। হ্যাপি বানানার রেস্টুরেন্টে তখন হাজারো আলোর ঝলকানি। আমরা ওখানে স্থায়ী বাসিন্দা বলে আমাদের এন্ট্রি ফি লাগল না। নয়ত খরচ হতো আরও ২ হাজার রূপি। ভিতরে ঢুকতেই অন্য এক ‘রাজ্যের’ সঙ্গে নতুন করে পরিচিত হলো। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা মানুষগুলো সেখানে নিজের মতো করে নেচে-গেয়ে উপভোগ করছে। পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে দেখলাম ডিজে গান বাজাচ্ছে। দেশে কয়েকজন ডিজের সঙ্গে পরিচয় আছে বলে তার সঙ্গে গিয়েও কথা বললাম। আমাদের দেশের ডিজে রাহাত, প্রিন্সদের পরিচয় দিতে শ্রীলঙ্কান ডিজে সুমিত্র ডিসুজা জানাল তাদের সে চেনে। একই গোত্রের মানুষ হওয়ায় আমাদের মধ্যে সখ্য গড়ে উঠতে সময় নেয়নি। তার স্টেজ থেকে ড্যান্স ফ্লোর দেখতে আরও রঙিন মনে হচ্ছিল।

ড্যান্স ফ্লোরে নারী-পুরুষের অনুপাত ৪০:৬০। তারা নিজেদের মতো করে নাচছে, গাইছে। ডিজে আবার তাদের নাচাচ্ছে। খুব যে শরীর দোলাচ্ছে তা না, মৃদু শরীর দোলানোর সাথে মিউজিক উপভোগ করে তারা। অনেকে সার্কেল করে দল হয়ে নাচছে। পাশেই বার। হাতের ড্রিংস শেষ করে রিফিল করছে খুব সহজে। উপভোগের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। কেউ কাউকে বিরক্ত করছে না। নিজেদের মতো করে উপভোগের মন্ত্র সেখানে।



রাত গভীর থেকে গভীর হয়। গলে পর্যটকদের আনাগোনা আরও বাড়তে থাকে। গল জেগে থাকে আরও রাত পর্যন্ত। পূর্ণিমা রাত ছিল না। পূর্ণিমা রাত হলে গলের সৌন্দর্য্য্ আরও বেড়ে যেত। নির্ঘুম রাত কাটিয়ে গলের আরেক সৌন্দর্য দেখে আমি মুগ্ধ।



রাইজিংবিডি/ ডাম্বুলা (শ্রীলঙ্কা)/২৮ মার্চ ২০১৭/ইয়াসিন/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়