ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

হাতির অভয়ারণ্যে একদিন

ইয়াসিন হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:০৪, ৩১ মার্চ ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
হাতির অভয়ারণ্যে একদিন

মা-ওয়ে নদীতে গোসলে যাচ্ছে হাতি

ইয়াসিন হাসান, ডাম্বুলা থেকে : কানে বাজছে কোনো সুর। শরীর দুলিয়ে দুলিয়ে আপন মনে নাচছে রাজা। কিছুক্ষণ নয়, দীর্ঘক্ষণ। পুরো শরীর হেলিয়ে-দুলিয়ে নাচছে রাজা। তাতে বিমোহিত পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা পযর্টকরা।

কখনো হাততালি আবার কখনো ওয়াও কিংবা বিউটিফুল বলছেন তারা। দূর থেকে নিজের প্রশংসা শুনে বেজায় খুশি রাজা! আনন্দে আত্মহারা হয়ে আবারও নাচছে রাজা।

‘পিনাওয়ালা এলিফ্যান্ট অরফ্যানেজ’ একমাত্র জন্মান্ধ হাতির নাম রাজা। তার নিসঙ্গ ভুবনে সে রাজা। চোখে দেখতে পারে না বাড়তি কোনো কিছু করার সুযোগ নেই। নিজের অক্ষমতা ঢাকতে তাই নেচে-নেচে আনন্দ দেন দুর্ভাগা রাজা! শুধু রাজা নয় পিনাওয়ালা এ হাতির আশ্রমে অনেক হাতি আছে যাদের রয়েছে অক্ষমতা। কিন্তু প্রত্যেকেই কিছু না কিছু করতে পারদর্শী। সুস্থ, স্বাভাবিক, মা-হারা শাবকদের অনাথ আশ্রম শ্রীলঙ্কার ‘পিনাওয়ালা এলিফ্যান্ট অরফ্যানেজ।’



জন্মান্ধ হাতি রাজা নাচছে আপন সুরে

৭০ দশকের শুরুর দিকে যখন শ্রীলঙ্কার অবকাঠামোর উন্নতি হওয়া শুরু করল তখন প্রচুর পরিমাণে বন জঙ্গল উচ্ছেদ করে স্থানীয় সরকার। প্রায়শই হাতি ও মানুষের মধ্যে হতো লড়াই। এতে প্রচুর মানুষের যেমন জীবন গেছে ঠিক তেমনি হাতিরও  প্রাণ গেছে। সমস্যা সমাধানের জন্য স্থায়ী উদ্যোগ নিল শ্রীলঙ্কা। সিদ্ধান্ত হল ঐতিহ্যের হাতিকে সংরক্ষণ করতে হবে, করতে হবে পরিচর্যা। সেই উদ্যোগে ১৯৭৫ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ২৫ একর জায়গা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় পিনাওয়ালা এলিফ্যান্ট অরফ্যানেজ।  

মাত্র পাঁচটি হাতি দিয়ে এ আশ্রমের যাত্রা শুরু। পাঁচটি হাতি ছিল নিলা, কুমারি, বিজয়া, কাদিরা ও ম্যাথলি। শাবক হয়ে আশ্রমে পা রাখলে আজ তারা পরিণত, অনেক বয়স্ক। এ মুহূর্তে পিনাওয়ালায় হাতির সংখ্যা ৯৪টি। এখানে এদের শুধু আশ্রয় দেওয়া হয়নি সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে।

মা-ওয়ে নদীতে গোসল করছে হাতির দল

৯৪ হাতির মধ্যে ম্যাথলি ও কুমারি এখন সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। বলা যেতে পারে ‘হার্ট অব দ্য অরফ্যানেজ।’ কেন তাও বলছি। যে পাঁচটি হাতি নিয়ে পিনাওয়ালার যাত্রা শুরু তার মধ্যে শুধু বেঁচে আছে ম্যাথলি ও কুমারি।

রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকা কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ম্যাথলি এখানে সবথেকে বেশি জনপ্রিয়। কারণ কোনো বিপদ আপদ হলে ম্যাথলি সবার আগে এগিয়ে যায়, সবথেকে বেশি অভিজ্ঞ। এ কারণে অন্যান্য হাতি তাকে বেশ সম্মান করে।

স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, ‘এখানকার সব হাতিদের আগলে রাখে ম্যাথলি।’ পাঁচ শাবকের জননী ম্যাথলি পুরো আশ্রম নিরাপত্তা দিয়ে থাকেন বলে মনে করেন কর্মকর্তারা।

আশ্রমের সব থেকে বয়স্ক হাতির নাম কুমারি। যে পাঁচটি হাতি দিয়ে আশ্রমের যাত্রা শুরু হয়েছিল সেই পাঁচ হাতির মধ্যে কুমারি অন্যতম। কর্মকর্তাদের ধারণা, কুমারির বয়স ৬৬ এর কাছাকাছি হবে। প্রাকৃতিক উপায় পাঁচটি শাবকের জন্ম দিয়েছেন কুমারি। আশ্রমে প্রথম শাবক প্রসব করেন কুমারি। তার প্রথম শাবকের নাম শুকুমালি। এখন শুকুমালিরও শাবক আছে। নাম অর্জুনা। এখন কুমারির খাওয়া-দাওয়া ছাড়া কোনো কাজ নেই। বয়স বেশি হয়েছে বলে নড়া-চড়াও কম। 

এদের দুজনের বাদে আরেকটি হাতির প্রতি আগ্রহ বেশি। সেই হাতিটির নাম সুমোনা। সুমোনা এ আশ্রমের একমাত্র দান্তাল হাতি। এশিয়া মহাদেশে মাত্র ৫ শতাংশ দান্তাল হাতি আছে। তার মধ্যে সুমোনা অন্যতম। ১৯৯৭ সালের ১৯ মে জঙ্গলের মারাডানকাডাওয়ালা নামক জায়গায় সুমোনাকে পায় স্থানীয়রা। আশ্রমের কর্মকর্তারা সুমোনাকে এখানে নিয়ে আসে। সে সময়ে সুমোনার বয়স ছিল সাড়ে তিন বছর। এরপর দিন যত বেড়েছে সুমোনার প্রতি স্থানীয়দের ভালোবাসা ততই বেড়েছে।




ছোট-বড় হাতির শো-পিছ পাওয়া যাবে স্থানীয় দোকানগুলোতে

আম, তাল, নিম, জামরুলের বাগান হাতিদের আশ্রম। শাবক হাতির যত্নের জন্য রয়েছে আলাদা ব্যবস্থা। এখানকার সবথেকে আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে হাতিদের গোসল দেখা। প্রতিদিন দুবার হাতিদের গোসল করা হয়। দুপুর ২টা থেকে ৩টা এবং সন্ধ্যা ৬টা থেকে ৭টা। মাহুতের সঙ্গে হাতির পিছনে পিনাওয়ালার সকল হাতি একসঙ্গে গোসলে আসে মা-ওয়ে নদীতে। আগে শুধু মা-ওয়ের নদীর পানিতে গোসল করে হাতি। এখন কৃত্রিম  উপায়ে পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে। শাবকগুলো পানিতে নেমেই  মজা করে। শরীর ভেজাতে পানিতে গড়াগড়ি করে তারা।

১৯৮৫ সাল থেকে কৃত্রিমভাবে হাতি প্রজনন শুরু করে আশ্রম কর্তৃপক্ষ। কৃত্রিম উপায়ে এখন পর্যন্ত ১৫টি শাবকের জন্ম দিতে পেরেছে আশ্রম কর্তৃপক্ষ। সামনে হাতিদের নিয়ে আরো বড় পরিকল্পনা তাদের। শ্রীলঙ্কার পুরনো রাজধানী ক্যান্ডি এবং কলম্বোর ঠিক মাঝামাঝিতে পিনাওয়ালা। চোখ ধাঁধানো কয়েকটি হোটেল ও রিসোর্ট এখানে গড়ে উঠেছে। প্রচুর পরিমাণে বিদেশি পর্যটক এখানে ভিড় করে প্রতিনিয়ত।

‘পিনাওয়ালা এলিফ্যান্ট অরফ্যানেজ’ এ ঢুকতে সার্কভুক্ত দেশগুলো পর্যটক বিশেষ সুবিধা পায়। সার্কভুক্ত দেশের বাইরের পর্যটকদের আশ্রমে ঢুকতে ২৫০০ রূপি খরচ করতে হয়। সার্কভুক্ত দেশের পর্যটক ৭০০ রূপিতে আশ্রমে ঢুকতে পারে। হাতির এ আশ্রমকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে ব্যবসা-বাণিজ্য। আশে-পাশে রাস্তাগুলোতে খাবারের দোকান ও শ্রীলঙ্কার স্থানীয় তৈরি বিভিন্ন জিনিসপত্র বিক্রি করা হয়। হাতির মল দিয়ে বানানো খাতা, কাগজ, নোট বই, পেপার এবং রঙিন পোস্টারের একাধিক দোকান রয়েছে।

ভ্রমণপিপাসুদের তীর্থস্থান ‘পিনাওয়ালা এলিফ্যান্ট অরফ্যানেজ’। শ্রীলঙ্কায় এলে অসাধারণ সুন্দর স্থানটিতে আসতে ভুলবেন না। এখানে এলে হাতির প্রতি শুধু ভালোবাসা জন্মাবে না জায়গাটার প্রেমেও পড়বেন।



রাইজিংবিডি/ডাম্বুলা (শ্রীলঙ্কা)/৩১ মার্চ ২০১৭/ইয়াসিন/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়