চর থেকে চিরসবুজের ডাকে || ৩য় কিস্তি
ফেরদৌস জামান : আজকের লক্ষ্য জঙ্গলে বানর দেখা। যাওয়ার জন্য বেশ খানিকটা পথ হাঁটতে হবে; বাজার পেরিয়ে সোজা ডাকাতিয়া ঘাট পর্যন্ত। নামটির সাথে কেমন এক ধরনের ভীতি জড়িত। আগের রাতে একাধিক মানুষের নিকট জানতে চেয়েছি, এমন নামের প্রেক্ষাপট কী হতে পারে? কেউ উত্তর দিতে পারেনি। কি আর হবে, কোন একদিন হয়তো ডাকাত দল নৌকার যাত্রীদের সর্বস্ব লুটে নিল, তারপর থেকেই জায়গাটি এমন নামে পরিচিতি লাভ করল। ঘাটের নাম ‘ডাকাতিয়া’ কেন হলো সে পটভূমি না জানতে পারলেও অজান্তেই মনের মধ্যে শচীন দেব বর্মনের সেই গানটির কয়েক লাইন উঁকি দিল-বাঁশি শুনে আর কাজ নেই সে যে ডাকাতিয়া বাঁশি।
সতেজ রোদে রাঙ্গিয়ে উঠল কুকরিমুকরির সবুজ শ্যামল প্রকৃতি। পথ দেখিয়ে নেয়ার তেমন কোনো মানুষ নেই। মৎসজীবী প্রধান এলাকা। সুতরাং যে যার গন্তব্যে বেরিয়ে পরেছে অনেক আগেই। দু’একজন যা-ও মিলছে তাদের প্রথম পশ্ন, আপনাদের ঠিকানা কোথায় হলো? প্রশ্নটির সাথে এমনভাবে সখ্য গড়ে উঠল যে কাউকে দেখলেই মনে মনে উত্তর দেবার জন্য প্রস্তুত হয়ে নিচ্ছি। এবং বারবার এই সরল সোজা জিজ্ঞাসার উত্তর দিতে ভালোই লাগছে।
কাউকে না পেয়ে পথ স্বয়ং নিজেই পথ প্রদর্শকের দায়িত্বে অবতীর্ণ হয়েছে। ওর উপর ভরসা করে এগিয়ে চলছি আর সাথে শচীন দেব বর্মনের ডাকাতিয়া বাঁশি তো রয়েছেই।
আমাকে ছাড়িয়ে খানিকটা আগে আগে হাটছে সুজিত, হঠাৎ ধাক্কা খেয়ে পেছনে ফিরে এলো! পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা একেবারেই নাজুক। যে যেখানে পারে কর্মটি সাধন করে। অধিকন্তু পায়খানা যে দু’একটি চোখে পড়ল, তা-ও কেন জানি পথের পাশে খাল-নালার ওপর। সুজিতের ফিরে আসা দেখে কোনো কিছু আন্দাজ করতে পারার আগেই দেখি সামনে পথের পাশে একটি পায়খানার তলদেশ থেকে নিচের পানিতে অনর্গল দড়ি ছিঁড়ে পরছে। দড়ি ছিঁড়ে পরার পূর্বে শব্দটি হয়েছিল তাই সুজিতের আঁতকে ওঠার কারণ। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর যখন দেখা গেল ভেতর থেকে কেউ বেড়িয়ে আসার নাম করছে না, তখন নাসিকা জোড়া শক্ত করে চেপে ধরে একটা দৌড় দিয়ে তা অতিক্রম করতে হলো। পথ এবার নিযে গেল বাঁধের ওপর। অরোহর কালাইয়ের গাছ; তার মাঝ দিয়ে চলতে চলতে পৌঁছে যাই ডাকাতিয়া ঘাটে। ঘাট বলতে কেবল একটি চা-বিস্কুটের দোকান পাশে একটি মাছের আড়ৎ। জঙ্গলের মাঝ দিয়ে এগিয়ে গিয়ে খালটি মিশেছে সমুদ্রে। কিছুক্ষণ পরপরই মাছের ট্রলার এসে ঘাটে ভিড়ছে আবার ছেড়েও যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে নিয়ে যেতে কেউ রাজি নয় কারণ ফেরত আনবে কে? যে যাচ্ছে সে সারা দিন অথবা দুই-তিন দিনের জন্য যাচ্ছে। একজন চেনা লোক মিলে গেল, যাকে আগের দিন উপজেলা ঘাট থেকে আসার পথে ট্রলারে দেখেছিলাম। তিনি স্বউদ্যোগেই উপকার করতে এগিয়ে এলেন। অল্পক্ষণ বাদে তার উপকারী চেহারার আড়াল থেকে বেরিয়ে পড়ল অন্য একটি রূপ- উপকারের মাঝ দিয়ে কীভাবে নিজের কমিশন নিশ্চিত করা যায়! শেষমেশ যখন বুঝতে পারল তার মনোবাঞ্ছা পূরণ হবার নয়, তখন খানিকটা ব্যর্থ চিত্তে পাশের দুই কিশোরকে ডেকে বলল, এই পোলাপান, খামাখা খালের পানিতে লাফালাফি করে শরীর খারাপ করে লাভ নেই; উনাদের ঘুরিয়ে নিয়ে আয়, টাকা দেবে। সকাল সকাল এমন প্রস্তাবে কিশোরদ্বয়ের চোখে-মুখে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল।
ডিঙ্গিতে সওয়ার হয়ে চললাম সমুদ্রের টানে। দুই কিশোর ইব্রাহীম ও কবির হাত বদল করে নৌকা বাইতে থাকল। চল্লিশ মিনিটের পথ পাড়ি দিতে লেগে গেল দেড় ঘণ্টা। নৌকা চালাতে ওদের অনেক কষ্ট হচ্ছে। মাঝে মাঝেই বিরতি; অথবা একজন বৈঠা ধরে তো অন্যজন পানিতে নেমে সাঁতরে সাঁতরে পেছন থেকে ঠেলা দেয়। আমরা দুই ভদ্রলোক তা সইতে না পেরে বৈঠা হতে নিলে বরাবরই যা ঘটল, হয় নৌকা চরকির মত ঘুরছে নয়তো ডানে-বামে জঙ্গলের নিচে ঢুকে পরছে। তাতে ওদের দুজনের হাসির অন্ত নেই। আশানুরূপ গতিতে না হলেও ওরা নৌকাটা কমপক্ষে সোজাসুজি এগিয়ে নিতে পারে, জেলে সন্তান বলে কথা। যখনই আমাদের দুজনের কেউ বৈঠা হাতে নিচ্ছি তখনই দুজন সজাগ- এইতো চরকির মত ঘুরতে আরম্ভ করবে! এমন পরিস্থিতিতে আমাদের বৈঠার পাশাপাশি ইব্রাহীম হাতে-পায়ে আপন কৌশল প্রয়োগ করে আপ্রাণ চেষ্টা করছে, যাতে নৌকা অন্তত সোজাসুজি এগোয়। রোদ আর নোনা জলে কালো কুচকুচে হয়ে যাওয়া ইব্রাহীম এই কাজটি করতে গিয়ে কতবার যে গলুই থেকে ধপাস করে পানিতে পরে গেল তার ঠিক নেই! দুই-তিন সেকেন্ড পরপর পানির নিচ থেকে যখন ভেসে উঠছে সর্বপ্রথম কালো মুখজুড়ে ফুটে উঠছে তার ঝকঝকে সাদা দুই পাটি দাঁত। কারণ তখনও তার চোখেমুখে হাসি লেগেই আছে। দুপাশ থেকে সবুজ বৃক্ষের ডালপালা নেমে এসেছে পানির কাছাকাছি। নিস্তব্ধ খালের অদ্ভুত নীরবতায় যতই চাই নীরব থাকতে ততোই পেরে উঠি না সারেংদ্বয়ের উচ্ছ্বাসের কারণে। ক্ষুধা লাগলে নৌকা ভেড়াতে বলি বেত ঝোঁপের পাশে কেওড়া গাছের ছায়ায়। শরিফ চাচার দোকান থেকে আগের রাতেই নাবিস্কো বিস্কুট আর কি কি যেন নেয়া হয়েছিল। বিস্কুট পাওয়ার পর ইব্রাহীমের কিঞ্চিৎ লজ্জা পাওয়া অথচ ভীষণ আনন্দিত চেহারাখানি দেখে মনে হলো কত বছর বিস্কুট খেতে পায়নি সে! দু’হাতে একটির পর একটি গোল গোল বিস্কুট মুখে পুরে দেয়া দেখে মনে হলো, এই বুঝি গলায় আটকে গেল, এখনই বলবে পানি দেন। অনুমান করতে পেরে তার আগেই সুজিত পানির বোতলটা বাড়িয়ে ধরল।
খানিক পর দু’চোখের সামনে দেখা দিল দিগন্তজোরা জলরাশি। সো সো শব্দে বাতাস বইছে। এঁকেবেঁকে আসতে আসতে ফটফট শব্দের একটি মাছ ধরা ট্রলার পাশ দিয়ে প্রবশ করল খালের ভেতর, সাথে রেখে যাওয়া বড় ঢেউয়ের আঘাতে দুলে উঠল আমাদের ছোট্ট ডিঙ্গি। যেন এখনই উল্টে আমাদের ছিটকে ফেলে দেবে। লাইফ জ্যাকেট পড়া সুজিত দুই হাতে নৌকা চেপে ধরে শক্ত কাঠ হয়ে আছে। তা দেখে হাসতে হাসতে বেতাল ইব্রাহীম বৈঠা থুয়ে মারল পানিতে লাফ। বাতাসের কারণে সৈকতের মত কূল-কিনার ধরে সামনে অগ্রসর হওয়া ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ল। ইব্রাহীম হাল ছাড়বার নয়। কায়দা করে প্রবেশ করল অন্য একটি খাড়ির ভেতর।
ধীরে ধীরে নৌকা ভিড়ল কেওড়া বনের মাঝে। অজস্র শ্বাসমূল বেড়িয়ে আছে, তার ভেতর দিয়ে পায়ে হাঁটা লিকলিকে পথ। একযোগে কোরাসের মত গেয়ে যাচ্ছে ঝি ঝি পোকার দল। চারিদিক থেকে যেন এক ভীতসন্ত্রস্ত আচ্ছন্ন করে ধরল। ভীষণ সূক্ষ্ম অথচ বিকট শব্দ ভেদ করে ভেসে এলো সমুদ্রের নোনা জল ধোয়া মিষ্টি বাতাস। সূর্যের আলো স্রোতের সঙ্গে দুলে উঠল হাজার হাজার ক্ষুদ্র আলোর ঝিলিক। পথটির শেষে কেওড়া বনের মাঝে ঢুকে পরেছে জোয়ারের পানি। আধডোবা গাছগুলির কালো কান্ড ধরে অনেকটা এগিয়ে গিয়ে দেখা দিল কলামের উপর দাঁড় করানো একটি কক্ষ। তার আশপাশে দুই-তিনটি বসার জায়গা। বেঞ্চের মতা হেলান দেয়া চেয়ারগুলি এতটাই কদাকার যে, রুচি না হওয়ায় আজ পর্যন্ত বোধহয় কেউ বসেনি। সিঁড়ি বেয়ে ঘরটিতে প্রবেশের পর চতুর্দিকের কাঁচ সরিয়ে দিয়ে সুজিত আবারও বিস্কুটের ডালি মেলে বসলো। হুড়মুড় করে বাতাস ঢুকছে, সবকিছু যেন লন্ডভন্ড করে দিয়ে যাবে। বেশ খানিকটা সময় বসে থাকার পরও জনমানুষের কোনো চিহ্ন পাওয়া গেল না। এসব কে বানালো, কেনই বা বানালো কিছুই জানতে পারলাম না। যতটুকু অনুমান করতে পারলাম, আমাদের গর্ব বন বিভাগেরই কাজ হয়ে থাকবে।
জলরাশি আর আকাশ মিশে গেছে ঐ দিগন্তে। ঠিক তার নিচে একটি দ্বীপ। বহুদূর থেকে মাঝাড়ি ঢেউ এসে বারবার আছড়ে পরছে পায়ের ওপর। বালুকা বেলা বলতে যেমন বুঝায় ঠিক তেমন নয়। মাঝে মাঝেই শেকড়সহ চিৎ হয়ে রয়েছে একেকটি বিরাট বৃক্ষ। এদিকে সারেংদ্বয়ের কোনো খবর নেই। জ্যাকেট পড়ে মহা আনন্দে লাফালাফি করছে। ইব্রাহীমের জীবনে এই প্রথম এমন একটি জিনিসের সাথে পরিচিতি। বাকি সময়টুকু ওর গা থেকে জ্যাকেটটি আর খোলার সাধ্য হলো না। গাঢ় হলুদ রঙের জ্যাকেটে ইব্রাহীম নয়, যেন মন্দিরে বসানো একটি কষ্টি পাথরের মূর্তি। সৈকত ধরে হাঁটতে থাকলাম যত দূর চোখ যায়! এবার প্রবেশ করি জঙ্গলের ভেতর। জায়গায় জায়গায় জোয়ারের অল্প পানি আটকে রয়েছে, তাতেই ভেসে বেড়াচ্ছে শত শত ছোট মাছ। অদূরেই বানরের পাল। পিছু পিছু ছুটতে গিয়ে প্রত্যেকেই ক্লান্ত। ইব্রাহীমদের উচ্ছ্বাস আর আমাদের উচ্ছ্বাসের মাঝে কোনো প্রভেদ থাকল না। বয়স কমে যেন তাদের পর্যায়ে নেমে এল। বানরের দল এবার সত্যি সত্যিই পালালো। সাবধান করে দিয়ে ইব্রাহীম জানাল, আর বেশি এগোলে পথ হারিয়ে ফেলার আশঙ্কা আছে। অতএব, সেই ঝুঁকি না নিয়ে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে সৈকতে ফিরে আসতে হলো। একটি ছবি তোলার পর ইব্রাহীমের আবদার- আরও একটি! এমনি করে ওর সরল আবদারে সাড়া দিতে দিতে সুজিতের অবস্থা বেগতিক। এই গাছের ডগায় চড়ছে তো এই পানিতে। এমনি করে হাজারো কায়দায় ছবি তুলতে তুলতে এক পর্যাযে সে নিজেই ক্লান্ত হয়ে পড়ল।
এবার ফেরা দরকার, বলতেই ওর মন বেজায় ভার- আরও থাকতে চায়। কারণ ওই একটাই- জ্যাকেট। জোর করে নৌকায় চড়াতে পারলেও মনটা যারপর নেই খারাপ। অবশেষে সুজিত বলল, নাও জ্যাকেট গায়ে দিয়েই নৌকা চালাও। অমনি সমস্ত অভিমান ভেঙ্গে বেরিয়ে পরল দাঁতের ঝকঝকে পাটিজোড়া। ফেরার সময় আরও বেশি সময় লেগে গেল। বৈঠা মারার বদলে ঠেলে ঠেলেই আমাদের নৌকা এগুতে লাগল। পথের মাঝামাঝি হঠাৎ করে থেমে সে বলল- গুইসাপ! সরসর শব্দে খালের ধার থেকে চলে যাচ্ছে জঙ্গলের ভেতর। কুমির নাকি সাপ বোঝা মুশকিল কারণ এত বড় আকারের গুইসাপ এর আগে দেখিনি। দৈর্ঘে কিছু কমবেশি আমার সমান হবে। নৌকা থেকে নেমে দুজনে সাবধানে পিছু ছুটলাম অন্তত একটি ছবি নেয়ার জন্য। ব্যর্থ হয়ে মনোবাঞ্ছার অপূর্ণতা নিয়ে নৌকায় ফিরতে হলো। ঘাটে পৌঁছার পর বিষাদের অন্ধকারে ঢেকে গেল হব্রাহীমের কিশোর মন! শেষবারের মতো আর একটা সাঁতার দেই! কিন্তু তার শেষবার আর শেষ হতে চায় না। অবশেষে একটা মৃদু ধমক দিতেই হলো। বাজারে ফেরার পর দিনের বাকি সময়জুড়ে অনেক অনেক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলাম কিন্তু সমস্ত কিছুর মাঝে ফিরে ফিরে ভেসে উঠল কালো কুচকুচে কষ্টিপাথর মুখখানি।
ছবি : লেখক
রাইজিংবিডি/ঢাকা/৫ মে ২০১৭/তারা
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন