ঢাকা     বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৪ ১৪৩১

উ প কূ লে র প থে

সমুদ্র-পাহাড়ের মিলন মেলায় বাড়ছে পর্যটক

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:০৪, ২৪ এপ্রিল ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সমুদ্র-পাহাড়ের মিলন মেলায় বাড়ছে পর্যটক

রফিকুল ইসলাম মন্টু, দরিয়া নগর, কক্সবাজার ঘুরে : সমুদ্র মিলেছে পাহাড়ে। সমুদ্রের নোনাজলের ঢেউ এসে আঁছড়ে পড়ছে পাহাড়ের পাদদেশে। পড়ন্ত বেলায় পশ্চিমে হেলে পড়া সূর্যটা যেন ডাকছে হাতছানি দিয়ে। তেজ কমে যাওয়া সূর্যের স্বর্ণালী আলোকচ্ছটা দীর্ঘ বেলাভূমিতে সোনা ছড়িয়ে রেখেছে।

আবার পাহাড়ের উঁচুতে কাঁশ ফুলের সঙ্গে সূর্যের নিবিড় সখ্যতায় সৃষ্টি হয়েছে চিত্রশিল্পীর এক বিশাল ক্যানভাস। ডানা মেলে ঝাঁকে ঝাঁকে শ্বেতবর্ণ গাঙচিল উড়ে চলে সমুদ্র ঘেঁষা আকাশের নিঃসীম নীলিমায়। পাহাড়ের উঁচু চূড়া থেকে সৈকতের দিকে তাকিয়ে সমুদ্রের আরেক রূপ উপভোগ করার সুযোগ কেবল এখানেই। যেন সমুদ্র আর পাহাড়ের এক অপরূপ মিলমমেলা।

বিশ্বের বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারের অতি নিকটে দরিয়া নগরের সৌন্দর্যের গল্পটা এমনই। প্রকৃতি এখানে আপন সৌন্দর্য বিলিয়েছে দু’হাত ভরে। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত থেকে খানিক দূরে হিমছড়ি কিংবা ইনানী বিচে যাওয়ার আগেই সমুদ্র আর পাহাড়ের মিলনস্থলে এই অপরূপ সৌন্দর্যের স্থান। সৈকত আর পাহাড় তো আছেই, সেই সঙ্গে পাহাড়ের চূড়া থেকে প্রায় ৭০০ ফুট গভীরে একটি প্রাচীন গুহা রয়েছে এখানে। পর্যটকেরা অনায়াসে পাহাড়ের সেই ভিন্নরূপটা উপভোগ করতে পারেন। পাহাড়ের চূড়ায় ‘কবি টং’-এ বসে একই সঙ্গে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার সুযোগ রয়েছে।

সরেজমিন ঘুরে পর্যটকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, দরিয়া নগরের সৌন্দর্য তাদেরকে আকৃষ্ট করে। তাইতো বারবার তারা ছুটে আসতে চান এখানে। একাধিক পর্যটক বললেন, পাহাড়ের নির্জনতায় ভয় কাটিয়ে এখানে গড়ে তোলা হয়েছে আকর্ষনীয় পর্যটন স্পট। একইসঙ্গে পাহাড় আর সমুদ্রের বেলাভূমিতে পা ফেলে যেন এক ভিন্ন আনন্দ উপভোগের সুযোগ রয়েছে এখানে। তবে দরিয়া নগরে পাহাড় ঘেরা পর্যটনকে আরও আকর্ষণীয় করার সুযোগ রয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সে উদ্যোগ নিতে পারে।

কক্সবাজার শহর থেকে মেরিন ড্রাইভ সড়ক ধরে গেলে মাত্র আট কিলোমিটার পূর্বদিকে দরিয়া নগর পর্যটন কেন্দ্র। পশ্চিমে বিশাল বঙ্গোপসাগর, পূর্বে উঁচু পাহাড়। মাঝখানে কক্সবাজার-টেকনাফ পিচঢালা সড়ক। এই পথ ধরে এগিয়ে গেলে নজরে পড়বে সবুজ-শ্যামলে ভরা একটি গ্রাম। এর নাম বড়ছেড়া। এই গ্রামের ৫৩ হেক্টর জমির ওপরে উঁচু-নিচু পাঁচটি পাহাড়ের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে পর্যটনের এই বিনোদন কেন্দ্রটি। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে আসা পর্যটকদের ভ্রমণ আনন্দ আরও খানিক বাড়িয়ে দিতে পারে এই দরিয়া নগর।

পর্যটক আর উদ্যোক্তাদের মুখ থেকেই জানা গেল এখানকার নিরাপত্তার কথা। পাহাড়ের জঙ্গলে সরু গলিপথ দিয়ে হেঁটে যেতে শরীরে ভয়ের কাঁপন জাগলেও এখানে নিরাপত্তাহীন নন পর্যটকেরা। টুরিষ্ট পুলিশের পাহারা যেমন এখানে রয়েছে, তেমনি পথ দেখাতে রয়েছে একদল নারী গাইড। পর্যটকদের ভ্রমণ আনন্দ আরও উপভোগ্য করে তুলতে গাইড কর্মীরা সার্বক্ষণিক এখানে থাকেন।

দরিয়া নগরে গাইড কর্মীদের একজন সুইটি আকতার। সে তিন বছর ধরে এখানে আছে। সপ্তম শ্রেণি পাস করে এবার অস্টম শ্রেণিতে উঠেছে। বাড়ি পাশের গ্রামে। এখানে কাজ করে পর্যটকদের কাছ থেকে বকশিশ হিসাবে কিছু পায়। এ দিয়ে সংসার চালানোর পাশাপাশি নিজের লেখাপড়াও চালিয়ে নিতে হচ্ছে।

সুইটি জানায়, এখানে পর্যটকেরা সম্পূর্ন নিরাপদ। পাহাড় ঘুরে দেখার জন্য রয়েছে সরু পথ। মাঝে মাঝে বিশ্রামের জন্য তৈরি করা হয়েছে ছোট ছোট ছনের ঘর। পাহাড়ের চূড়ায় স্থাপিত ‘কবি টং’-এ একইসঙ্গে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখা যায়। এখানে নব দম্পতির হানিমুনের ব্যবস্থা রয়েছে। তাঁবু টাঙিয়ে তাদের হানিমুনের সব ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। এজন্য এক রাতে নেওয়া হয় মাত্র আড়াই হাজার টাকা। অনেক কবি এখানে এসে কবিতা লেখেন। নির্জনে কিছু সময় কাটাতে অনেকেই এখন দরিয়া নগরের কথাটাই আগে বিবেচনায় নেন।

দরিয়া নগরের প্রাচীন এক ইতিহাস রয়েছে। কথিত আছে, আরব দেশ থেকে বণিক সওদাগররা জাহাজে করে বাণিজ্যে আসতেন । তখন আরবের ব্যবসায়ীরা পশ্চিম থেকে পূর্বে আসতেন বানিজ্যে। সেখানকার ব্যবসায়ীরা রণতরী আর বাণিজ্য তরী সাজিয়ে আসতেন পূর্বের বিভিন্ন দেশে। একবার বাণিজ্য তরী নিয়ে বঙ্গোপসাগরের এই উপকূলে এসেছিলেন আরবের এক নাবিক শাহেনশাহ। মাঝ নদীতে হঠাৎ ডুবতে বসে তার তরী। একে একে ডুবে যায় শাহেনশাহর তরীর সব মাঝি-মাল্লা, হারিয়ে যায় সব পণ্য।

সবাই সমুদ্রে হারিয়ে গেলেও অনেক কষ্টে সাঁতরে কূলে উঠতে সক্ষম হন শাহেনশাহ। তীরে উঠে সমুদ্রের নোনাজলে বেঁচে থাকাই কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। তিনি বের হন মিষ্টি পানির সন্ধানে। একইসঙ্গে পানির খোঁজ আর বেঁচে থাকার লড়াই। এক পর্যায়ে তিনি দরিয়া নগরের এই পাহাড়ের গুহার সন্ধান পান। মিষ্টি পানির কাছে এসে প্রাণ ফিরে পান শাহেনশাহ। কিন্তু সুখ যেন কপালে সইলো না। যেই মিষ্টি পানি পান করতে যাবেন অমনি হামলে পড়লো বন্য প্রাণীর দল। তারপর এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে লুকিয়ে দিন কাটে তার। অবশেষে আশ্রয় নেন এক গুহায়।

এরপরের ঘটনা আরেকটু ভিন্ন। গুহায় অবস্থানকালে এক ঠান্ডা হিমেল রাতে নেমে আসে একদল পরী। পূর্ণিমা রাতে শাহেনশাহর সঙ্গে দেখা হয় পরীদের দলনেতা হিমপরীর। শুরু হয় দু’জনের প্রেম-ভালোবাসা। হিমপরী তাকে নিয়ে পূর্ণিমা রাতে চলে যান পরীর দেশে। শাহেনশাহ যে গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলেন, পরে সেই গুহাটির নাম হয় ‘শাহেনশাহ গুহা’। এই গুহাটি রয়েছে পর্যটনকেন্দ্র দরিয়া নগরে।

কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের নিকটে অল্প সময়ের ব্যবধানে খুব দ্রুতই জনপ্রিয় উঠেছে পর্যটন কেন্দ্র দরিয়া নগর। কক্সবাজার-টেকনাফ পিচঢালা সড়কের পাশে দরিয়া নগর পর্যটন স্পটের বিশাল হাঙ্গর আকৃতির গেট। গেটে হাঙ্গরের মুখের ভেতর দিয়ে প্রবেশ করে লেজের অংশ দিয়ে বের হতে হয়। দূর থেকে দেখে মনে হয় এটা সমুদ্রের জীবন্ত হাঙর। প্রবেশ পথে এক বিশাল আকৃতির কৃত্রিম অজগর যেন পর্যটকদেরই অভ্যর্থনায় ব্যস্ত। ভেতরে বিভিন্নভাবে সাজিয়ে রাখা হয়েছে জিরাফ, কুমির, কচ্ছপসহ আরও কিছু প্রতিকৃতি। গাছেরও যে প্রাণ আছে, তারই প্রতীকী স্থাপিত পার্কের এক কোনে। এতে দেখানো হয়েছে গাছ কাটছে করাতকল শ্রমিক। আর গাছ তার সন্তানকে বুকে জড়িয়ে কাঁদছে।

দরিয়া নগরে বন বিভাগের ৫৩ হেক্টর জমি ইজারা নিয়ে ২০০৪ সালে এই থিম পার্ক স্থাপনের উদ্যোগ নেয় কক্সবাজার সি বিচ ক্লাব লিমিটেড। কক্সবাজারের সৌন্দর্য্য আরও খানিক বাড়িয়ে তুলতেই তাদের এই উদ্যোগ। তবে নানামূখী সীমাবদ্ধতা ক্লাবের মূল পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি করছে। প্রতি বছর সরকারের কাছ থেকে এই পাহাড়ি জমি ইজারা নিতে হয়। এরফলে বড় কোন বিনিয়োগ করতে পারছে না ক্লাব।

দরিয়া নগর থিম পার্কের প্রধান উদ্যোক্তা ও কক্সবাজার সি বিচ ক্লাবের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এম সায়েম ডালিম বলেন, পর্যটকদের প্রকৃতির খুব কাছাকাছি নিয়ে আসাই এই উদ্যোগের অন্যতম লক্ষ্য। বন বিভাগের কাছ থেকে জমি ইজারা নিয়ে নিজস্ব বিনিয়োগের মাধ্যমে এটি পরিচালিত হচ্ছে। বন বিভাগকে এজন্য প্রায় ১৭ লাখ টাকা দিতে হয়। ২০০৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত সরকার এই পার্ক থেকে রাজস্ব পেয়েছে কোটি টাকার ওপরে।

তিনি বলেন, বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় হলেও এখানকার সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি কিংবা অবকাঠামো নির্মাণে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর বন বিভাগের কোন উদ্যোগ নেই। সরকার সুদৃষ্টি দিলে এখানকার সৌন্দর্য্য আরও বাড়তে পারে। পর্যটকরাও পেতে পারেন বাড়তি আনন্দ।

উদ্যোক্তারা জানান, পর্যটকদের রাত্রিকালীন অবস্থানের জন্য দরিয়া নগরে আছে বিভিন্ন রকম কটেজ। দরিয়া নগরের সমুদ্র সৈকতটি কক্সবাজারের মতো পর্যটকে পরিপূর্ণ থাকে না বলে সাচ্ছন্দ্যে বেড়ানোর জন্য অত্যন্ত উপযোগী। মাঝেমধ্যে এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে যাতায়াতের জন্য বাঁশের সাঁকো পাড়ি দিতে হয়। পাহাড়ের নিচে শাহেনশাহ গুহায় প্রবেশের সময় একটু সতর্ক থাকতে হয়। পিচ্ছিল পাথরের ওপর দিয়ে হাঁটা-চলায় পা পিছলে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কাও কম নয়। বর্ষার সময় সাপের উপদ্রব থাকলেও গ্রীষ্ম ও শীতকালে গুহায় প্রবেশ একেবারেই নিরাপদ। গুহার নিচে দাঁড়িয়ে ভ্রমণের আরেক ভিন্ন আনন্দ উপভোগ করা যায়।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, দিনে দিনে দরিয়া নগরের গুরুত্ব বাড়ছে। বছরে কোন কোন সময় উৎসবে মেতে ওঠে দরিয়া নগর। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের কবিতা উৎসবই হয়। স্থানীয়রা প্রতিবছর শীতকালে আয়োজন করেন উৎসবের। পর্যটকরাও দলবল নিয়ে এসে আয়োজন করেন নানা রকম অনুষ্ঠান।

কক্সবাজার শহর থেকে লোকাল বাসে দরিয়া নগরে যেতে বাসে ভাড়া মাত্র ২০টাকা। বাস ছাড়াও স্কুটার কিংবা ইজিবাইকে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। ৩০ টাকার টিকেট নিয়ে দরিয়া নগরে দিনভর দরিয়া নগরে অবস্থান করা যায়।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ এপ্রিল ২০১৭/ রফিকুল ইসলাম মন্টু/শাহ মতিন টিপু

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়