ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

চর থেকে চিরসবুজের ডাকে || ২য় কিস্তি

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:০১, ২৬ এপ্রিল ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
চর থেকে চিরসবুজের ডাকে || ২য় কিস্তি

ফেরদৌস জামান: আমরা জেনেছি চরটি চর ফ্যাশন থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন একটি জায়গা। সেখানে থাকার ব্যবস্থা বলতে রয়েছে কেবল স্থানীয়দের ঘরবাড়ি। ট্রলার ঘাট থেকে পঁচিশ মিনিট হেঁটে গেলেই বাজার। এই পথটুকুর দুইপাশজুড়ে দুটি-চারটি বাড়ি। পরিচয় হলো একজন ইউপি সদস্যের সাথে। তার ভাবনা আর ঢাকার কিছু পর্যটন সচেতন পরিচিতজনের ভাবনার মাঝে তেমন প্রভেদ খুঁজে পেলাম না। এরা মনে করে চরটিকে কেন্দ্র করে ইদানিং পর্যটন সম্ভাবনা তৈরি হওয়ায় রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট বিভাগের উদ্যোগে একটি মোটেল জাতীয় কিছু নির্মাণ করা হলে মন্দ হয় না। এটা আসলে তাদের দু’চার জনের নয় বরং আমাদের সমাজ মানসিকতারই ভাষ্য। এমন চিন্তাকে অপরিনামদর্শী ছাড়া অন্য কিছু বলার সুযোগ নেই।

প্রত্যন্ত এলাকায় বিলাসবহুল কায়কারবারের যৌক্তিক হেতুটা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। উন্নয়ন বলতে আমরা আজও ওই দালান-কোঠা বানানোকেই বুঝি। এই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে আরও কত কাল যে প্রতীক্ষা করতে হবে কে জানে? বাসাবাড়ির মত পাহাড়-পর্বত আর দ্বীপ-জঙ্গলে গিয়েও আমাদের নরম বিছানা আর কমোডের প্রয়োজন পড়ে। আমাদের এখানকার পর্যটন মানে শুধুমাত্র উপভোগ করা। ‘অনুভব’ নামক যে একটি শব্দ আছে তা আজও আমরা অনুধাবন করতে শিখলাম না! যার কারণে এদেশের পর্যটনের সমস্ত আয়োজনের মাঝে শিল্প মানের এক ভয়াবহ ঘাটতি বিরাজমান।

কাঙ্ক্ষিত বাড়িতে গিয়ে দেখি দরজায় তালা ঝুলছে। ইমরান ভাইকে ফোন দিলে জানালেন, হঠাৎ জরুরি কাজ পরে যাওয়ায় তিনি উপজেলা সদরে এসেছেন, বিকেলের মধ্যে ফেরত যাবেন। বাড়িতে অন্য কেউ থাকে না তাই অপেক্ষা করতে হবে। রোদ পড়েছে বেশ, জনমানব শূন্য বাজারে কেবলমাত্র একটি দোকান খোলা। জিজ্ঞেস করায় দোকানদার বললেন, চরাঞ্চলের বাজার এমনই। দুপুর বেলা দোকান খোলা থাকা তো দূরের কথা একটি মানুষও থাকে না। বিস্কুট, চানাচুর, খাতা-কলম প্রভৃতি জিনিসে ঠাসা তার দোকান। ঠিক তার মাঝখানে বসা দোকানদার বেল্লাল শরিফ। ফোনে কথা বলেন, পান খান এবং ঘুম পেলে কয়েকটা খাতা টেনে মাথার নিচে দিয়ে সংক্ষিপ্ত ঘুম দেন। কেউ এসে ডাক দিলে চাহিদা মতো জিনিস দিয়ে দেন। আবার শুয়ে পড়েন, নয়তো এক কাপ রং চা পান করে মুখে পান পুরে দিয়ে গল্প শুরু করেন।


শরিফ চাচার বয়স ষাট। তিনি রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির স্থানীয় কর্মী। স্বাস্থ্যে বেশ সতেজ হলেও এরই মধ্যে মুখের সমস্ত দাঁত খুইয়েছেন। দাঁত না থাকলে কি হবে পানের রসের স্বাদ ছাড়তে পারেননি। স্টিলের চকচকে চিকন পাইপের এক মুখ বন্ধ করে দেয়া। আট-নয় ইঞ্চি লম্বা পাইপের মধ্যে পান-সুপারি, চুন-জর্দা ও অন্যান্য মশলাপাতি পুরে দেন, তারপর খুন্তির মত এক মাথা চ্যাপ্টা একটি রড দিয়ে ছেঁচতে থাকেন। এই কর্মটির মাঝে রয়েছে চমৎকার ছন্দ ও লয়। কেবল দুই হাত নয়, বরং সমস্ত শরীরে খেলে যায় ছন্দের দোলা। অনেক আগ্রহ নিয়ে দেখছি বুঝতে পেরে ফোকলা মুখে ফিক করে হেসে দিলেন। এবার হাতের তালুয় পাইপ উপুর করে ধরতেই খয়েরি রঙের ঝরঝরে চুর্ণ পান এসে পড়ল। যেগুলো পাইপে আটকে ছিল সেগুলো ঠকাস ঠকাস দুই বাড়ি দিয়ে পাইপের ভেতর থেকে বের করে মুখে পুরলেন। তারপর সরঞ্জামাদি এক পাশে সরিয়ে রেখে মনোযোগী হলেন বেচাকেনায়।

অনেকক্ষণ বসে আছি শরিফ চাচার দোকানে। আমরা দুজন ছাড়া বাজারে এখন পর্যন্ত কোন মানুষ নেই। চা-বিস্কুট খাওয়া হয়ে গেছে দুই পর্ব। আমাদের উদ্দেশ্যের বৃত্তান্ত জানার পর সেসব নিয়েই কথা চললো। তিনি বাজারের এক  খাবার দোকানদারের সাথে ফোনে কথা বলে আমাদের দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করলেন। খেয়ে এসে দেখি তিনি তখনও একা বসে পান চিবুচ্ছেন। বিষয়টি বেশ ব্যতিক্রম, বাজারে এখনও মানুষ নেই! খানিক পর পা টিপে টিপে টুপি-জুব্বা পরা এক লোকের ঐতিহাসিক প্রবেশ ঘটল নীরব বাজার প্রাঙ্গণে। অতি সাধারণ ব্যাপারটি আমাদের নিকট বিস্ময়কর বা ঐতিহাসিক হিসেবেই প্রতীয়মান হলো। দোকানের নিকট এসে পাঁচশ টাকার একটি নোট বাড়িয়ে ধরতে ধরতে তিনি বললেন, ‘শরিফ আমি বড় গরিব’।

নতুন আর একটা কিছু দেখতে যাচ্ছি ভেবে আমরা সজাগ হয়ে বসলাম। রক্ষণশীল পোশাক পরিহিত হলেও রসিকতায় তিনিও কম গেলেন না। তারপর বললেন, টাকাটা ভেঙ্গে দাও না ভাই! এবার কাঁধে ব্যাগ ঝুলানো এক মাঝবয়সী নারী এসে দোকানের সামনে পাতা বেঞ্চটায় এক পা তুলে বসলেন। হাঁটু উঠে গেল থুতনির কাছাকাছি, তাতে কনুই রেখে হাতটা সামনের দিকে ঝুলিয়ে বললেন, পান দেন।

এই শুরু হলো গল্প! ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ অধিক ধর্মভিরু হয়। সুতরাং ঘরের বাইরে বোরখা ছাড়া নারীর দেখা পাওয়া দুষ্কর। সেই পরিস্থিতিতে বাজারের দোকানে বসে বেঞ্চে পা তুলে পান চিবুনো আর বেগানা পুরুষদের সাথে কথা বলার বিষয়টি রীতিমত ব্যতিক্রম ঘটনা। ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নারী কথা কম বলছেন কিন্তু আলাপচারিতায় পূর্ণাঙ্গ মনোনিবেশ তার রয়েছে। প্রায়োজনের জায়গাগুলিতে কেবল দু’এক কথা বলছেন। দেখে মনে হলো কোনো এনজিওকর্মী হয়ে থাকবেন। আমরা যারা রাজধানী ঢাকার বাসিন্দা তারা শিল্প-সাহিত্য তথা প্রগতিশীল চর্চার পীঠস্থান শাহবাগ ও তার আশপাশে এমন নারী দেখে অভ্যস্থ, যা আমাদের নিকট চোখ সওয়া একটি ব্যাপার। কিন্তু প্রত্যন্ত উপকূলীয় এলাকার ছোট্ট এক বাজারে এমন দৃশ্য কৌতূহলদ্দীপক বটে।

জানি না আমি যা লিখছি তা আদৌ পাঠযোগ্য হয়ে উঠছে কি না? তবে ভ্রমণকাহিনী বলতে আমি বুঝি অভিজ্ঞতার বিবরণ, যার মধ্যে থাকা চাই রং, সর তথা নান্দনিকতা এবং সম্ভব হলে সব শেষে একটি বার্তার সংযোজন। তবে বার্তা দিতেই হবে এমন সব সময় নয়। সে জন্য অর্জিত অভিজ্ঞতার মাঝে অন্যান্য বর্ণনার সাথে উক্ত স্থানের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার নেতিবাচক, ইতিবাচক দিকগুলিও থাকা জরুরি। কারণ এ সমস্ত উপাদান নিয়েই আসলে দেখার সৌন্দর্য। কেবল দেখলাম, খেলাম আর মুগ্ধ হয়ে দুই চরণ কবিতা লিখলাম এবং নিজেকে আলেকজান্ডার ভেবে নিয়ে ফিরে এলাম, এই যদি হয় ভ্রমণ তবে আমি তাকে এক কথায় অসাড় জিনিস বলতে দ্বিধা বোধ করব না।

শরিফ চাচার দোকানে বসে থাকতে থাকতে কোমরে ব্যথা ধরে গেল। বাড়ির মালিক এলে একটি ঘরে থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। পেছনে বিস্তীর্ণ মাঠ। ধান কেটে ঘরে তোলা হয়েছে কিছু দিন আগেই। বৃষ্টির পানি পেয়ে গোড়া থেকে গজিয়েছে অজস্র নতুন কুঁড়ি। তাতেই যেন সমস্ত মাঠজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে লকলকে সবুজের এক মসৃণ চাদর। বাজারে প্রবেশের বাম পাশে একটি শান বাঁধানো পুকুর। সুজিতকে লাইফ জ্যাকেট পরিয়ে বেশ খানিকক্ষণ ভেসে থাকার প্রশিক্ষণ চললো। সাঁতার না জানা অত বড় একটি মানুষের সে আনন্দ কে দেখে! তার শিশুসুলভ আচরণে খ্যান্ত দিতে বলে এবার উঠে পড়লাম। সন্ধ্যা নামার কিছুক্ষণ আগে চেনা বাজারটি অচেনা মনে হলো- মানুষে ভরে গেছে। পেয়াজু, গুলগুলা আর কটকটি ভাজার সুগন্ধে  ম ম করছে বাজার। শালশা ও বুটিকা বিক্রেতার ছন্দ কথন শোনা যাচ্ছে বাজারের অপর প্রান্ত থেকেই। দোকানে দোকানে জমেছে খোশ গল্পের আড্ডা। সে দিক  থেকে শরিফ চাচার দোকান এগিয়ে। বাজারের পরে ছোট্ট খাল। তার উপর সরু সেতু পেরিয়ে বাজারের আর এক অংশ। রস থেকে চুবিয়ে তোলা গরম জিলাপী দেখে চোখ জুরিয়ে গেল। পাশেই বিদ্যালয়ের মাঠ, মাঠের প্রান্তে দ্বিতল বিদ্যালয় ভবন ও দুর্যোগ কেন্দ্র (সাইক্লোন সেন্টার)। অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থী ফরহাদ নিজ আগ্রহেই ঘুরে দেখাল চারপাশটা।

আগন্তুক হিসেবে বাজারের অনেক মানুষের কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হলাম। দু’একজন এগিয়ে এসে ঘুরেফিরে একটি প্রশ্নই জানতে চাইলেন- আপনাদের ঠিকানা কোথায় হলো? কোথাও দাঁড়ালে বা বসলে স্থানীয়রা খাতির, সমীহ দুটোই করছেন। শরিফ চাচার মাধ্যমে রাতের খাবারের ব্যবস্থা হলো। আড়তে এসে কেবলই নেমেছে এক খাচি তাজা বেলে মাছ। আধা কেজি কিনে পাঠানো হলো দোকানটিতে। রান্না করে রাখবে এবং খাবার পরিবেশিত হবে রাত নয়টায়। বাড়ির মালিক ঘরে নিয়ে আমাদের পেয়ারা দিয়ে আপ্যায়ন করলেন এবং ভ্রমণ পরিকল্পনা শুনে বললেন, আজ অনেক ক্লান্ত। অতএব আগামীকাল রাতে এক সাথে খাবার খেতে খেতে কথা বলা যাবে। এরই মধ্যে তৈরি আমাদের পরের দিনের ভ্রমণ পরিকল্পনা। সকালে ঘুম থেকে উঠে রওনা দেব চরের প্রধান আকর্ষণের উদ্দেশ্যে। স্থানীয় প্রায় সকলের মুখে ওই একই জায়গার কথা- দেখা যাক কী আছে জায়গাটিতে! (চলবে)




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৬ এপ্রিল ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়