ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

প্রফেসর জো ফুট: ওকলাহমার আইকন

শান্তা মারিয়া || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৪৭, ৭ মে ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
প্রফেসর জো ফুট: ওকলাহমার আইকন

প্রফেসর জো ফুট ও আমরা

(লক্ষ্মণ রেখার বাইরে পর্ব ১৪)

শান্তা মারিয়া: এমন কয়েকজন মানুষ আছেন যাদের সঙ্গে পরিচয় হলে নিজেকে সৌভাগ্যবান বলে মনে হয়। তেমনি একজন মানুষ প্রফেসর জো ফুট। তিনি ওকলাহমা বিশ্ববিদ্যালয়ের গে লর্ড কলেজ অফ জার্নালিজম অ্যান্ড মাস কমিউনিকেশনের চেয়ার পারসন। প্রফেসর জো ফুটের সঙ্গে প্রথম দেখা ঢাকায়। ঢাকায় তখন আমেরিকার রাষ্ট্রদূত ছিলেন হ্যারি কে টমাস। তার বাড়িতে একটি অনুষ্ঠানে আলাপ হলো জো ফুটের সঙ্গে। পরে আবার দেখা হলো আমেরিকান সেন্টারের পরিচালক পল সেবরার বাড়িতে। আমার সঙ্গে আলাপের পর জো ফুট বলেছিলেন একজন মুসলিমের নাম শান্তা মারিয়া? তোমার কথা আমি কখনও ভুলবো না। তিনি সত্যিই ভোলেননি। ওকলাহমার প্রোগ্রামে আমার নামটি অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন।

ঢাকা থেকে লম্বা পথ উড়ে যখন ওকলাহমায় পৌঁছালাম তখন রাত প্রায় দশটা। ২৮ ঘণ্টা কেটেছে পথে। তাই রীতিমতো ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত। এয়ারপোর্টে নেমে ইমিগ্রেশন দিয়ে বের হয়েই চোখে পড়ল প্রবীণ অধ্যাপকের সৌম্য মূর্তি। তিনি যখন সাদরে আমাদের সম্ভাষণ করলেন অর্ধেক ক্লান্তি যেন নিমিষে উধাও হয়ে গেল। লাবণ্য কাবিলীর লাগেজ ঠিকঠাক মতো পৌঁছায়নি। জো ফুট সেসব ক্লেইম করার ব্যবস্থা করে আমাদের সঙ্গে নিয়ে পৌঁছালেন ম্যারিয়টস ইনে। অবাক হয়ে দেখলাম জো ফুট নিজেই আমাদের লাগেজ গাড়ি থেকে নামাচ্ছেন। যার যার রুমে পৌঁছে দিচ্ছেন। এটুকু না করলে কিছুই হতো না। কিন্তু এটা শুধু ভদ্রতা নয়, আন্তরিকতার প্রকাশ। আমি পরে প্রফেসর জো ফুটের প্রোফাইল দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম তার যোগ্যতা ও পাণ্ডিত্যের বর্ণনায়। বর্ণাঢ্য তার ক্যারিয়ার। তিনি ওকলাহমা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যাচেলর ও মাস্টার্স এবং টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেছেন। ইংল্যান্ডের ব্রিস্টল ইউনিভার্সিটিতে তিনি পোস্ট গ্র্যাজুয়েট রোটারি ফেলো ছিলেন। তিনি অ্যারিজনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগেরও প্রধান ছিলেন। তার জন্ম অবশ্য ওকলাহমাতে।

এই পণ্ডিত মানুষটি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে পুরস্কারও পেয়েছেন প্রচুর। অনেক রাষ্ট্রীয় কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। অনেক উচ্চ পদেও নিজের যোগ্যতা ও মেধার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও ক্লাস নিয়েছেন। বাংলাদেশের বিশিষ্ট সাংবাদিক নাইমুল ইসলাম খানের সঙ্গে পরিচয় সূত্রে তিনি বাংলাদেশের নারী সাংবাদিকদের জন্য ‘লিডারশিপ ইন জার্নালিজম’ নামে এই প্রকল্পটিও পরিচালনা করছেন। পর পর দুই ব্যাচে বেশ ক’জন নারী সাংবাদিককে ওকলাহমায় এনেছেন যাদের নামের তালিকা মোটামুটি নাইম ভাই করে দিয়েছিলেন।

প্রফেসর জো ফুট একদিন আমাদের সবাইকে তার বাড়িতে নিমন্ত্রণ করলেন। সেখানে শুনলাম তার প্রেম, বিয়ে ও গার্হস্থ্য জীবনের গল্প। হাইস্কুলে পড়ার সময় জোডি নামে এক টিনএজ মেয়ে তার হৃদয় হরণ করে। সেই মেয়েকেই বিয়ে করেন তিনি। এবং ত্রিশ/চল্লিশ বছর ধরে সেই নারীই তার গৃহলক্ষ্মী। জো এবং জোডির তিন সন্তান। জ্যাকসন, জ্যান এবং জোয়ি। সময়ের স্বাভাবিক নিয়মে সন্তানরা বড় হয়ে আলাদাভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সংসারে এখন চিরদিনের সঙ্গী জো আর জোডি। ক্রিসমাসে, থ্যাংকস গিভিংসে সন্তানরা ফেরে বাবা-মায়ের কাছে। জোডি শোনালেন জো ফুটের তারুণ্যের গল্পও। জো ফুট নাকি ছিলেন বেশ কাউবয় গোছের দুরন্ত তরুণ। ঘোড়া চালানোতে দক্ষ। পাশাপাশি লেখাপড়াতেও ভালো ছাত্র। জোডির জীবনেও জো-ই প্রথম ও একমাত্র পুরুষ। আমি অবাক হয়ে তাদের এই প্রেম ও মধুর দাম্পত্যের কাহিনী শুনছিলাম।

আমেরিকানরা তো শুনেছি সকালে বিয়ে হলে বিকালে ডিভোর্সের চিন্তা করে। সেখানে এমন দীর্ঘ দাম্পত্য জীবন সত্যিই বিস্ময়ের। কিন্তু জো এবং জোডি জানালেন এমন দীর্ঘ ও সুখী দাম্পত্য আমেরিকাতেও বিরল নয়। যে বিয়েগুলো ভেঙ্গে যায় সেগুলো নানা রকম কারণে ভাঙ্গে ঠিকই কিন্তু যেগুলো টিকে যায় সেগুলো সত্যিকারের ভালোবাসা ধারণ করে বলেই টেকে। কারণ ওদেশে ‘ভান করা ভালোবাসার’ কোনো প্রয়োজন নেই। নীতির সঙ্গে আপোস করে, সমাজের কারণে বিয়ে টেকানোর দরকার পড়ে না। মৃত সম্পর্ককে অযথা টেনে নেওয়ারও দরকার নেই। যে সম্পর্কগুলো সজীব রয়েছে সেগুলোই টিকে থাকে।

প্রফেসর জোফুটের বাড়িতে বাংলাদেশী ফ্যাশন শো


আমিও বিষয়টি নিয়ে একটু ভাবলাম। আমাদের দেশের নারীরা সাধারণত অর্থনৈতিক ও সামাজিক কারণে স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির প্রচুর নির্যাতন সহ্য করেও মাটি কামড়ে পড়ে থাকে। ছেলেমেয়ে নিয়ে কোথায় যাবো, কে খাওয়াবে এই নির্ভরশীলতায় স্বামীর অনেক অন্যায় মুখ বুজে মেনে চলে। এই মেনে চলা বা সয়ে যাওয়ার নাম তো ‘বিয়ে’ হওয়া উচিত নয়। এটা প্রতি মুহূর্তের অপমান ও যন্ত্রণা। আমেরিকান নারীর তো এই যন্ত্রণা সহ্য করেও বিয়ে নামক দাসত্ব চালিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। তাই ভালোবাসা ফিকে হয়ে গেলে ওরা বিয়েটাকেও সহমরণে পাঠায়। আর যে বিয়েগুলো টিকে আছে সেগুলো প্রবল ভালোবাসা বহমান আছে বলেই রয়েছে।

জো ফুটের বাড়িতে আমরা একটি কালচারাল নাইট উপহার দেই সেদিন। বাংলা গান, নাচ তো হয়ই। বাংলাদেশের পোশাক নিয়ে একটি ছোট্ট ফ্যাশন প্যারেডেরও আয়োজন করি। সেদিন আমি পরেছিলাম টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি, নকশী চটিজুতো, মাটির গয়না, কাঁচের চুড়ি। এগুলোর পরিচয় দেওয়ার পর বললাম ‘অল আর মেড ইন বাংলাদেশ ইনক্লুডিং মি’।

সেদিন জো আর জোডি আমাদের ওকলাহমার ঐতিহ্যবাহী কিছু খাবার খাইয়েছিলেন। জোডি বললেন প্রতিটি ডিশ জো আর তিনি মিলে তৈরি করেছেন। অনভ্যস্ত রুচিতে অন্যান্য খাদ্য মোটামুটি লাগলেও অপূর্ব লেগেছিল কেক আর আইসক্রিম। দুটোই নাকি বাড়িতে তৈরি।

শুধু বাড়িতে ডাকাই নয় যতদিন আমরা ওকলাহমায় ছিলাম জো ফুট নিজে আমাদের সুখ সুবিধা তদারকি করেছেন। আমাদের কোনো রকম সমস্যা হচ্ছে কিনা খোঁজখবর নিয়েছেন প্রতিদিন অতি আন্তরিকভাবে। প্রায় আশি বছর বয়সী এই মানুষটি অন্তরে চির তরুণ। আমাদের সঙ্গে মজার আলোচনাতেও অংশ নিতেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে।

ওকলাহমা থেকে যেদিন চলে আসি সেদিন আমাদের পৌঁছাতে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত গিয়েছিলেন জো ফুট। তার কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় আমি এই প্রবীণ শ্রদ্ধেয় শিক্ষকের পা ছুঁয়ে সালাম করলাম। তিনি চমকে উঠেছিলেন। আমি বললাম, স্যার আমাদের দেশে এটাই সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা প্রদর্শনের রীতি। আপনাকে শ্রদ্ধা না জানালে আমি শান্তি পেতাম না।

প্রফেসর জো ফুট আমার দেখা ভালো মানুষদের অন্যতম। এই লেখার মাধ্যমে তাকে জানাই আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা। সেই সঙ্গে কামনা করি তার দীর্ঘ জীবন। (চলবে)




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৭ মে ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়