ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

ওকলাহমায় এক টুকরো বাংলাদেশ

শান্তা মারিয়া || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:১১, ২৯ এপ্রিল ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ওকলাহমায় এক টুকরো বাংলাদেশ

আমি ও নীলা আপা

(লক্ষ্মণ রেখার বাইরে পর্ব ১৩)

শান্তা মারিয়া : আমার চাচাতো বোন নীলুফার সাফিয়া। প্রায় কুড়ি বছর পর তার সঙ্গে দেখা হলো। না, কোনো পারিবারিক অনুষ্ঠানে নয়। দেখা হলো ওকলাহমায়। ২০০৬ সাল। তখন ফেসবুকের এমন রমরমা নেই। তাই কাজিনরা কে কোথায় আছেন তা অনেক সময় খোঁজ রাখা হয়ে উঠত না। লাল আপা (গীতিআরা সাফিয়া চৌধুরী) আর নীলা আপা(নীলুফার সাফিয়া) আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়। লাল আপা ঢাকায় থাকেন তাই তার সঙ্গে পারিবারিক অনুষ্ঠানে মাঝে মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ হয়। কিন্তু নীলা আপা আমেরিকায় আছেন ১৯৭০ সাল থেকে। তার সঙ্গে যোগাযোগ খুবই কম, সময়ের স্বাভাবিক নিয়মেই।

আমি ওকলাহমায় যাচ্ছি শুনে তার সহোদর আমার বড় চাচাতো ভাই আবু রুশদ রুশো কিছু উপহার সামগ্রী নিয়ে এলেন নীলা আপাকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। সেই সূত্র ধরেই ম্যারিয়টস ইন এ আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন নীলা আপা। অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁর সঙ্গে শাহনাজ মুন্নী ও অন্যদের বেশ ভাব জমে উঠল। আমাদের কয়েকজনকে তিনি একদিন ডিনারে নিমন্ত্রণ করলেন। তিনি নিজে যদিও আমেরিকান খাবারেই বেশি অভ্যস্ত কিন্তু আমাদের রুচির কথা চিন্তা করে তিনি মোগলাই খাবার পাওয়া যায় এমন একটি রেস্টুরেন্ট পছন্দ করলেন। ওকলাহমায় তার ভারতীয় ও বাংলাদেশি বন্ধুদের এই রেস্টুরেন্টেই আপ্যায়ন করেন। এখানে তিনি বেশ পরিচিত একজন ভ্যালুড কাস্টমার।

রেস্টুরেন্টটির নাম মিশাল। পাকিস্তানি আর বাঙালির যৌথ মালিকানায় চলছে এই রেস্টুরেন্ট। শুধু চলছে বললে ভুল হবে, রীতিমতো দৌড়াচ্ছে। আর এই চলার মূল কৃতিত্ব হলো রেস্টুরেন্টের প্রধান শেফের। এইখানেই হলো আসল গল্প।

স্থানীয় আমেরিকানরা মিশালের মোগলাই ডিশের দারুণ ভক্ত। এদের শিস কাবাব(চিরদিনের চেনা শিক কাবাবকে শিস কাবাব বলায় আমি এখনও অভ্যস্ত হতে পারিনি), চিকেন টিক্কা, বিফ ও ল্যাম্ব রোস্ট, বিরিয়ানি, কিমা পুরি, নান, নারগিসি কোফতা ইত্যাদি ডিশের নাকি তুলনা হয় না।

রেস্টুরেন্টটা বেশ বড়। সুন্দর করে সাজানো। জাফরিকরা কাঠের আসবাবে সাজানো। পাকিস্তানি রেস্টুরেন্ট শুনে প্রথমেই একটা বিরক্তির ভাব জেগেছিল। কারণ, রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে পাকিস্তান শব্দটির প্রতি আমার দারুণ অ্যালার্জি আছে। পাকিস্তানি কোনো রেস্টুরেন্টে বা দোকানে আমি কখনও যাই না। কিন্তু বিদেশে অনেক কিছুই মেনে চলা যায় না। তাছাড়া এটার তো আবার অর্ধেক মালিকানা বাঙালির।

খেতে বসে বিরক্তি কিন্তু কমছিল। রান্নাটা সত্যিই ভালো। দেখলাম নীলা আপা এখানে বেশ আদরণীয়। তাকে ভালোই খাতির করা হচ্ছিল। এক ফাঁকে আমি মন্তব্য করলাম যে, খাবারটা বেশ ভালো। নীলা আপা বললেন, বাঙালি ছেলে ভালো রান্না করছে। বাঙালি শেফ? আমার প্রশ্ন। এবার শুনলাম তার গল্প। বুয়েট থেকে পাশ করা প্রকৌশলী তিনি। আমেরিকায় এসে এখানে শেফের কাজ করছেন অনেক বছর ধরে। কিন্তু দেশে আত্মীয় পরিচিতদের সে কথা বলেননি। শেফের চাকরিতে তার রোজগার প্রচুর। পাশ্চাত্যে শেফ একটি ভালো প্রফেশন। এদের দারুণ কদর। বেতনও অনেক অনেক বেশি। হলে কি হবে, বাঙালির মনমানসিকতা আছে না? যদি কেউ জানে তিনি আসলে প্রকৌশলীর পেশা ত্যাগ করে শেফ হয়েছেন তাহলে নাকি তার মান সম্মান কিছুই থাকবে না। ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হলো। প্রথমে সামনে আসতে চাননি। পরে নীলা আপার অনুরোধে আমাদের সামনে এলেন। যে রাঁধে সে যেমন চুলও বাঁধে, তেমনি যে রাঁধে সে দেখতেও সুদর্শন হতে পারে অনায়াসেই। ভদ্রলোক দেখতে সত্যিই ভালো। বিশেষভাবে অনুরোধ করলেন যেন তার নাম ও পরিচয় কোনোভাবেই ফাঁস না হয়।

 


ওকলাহমায় বাঙালি আড্ডা

 

নীলা আপা নরম্যান শহরেই থাকেন। এখানে বেশ কয়েকটি বাঙালি পরিবার রয়েছে। বেশিরভাগই ওকলাহমা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে নানাভাবে যুক্ত। কেউ শিক্ষক, কেউ ছাত্র বা গবেষক।

এরা সকলে মিলে একদিন এক পার্টির আয়োজন করলেন আমাদের জন্য। আমাদের মধ্যে শাহনাজ মুন্নী সবচেয়ে পরিচিত মুখ। ওখানে তার বেশ অনেক ভক্তও রয়েছে। অনেকেই তার সঙ্গে ছবি তুলতে ব্যস্ত।

পার্টির খাবারের আয়োজন করেছেন সব বাঙালিরা মিলে। বিরিয়ানি, মাংসের রেজালা, মুরগির রোস্ট, পুডিং এমনকি বোরহানিও বাদ পড়েনি। রান্নাও করেছেন সবাই মিলেই।

এখানে বেশ কয়েকজন আছেন যাদের স্ত্রী আমেরিকান। আজকের দিনটিতে তারাও বেশ শাড়ি পরে এসেছেন। বাংলাতেই গল্প হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর বাংলা গানও শুরু হলো। গান, গল্প, আড্ডার ফাঁকে এক শ্যামবর্ণা সুন্দরী আমাকে বললেন, চিনতে পারছ? আমি চেষ্টা করেও মনে করতে পারছিলাম না, উনি সূত্র ধরিয়ে দিলেন। ওর ছোটবোন আমার খালাতো বোনের সঙ্গে আমাদের ইউনিভারসিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের এক ক্লাসে পড়তো। ও যদিও অন্য স্কুলের ছাত্রী ছিল কিন্তু বোনকে আনতে নাকি প্রায়ই ইউল্যাবে যেত। তখন আমাকেও দেখেছে। ক্ষীণ সূত্র সন্দেহ নেই। ঢাকায় হলে এমন ক্ষীণ সূত্রের উল্লেখ করাই অবান্তর বলে মনে হতো। কিন্তু এখানে, এই বিদেশে ওর আমাকে খুব আপন বলেই মনে হচ্ছে। বিশেষ করে, ও এখানে এসেছে স্বামীর হাত ধরে। অন্যদিকে আমি হলাম ওর ছোটবোনের পরিচিত। সে হিসেবে ওর বাবার বাড়ির লোক। আমার মনে হলো মেয়েটি এই ক্ষীণ পরিচয়ের সূত্র ধরে যেন স্পর্শ করতে চাচ্ছে নিজের হারিয়ে যাওয়া কিশোরবেলাকে।

গান, গল্প চলছে। এই আড্ডার অধিকাংশই আমার অপরিচিত। ঢাকায় হলে এমন বোরিং পার্টিতে আমি এক ঘণ্টার বেশি কোনোক্রমেই থাকতাম না। এখানে কিন্তু মোটেই বোরিং বলে মনে হচ্ছে না। কারণ, এই আড্ডায় আছে দেশের স্পর্শ। আমরা না হয় এসেছি মাত্র কিছুদিনের জন্য। কিন্তু ওরা আছেন অনেকদিন ধরে। আছেন জন্মভূমি থেকে, মাতৃভাষার ছোঁয়া থেকে অনেক দূরে। ওদের কাছে আমরা নিয়ে এসেছি বাংলাদেশের শ্যামল মাটির সৌরভ। ওদেরকে যেমন আমার কাছে আপন বলে মনে হচ্ছে তেমনি তারাও আমাদের মাঝে আপনজনেরই ছায়া দেখতে পাচ্ছেন। আমাদের কাছে ওরা আর ওদের কাছে আমরাই তো  একটুকরো বাংলাদেশ।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৯ এপ্রিল ২০১৭/রফিক

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ