ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

চর থেকে চিরসবুজের ডাকে

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:১০, ১৯ এপ্রিল ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
চর থেকে চিরসবুজের ডাকে

(সূচনা পর্ব)

ফেরদৌস জামান : ভ্রমণের ক্ষেত্রে পারতোপক্ষে বরাবরই বৈচিত্র্য রেখে চলার চেষ্টা করি। যদিও ইদানিং পাহাড় প্রাধান্য পাচ্ছে। এই যেমন দশ-বারো বছর আগে ঝোঁকটা ছিল প্রত্যন্ত চরাঞ্চল আর সমতলের ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জাতি-গোষ্ঠীপ্রধান এলকা ঘুরে দেখা। বান্দরবান থেকে ঘুরে এসেছি সেই অক্টোবর, ২০১৫ সালে! এরপর ওদিকটায় যাওয়ার রাস্তা বন্ধই হয়ে গেল। সেবার আমরা পাহাড়ে থাকাকালে দুই বাঙালি অভিযাত্রীসহ তিন কি চারজন অপহৃত হন। মূলত তারপর থেকেই প্রায় দেড় বছরের মতো পার্বত্য এলাকার গভীরে বাঙালি বিশেষ করে পর্যটক বা অভিযাত্রীদের প্রবেশের ক্ষেত্রে জারি হলো এক অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা। সম্প্রতি তা কিছুটা শিথিল করা হয়েছে। কিন্তু পোহাতে হচ্ছে নানান সব অপ্রীতিকর আনুষ্ঠানিকতার বিড়ম্বনা, যেন বাংলাদেশ নয় বরং ভিন্ন কোনো দেশে বেড়াতে গিয়েছি।

ওদিকে রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে রাঙ্গামাটি এবং খাগড়াছড়ি জেলার গভীরে যাওয়ার কথা তো ভাবাই যায় না। কার্যত অভিযাত্রীদের কাছে ওই দুটি জেলা বান্দরবানের তুলনায় আজও দুর্গম। বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলার কেবল মাত্র একটি গন্তব্য খোলা থাকার সুবাদে গত বছর মে মাসে একবার একটি সংক্ষিপ্ত ভ্রমণ করে এসেছিলাম। বাস্তবতার কথা চিন্তা করে এবার আমাদের লক্ষ্য দেশের দক্ষিণে ভোলা চরফ্যাশন উপজেলার বিচ্ছিন্ন এক চর। ঢাকা সদরঘাট গিয়ে লঞ্চ-স্টীমারের খোঁজ নিয়ে আসা হলো। কিন্তু একটি বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারলাম না। বরিশাল থেকে নৌ-পথে উপকূল ধরে কীভাবে চট্টগ্রাম যাওয়া যায়। অল্প দিন আগেও নাকি এই পথে যাতায়াতের ব্যবস্থা ছিল। ভেবেছিলাম, চরফ্যাশন থেকে এদিক-সেদিক হয়ে পৌঁছে যাব বরিশাল। সেখান থেকে চট্টগ্রাম। তথ্য বিভ্রাটের কারণে পরিকল্পনা আর এগিয়ে নেয়া সম্ভব হলো না। অতঃপর কেবল চরফ্যাশন যাওয়ার ব্যাপারেই স্থির থাকলাম। কিন্তু হাতে তো সময় নয় দিন, বাকি দিনগুলি কোথায় যাওয়া যেতে পারে? কেন জানি শেষাবধি তার কোনো সমাধানই খুঁজে পেলাম না। কুলকিনারা না পেয়ে যৎকালে তৎ বিবেচনা নীতি অবলম্বন করে বেরিয়ে পড়লাম।

আগস্টের ১৩ তারিখ ২০১৬ সাল। সদরঘাট গিয়ে দোতলা এক লঞ্চের কেবিনে জায়গা করে নিলাম। তার আগে সুজিতের জন্য একটি লাইফ জ্যাকেট কিনতে হলো। উন্নত জ্যাকেট। বিক্রেতার পরামর্শ, একজন যেহেতু সাঁতার জানা সেহেতু আমাদের মতো গড়নের দুইজনের জন্য নাকি একটি জ্যাকেটই যথেষ্ট। নির্দিষ্ট সময়ে ভেঁপু বাজিয়ে লঞ্চ ছেড়ে দিল। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কেবিন। আগস্ট মাসের গরমেও শরীর হিম হয়ে যাওয়ার উপক্রম। ঠান্ডা বাতাস কম-বেশি করার কোনো সুযোগ নেই। শেষে কুলাতে না পেরে কাগজ দিয়ে বাতাস নির্গমনের ফুটো বন্ধ করার এক বিরক্তিকর ব্যর্থ প্রচেষ্টা চললো মাঝ রাত পর্যন্ত। বেগতিক দেখে ব্যাগ থেকে সমস্ত কাপড় বের করে শরীরে চাপাতে বাধ্য হলাম। কিছুক্ষণ পর ঘুম ভেঙ্গে গেল তীব্র গরমে। এসি বন্ধ হয়ে গেছে! সেই যন্ত্র আর চালু করা গেল না। বিচিত্র পরিসেবা বটে! খানিক আগে যুদ্ধ করলাম ঠান্ডা থেকে রক্ষা পেতে আর এখন তার উল্টো। যুদ্ধ শেষ হলো না! এবার রণকৌশলে পরিবর্তন এনে ভরসা হিসেবে বেছে নিতে হলো বারন্দা।

 



রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে পার করে দিলাম রাতের বাকি অংশ। কখনও নদীর মাঝ দিয়ে, কখনও পাশ ধরে এগিয়ে চলছে আমাদের লঞ্চ। আবার নির্দিষ্ট দূরত্ব দিয়ে আসছে-যাচ্ছে দু’একটি লঞ্চ। ঘুটঘুটে অন্ধকার নদীর বুক দিয়ে এমন নৌযান দেখে সাধারণ একটি ভাবনা এসে যায়- আস্ত একটি লোহার টুকরো কি আশ্চর্য রকম পানির উপর দিয়ে ভেসে যাচ্ছে! প্রযুক্তির এত এত উৎকর্ষের যুগে এই ভাবনাটিকে আজ অতি সমান্য ও নগন্য বলা যেতে পারে। কিন্তু আমরা কি ভেবে দেখব না, আজকের পরিপ্রেক্ষিতে যা নগন্য, পূর্বে তা কতটা বিস্ময়কর বিষয় হিসেবে বিবেচিত হতো? মানুষকে কত হাজার-শত বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে এই নগন্য আবিষ্কারটির জন্য! দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকের দিগ্বিজয়ী যোদ্ধা-জাতি মঙ্গলদের দুর্দান্ত উত্থানের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যাবে তারা নিজ দেশ থেকে শুরু করে একের পর এক ভূখণ্ড জয় করতে করতে এগিয়ে গেল পোল্যান্ড হয়ে মধ্য ইউরোপ পর্যন্ত। সুবিস্তৃত সাম্রাজ্যের পতন ঘটল বস্তুগত স্বাভাবিক নিয়মেই। কিন্তু আজকে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় শক্তি-সামর্থ কোনোটারই কমতি ছিল না তাদের। এমনও জানা যায় আজকের উন্নত ইউরোপে বারুদ নামক জিনিসটির প্রবেশ ঘটে তাদেরই হাতে। অথচ, ধ্বংসের নানাবিধ কারণের মধ্যে আজ অন্যতম হিসেবে ধরা দেয় তাদের নৌ-শক্তি না থাকার বিষয়টি।

যাই হোক, সকাল সাতটায় গিয়ে নামলাম চরফ্যাশন উপজেলার লঞ্চঘাটে। নসিমন-করিমন বা ভটভটি চালকদের হাঁক-ডাকে অস্থির ঘাটের পরিবেশ। পারে তো যাত্রীদের টেনে-হিঁচড়ে গাড়িতে তোলে। আধাঘণ্টা থেকে পৌনে এক ঘণ্টায় গিয়ে উপস্থিত হলাম সদরে। পরিচিত মাধ্যম অর্থাৎ যিনি চর ঘুরে দেখাবেন, আমাদের সমস্ত যোগাযোগ তৈরি করে দেবেন, কর্মক্ষেত্রে আসতে তার এক ঘণ্টা লেগে যাবে। কবি ও চিত্রশিল্পী ইমরান ভাইয়ের আসতে যে সময় লাগবে তার মধ্যে আমরা বরং এলাকাটা এক নজর নিজেরাই দেখে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।

দৃষ্টি সীমায় দেখা দিল সেই বিখ্যাত টাওয়ার। পত্রপত্রিকার মাধ্যমে আগেই জেনেছিলাম এখানে মসজিদের একটি টাওয়ার বা মিনার রয়েছে, যাকে দক্ষিণ এশিয়ার সর্বোচ্চ মিনার দাবি করা হচ্ছে। সদরের কেন্দ্রস্থলের মাঝ দিয়ে এগিয়ে যাওয়া পাকা রাস্তাটি বেশ চওড়া। দেশের অন্য কোনো উপজেলা সদরে এত চমৎকার সড়ক আছে বলে জানা নেই। সদরবাসীর ঘুম বেশ আগেই ভেঙ্গেছে। মাত্র দুটি-একটি করে গাড়িঘোড়া চলাচল শুরু করে দিয়েছে। টাওয়ারের মাথা দেখা যাচ্ছে দূর থেকে। পাশেই বাঁধাই করা একটি পুকুর, সাথে একটি পথ আর পথের অপর পাশেই টাওয়ার। জানা গেল টাওয়ারের স্থানীয় একটি নামও আছে। ইস্পাতের কাঠামোয় গড়া স্থাপনাটির চূড়া নীল কাঁচে মোড়ানো। এপাশ-ওপাশ অতঃপর গোড়ালি থেকে পর্যবেক্ষণপূর্বক মনে হলো, নির্মাণের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র প্রতিযোগিতার মানসিকতাই কাজ করেছে, যে কারণে সেখানে নান্দনিকতার প্রবল অভাব। পিঠে বড় ব্যাগ আর গলায় ঝুলানো ক্যামেরা দেখে এগিয়ে এলেন দিনের প্রথম ভিখারী। জানতে চাইলাম তার এলাকায় বিশ্বখ্যাত স্থাপনা, বিষয়টি ভাবতে কেমন লাগে? উত্তরে সে জানাল, ফকিরের আবার ভালো-মন্দ লাগা; তবে এতটুকু বুঝি, ওইটা বানাতে যে পরিমাণ টাকা ব্যয় হয়েছে তা দিয়ে চরফ্যাশনে আমার মতো দরিদ্র সব মানুষের একটা করে ঘর বানিয়ে দেয়া যেত।

 



শুরু হলো টিপটিপ বৃষ্টি। ইমরান ভাইও চলে এসেছেন। অফিসে বসে আলাপচারিতার মাঝে মাঝে তিনি পরবর্তী সম্ভাব্য যোগাযোগগুলিতে ফোন করতে লাগলেন।  খানিক পর বিদায় বলে রওনা হলাম পরবর্তী ঘাটের উদ্দেশ্যে। সে পর্যন্ত সহযাত্রী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিলেন স্থানীয় কলেজ শিক্ষক সাহিত্যানুরাগী আব্দুর রহমান ভাইয়ের সাথে। দেড় ঘণ্টার বাস জার্নি তার সাথে বেশ ভালোই কেটে গেল। তিনি যে এতটা সজ্জন ভাবতে পারিনি। ইমরান ভাইকে বলে রেখেছিলেন, ফেরার পথে তার বাড়িতে আমাদের নিমন্ত্রণ। যদিও সময় না থাকায় নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে পারিনি। ঘাটে আপেক্ষা করতে হলো এক ঘণ্টা। ট্রলার ছেড়ে দেবে দুপুর নাগাদ। একটি দোকানে গিয়ে ডাব খেতে চাইলে দরদাম ঠিক হলে বলল, বসেন, পাশের বাড়ির গাছ থেকে টাটকা ডাবের ব্যবস্থা করছি। চোখ আটকে গেল সামনে পানের ডালির পাশে রাখা একটি বাটির দিকে। একজন এসে বাটি থেকে চামচ দিয়ে তুলে কিছু একটা মুখে দিয়ে বসে পড়লেন। জানতে চাইলে হেসে বললেন, ও কিছু না!

শুনে আমার কৌতূহল আরও বেড়ে গেল। ছবি তোলার জন্য ক্যামেরা বের করলাম। তিনি পত্রিকা দিয়ে বাটি ঢেকে রাখলেন। গ্রামের সহজ-সরল মানুষ, আমার হাতে ক্যামেরা দেখে ভেবেছে বিপদে পড়ে যান কিনা! যদিও পরে দেখলাম, বাটিতে অতি সাধারণ একটি জিনিস। ডাব কাটার পর যে নরম শাঁস বের হয় সেগুলো দিয়ে জিনিসটি তৈরি। সাথে ভাজা শুকনা মরিচের গুড়া, জর্দা জাতীয় আরও কিছু মাখানো। বাটিতে রাখা সেই জিনিস যে যার মতো এসে একটা দুইটা টুকরো মুখে চালান করে দিচ্ছে। তাতে নাকি বেশ নেশা হয়। হুকা, বিড়ি, খৈনি, জর্দা কত কিছুই না খেতে দেখেছি কিন্তু এমন বিচিত্র জিনিস এই প্রথম।

 



বসে আছি, এরমধ্যে ঘাটে ভিড়ল ইলিশের ট্রলার। জেলের দল বরফ সরিয়ে বের করতে থাকল বড় বড় একেকটি ইলিশ! খাঁচি ভরে চালান করা হবে আমাদের মতো সংস্কৃতিবান ও শহুরে বাবুদের জন্য। সারা বছর জেলে সন্তানের মুখে এক টুকরো ইলিশ জুটুক আর না জুটুক আমাদের ইলিশ চাই-ই চাই। ট্রলারে যাত্রী ওঠা শুরু করল। আমরা গিয়ে বসলাম, ছাউনির উপর একেবারে পেছনের উঁচু জায়গাটায়। খাড়ির পর ট্রলার গিয়ে প্রবেশ করল বিপুল জলরাশির মাঝে। তার আগেই টহলরত পুলিশের ট্রলার এসে একে একে দুই তিনটি ট্রলার থামাল। কাগজপত্র ও ইত্যাদি দেখার বাহানায় প্রায় আধাঘণ্টা চললো পুলিশের টালবাহানা। তারপর বিশেষ গুপ্ত কারবারের পর ছেড়ে দিল। মাঝখান থেকে রোদের মাঝে কষ্ট পেতে হরো যাত্রীদের। জলরাশির পর ঐ দূরে নীল রেখা! ক্রমেই যাত্রী বোঝাই ট্রলার গিয়ে রেখাটি ভেদ করে প্রবেশ করল আর একটি খালের মধ্যে। ততোক্ষণে রেখার প্রকৃত রূপ সবুজে সতেজে ম্যানগ্রভ জঙ্গল আমাদের চারপাশ থেকে গ্রাস করে নিয়েছে। ফট ফট শব্দের কারণে ফুরুৎ করে উড়াল দিল পানকৌড়ি আর মাছরাঙ্গা। গহীন জঙ্গলের পর লকলকে ঘাসের পড়তে ঢাকা সুবিশাল চর। ঠিক তার পরেই আবারও ম্যানগ্রভ জঙ্গলের চিকন রেখা। এমন করেই সাজিয়ে উঠেছে আমাদের দেশের উপকূলীয় অঞ্চল। এই চর বা দ্বীপগুলো কেন্দ্র করে কত কিছু করা সম্ভব! সম্ভাবনার দুয়ার খুলে যেতে পারে শুধুমাত্র ইকোটুরিজম উৎসাহিত করার মাধ্যমে। কিন্তু কে ভাবে এসব কথা! কার এত সময় আছে বিচ্ছিন্ন এই মানুষগুলোর কথা ভাবার? উপভোগ করলাম চমৎকার একটি নৌ-ভ্রমণ। ছোট্ট এক ধাক্কায় ট্রলার ভিড়ল গন্তব্যের নড়বড়ে ঘাটে। (চলবে)



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৯ এপ্রিল ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়