ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

এবার তবে লাংকাউয়ি: শেষ কিস্তি

হাসান জ্যোতি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:৩৫, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
এবার তবে লাংকাউয়ি: শেষ কিস্তি

প্রেগন্যান্ট মাইদিন আইল্যান্ড

হাসান জ্যোতি : এরই মধ্যে বৃষ্টি নেমেছে। সুইমিং করব তাই চলে এলাম সুইমিং পুলে। ঘণ্টাখানেক সুইমিং করে উঠে এলাম। কাপড় পাল্টে চললাম রাতের খাবার খেতে হাজী আলী নাসিকান্দার রেস্টুরেন্টে। খেলাম মাছের ডিম আর গরুর মাংস দিয়ে ভাত। বিদেশে এসেও দেশি খাবার, কিন্তু সব রান্নাই খেতে অনেকটা মিষ্টি। রাতের খাওয়া শেষে ফেরা হলো রুমে। ঘুমাতে হবে। কাল আবার সকাল থেকেই আছে কেবল কার, থ্রিডি আর আইল্যান্ড হপিং ট্যুর।

সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে সবাই হাজির শান্তশিষ্ট সমুদ্রের পাশে অবস্থিত নটিলাস রেস্টুরেন্টে প্রাতঃরাশ সেরে নিতে। ভাত, ভাজা শুঁটকি মাছ, ডাল, রাজমাহ, সবজি, ব্রেড, বাটার, জেলি, অমলেট, মামলেট স্যুপ, বিভিন্ন রকমের ফল এবং ফলের জুস, চা-কফি ইত্যাদি দিয়ে। সকালের সমুদ্রের মনোরম দৃশ্য দেখতে দেখতে নাস্তা করার জন্য ব্রেড, বাটার এবং জেলি নিয়ে হাজির হলাম সমুদ্রমুখী টেবিলে। সামনেই ছোট উঠোনে হেঁটে বেড়াচ্ছে একপাল কবুতর। নাস্তা দ্রুত সেরে নিতে হবে তাই অনেকটা নাকে-মুখে খাওয়া চলছে। আজকে সারাদিন ঘোরাঘুরি। শুরু হবে লাংকাউয়ির এই মূল দ্বীপের পাহাড় ঘেরা অংশে কেবল কার, স্কাই ব্রিজ, থ্রিডি আর্ট মিউজিয়াম এবং থ্রিডি সিনেমা দেখে। নাস্তা সেরে তাই চলে এলাম হোটেলের লবিতে, যেখানে আমার জন্য অপেক্ষা করছেন গাইড সাবরী।

 

আমি ও গাইড সাবরী


অভিবাদন জানিয়ে সাবরী আমাকে নিয়ে এলেন গাড়ির কাছে। শুরু হলো পথচলা মসৃণ এবং পরিচ্ছন্ন শহরের রাস্তা ধরে। মালয়েশিয়ার এই দ্বীপটি বিশ্বের কাছে পরিচিত ডিউটি ফ্রি দ্বীপ হিসেবে এবং এই দ্বীপটির মূল অর্থনৈতিক আমদানী প্রতিদিন বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা ট্যুরিস্টদের কাছ থেকেই বলা যায়। মিনিট চল্লিশের যাত্রা- সবুজ, শ্যামল এবং নির্মল প্রকৃতি দেখতে দেখতেই পার হয়ে গেল। সবুজে ঘেরা চারপাশ। চলে এসেছি প্রথম গন্তব্যে। সবাই নেমে একে একে এগিয়ে চললাম ছোট্ট একটি লেকের উপর নির্মিত কাঠ ও রশির ঝুলন্ত সেতু বেয়ে। নিচে বয়ে চলেছে সবুজাভ জল কলকল ধ্বনি তুলে। সেতু পার হতেই দেখা মিলল একাধারে ছবি তুলতে থাকা আমাদের সকল সদস্যদের সাথে। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে উপরে তাকাতেই খুদে খুদে কেবল কারের আসা যাওয়া চোখে পড়ল। গাইড এসে আমার হাতে কাগজের স্টিকার ব্রেসলেট পরিয়ে দিলেন। এই ব্রেসলেটটিই আগামী ঘণ্টাদুয়েকের জন্য এখানে আমার বেড়ানোর টিকিট। প্রতিটিতে বারকোড লাগানো আছে এবং বিভিন্ন স্থানে সেগুলো স্ক্যান করা হচ্ছে আমাদের প্রবেশের জন্য। গতবার গেনটিং হাইল্যান্ড, কুয়ালালামপুরে কেবল কারে চড়েছিলাম; কিন্তু লাংকাউয়ির কেবল কার তার চেয়েও দীর্ঘ এবং আরো বেশি উঁচুতে।

মোটামুটি সুদীর্ঘ একটি লাইন পেরিয়ে কেবল কার স্টেশনে এসে পৌঁছলাম। গাইড আগেই বলে দিয়েছেন কেবল কারে উঠে প্রথম স্টেশনে যেন না নামি, নামতে হবে দ্বিতীয় স্টেশনে। একটি কেবল কারে ছ’জন করে বসা যায়। সেভাবেই গ্রুপ ভাগ করে দেয়া অচেনা মানুষদের এক দলে আমি, পরিচিত শুধু সাবরী ইসমাইল। একটি কেবল কার আসতেই আমরা দু’জন উঠে পড়লাম। শুরু হলো ওপরে ওঠা। ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসতে শুরু করল নীচের অঞ্চল। চারপাশে শুধু সবুজ। দূরে থাকা সমুদ্র সৈকত ধীরে ধীরে ছোট হতে লাগল চোখের সামনে, কিন্তু বেড়ে গেল চারপাশের সৌন্দর্য। চারপাশ ঘুরে দেখতে দেখতে চোখে পড়ে গেল পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা একটি জলপ্রপাত। এই পাহাড় এবং বনভূমি বিভিন্ন রকমের প্রাণীদের অভয়ারণ্য। সবখানেই সে বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া আছে এবং অনুরোধ করা হয়েছে এমন কিছু যেন করা না হয় যাতে এই প্রাণীকূল বিপন্ন বোধ করে।

 

ক্যাবল কার


আমাদের কেবল কার এরই মধ্যে প্রথম স্টেশন পার হয়ে দ্বিতীয় স্টেশনের পথে। আরো উঁচুতে উঠতে চলেছি আমরা। এখান থেকে পুরো লাংকাউয়ি দ্বীপটি দেখা যায়, দেখা যায় আশপাশের সবগুলো দ্বীপ। অভূতপূর্ব সেই দেখা। চলে এসেছি আমরা দ্বিতীয় স্টেশনে। একে একে নেমে পড়ল সবাই। এবার যাওয়ার পালা স্কাইব্রিজে। হাতের বারকোড স্ক্যান করে নিয়ে দেখিয়ে দেয়া হলো স্কাই ব্রিজে যাওয়ার পথ। এখান থেকে সিঁড়ি বেয়ে নেমে স্কাই ব্রিজে যাওয়া যায় আবার লিফট কার আছে সেটিতেও যাওয়া যায়। তবে লিফট কারের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত দশ রিঙ্গিত খরচ করতে হবে সেটির টিকিট কাটার জন্য। হেঁটে যাওয়াই শ্রেয়, তাতে করে পুরো জায়গাটুকু দেখা হবে। আর ভাগ্যে থাকলে মুখোমুখি দেখা হয়ে যেতে পারে কোনো বন্যপ্রাণীর সাথে। সুন্দর করে সাজানো গোছানো সিঁড়ি বেয়ে নেমে এগিয়ে চললাম স্কাই ব্রিজের দিকে। পাঁচ-ছয় মিনিটের মধ্যে চলে এলাম স্কাই ব্রিজে। দুটি পাহাড়ের মাঝে ভাসমান এই ব্রিজটি হঠাৎ করেই মেঘে ঢেকে যায়, আবার উদ্ভাসিত হয় খানিক বাদেই। চারপাশে শুধু সবুজের সমারোহ। মাঝে মাঝে বাতাসে দূলে উঠছে এই ব্রিজটি। চারপাশের মনোরম সব দৃশ্য দেখতে দেখতে কেটে গেল অনেকটা সময়। একই সাথে চলল ছবি তোলা।

দ্বীপের অপর পাশের নীলাভ-সবুজ সমুদ্র দেখা যায় এখান থেকে যদি মেঘে ঢাকা না থাকে। এখানেই দেখা হয়ে গেল এক আইরিশ দম্পতির সাথে, যাদের পিচ্চি মেয়েটি এত কিউট যে, ওর সাথে ছবি তোলার লোভ সামলাতে পারলাম না। এখানে বেড়ানোর সময় প্রায় শেষ। এগিয়ে চললাম আমরা কেবল কার স্টেশনের দিকে। আসার সময়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমেছিলাম এবং উঠতে হবে তিনশো মিটারের মতো দূরত্ব। যারা এই পথ ধরে ফিরছে তাদের জন্য কিছুদূর পর পর আছে বিশ্রাম নেয়ার স্থান। আর কিছুদূর পরপর লেখা আছে আর কত মিটার বাকি। এরই মধ্যে চলে এসেছি ফেরার পথে। আবার কেবল কারে করে নামা হবে নিচের পথে যেখান থেকে শুরু করেছিলাম। নিচে নেমে দেখা হবে থ্রিডি আর্ট মিউজিয়াম এবং থ্রিডি সিনেমা। আমরা উঠে পড়েছি কেবল কারে। শুরু হলো ফেরা। ফিরতি পথেও চারপাশের সুন্দর মনোরম দৃশ্য আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখল। আকাশ থেকে মাটিতে নেমে এলাম এরকম একটা অনুভূতি নিয়ে নামতে হলো ক্যাবল কার থেকে। চলে এলাম আমি আর সাবরী থ্রিডি আর্ট মিউজিয়ামে।

 

থ্রিডি আর্ট মিউজিয়াম


এখানে বিভিন্ন রকম চিত্রাঙ্কন আছে যা দেখে মনে হবে সবকিছু যেন জীবন্ত, বাস্তবে আসলে সবকিছুই আলো এবং রঙের কারসাজী। তবে খুব ভালো লাগার মতো। থ্রিডি আর্ট মিউজিয়াম দ্রুত শেষ করে চলে এলাম থ্রিডি সিনেমা দেখতে। এখানে ডাইনোসর যুগে একটি সিনেমা দেখানো হলো, যা দেখে মনে হবে সত্যিই ডাইনোসরগুলো আপনাকে খেতে আসছে। বিস্তারিত লিখছি না। কারণ আমার বিবরণ না শুনে সরাসরি উপভোগ করাই শ্রেয়। এখান থেকে বের হয়েই পাশে চলে এলাম একটি রেস্টুরেন্টে, যেটি একটি স্ট্রিট ফুড কোর্ট। দুপুরের খাবার আমরা এখানেই খেয়ে নেব। স্যামন মাছের কারি, সাদা ভাত এবং এক প্রকার শাক ভাজি; এই দিয়েই সেরে নিলাম মধ্যাহ্নভোজ। খেতে মন্দ নয়। সময় কম তাই ঝটপট খেয়ে নিয়েই চললাম থ্রি আইল্যান্ড হপিং ট্যুরে।

আর আজকেই এখানে আমার শেষ দিন, তাই যত বেশি ঘুরে দেখা যায়। অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই চলে এলাম শান্ত সমুদ্রের সাথে লাগোয়া একটি জেটিতে, যেখানে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের জন্য অপেক্ষমান বোট। নিরাপত্তার জন্য প্রথমেই পরে নিতে হলো লাইফ জ্যাকেট। সব প্রস্তুতি শেষে আমাদের যাত্রা শুরু হলো শান্ত সমুদ্রের বুক চিড়ে। প্রথম গন্তব্য দ্বীপ বেরাস বাসাহ। এই দ্বীপটি মূলত প্রবাল দ্বীপ এবং সবাই এখানে আসেন সমুদ্রস্নান করতে। প্রস্তুতি আগে থেকেই ছিল। তাই এসেই নেমে পড়লাম নোনা জলে। ডুব দিয়ে তুলে আনলাম কিছু ক্ষুদ্র প্রবাল। যদিও এই দ্বীপের প্রতি প্রান্তে অনুরোধ করা আছে প্রবাল যেন না তোলা হয়, তাতে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হবে। যদি কেউ স্নান করতে চান তবে এই দ্বীপটি আপনার জন্যে স্বর্গরাজ্য। বাহারি মাছের আনাগোনা এখানে এবং এটি তাদের অভয়ারণ্য। নির্ধারিত সময় এক ঘণ্টা। তাই সময় শেষে চলে এলাম বোটে। শুরু হলো যাত্রা পরবর্তী গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।

 

ফেরার পথের কুয়ালালাম্পুর এয়ারপোর্ট ২ এ


পরবর্তী গন্তব্য দ্বীপ সিঙ্গা বেসার। এটি মূলত ঈগলদের অভয়ারণ্য। দ্বীপটিতে নামা যায় না। বোটে থেকেই চলে ঈগল দর্শন। পানিতে ছুড়ে দেয়া হয় ছোট আকারের মুরগি। আর ঈগল এসে সেই মুরগি ছোঁ মেরে নিয়ে যায়। পাখিপ্রেমীদের জন্য খুব ভালো স্থান। কাছ থেকে ঈগল দর্শন হবে আর ছবি তোলাও যাবে। মিনিট পনেরো এখানে সময় কাটিয়ে চলে আসা হলো প্রেগন্যান্ট মাইদিন আইল্যান্ডে। এই দ্বীপটি দূর থেকে একজন গর্ভবতী নারীর মতো দেখতে। এর পেছনেও আছে ইতিহাস। বহু বছর আগে এখানকার এক রাজার কন্যা তার এক প্রজার প্রেমে পড়েছিলেন এবং বিয়ে করেছিলেন। রাজা যখন সব জানতে পারেন, তখন মেয়েকে এবং সেই প্রজাকে হত্যা করতে উদ্যত হন। তখন রাজকন্যা বাঁচতে পালিয়ে যাওয়ার পথ বেছে নেন, এসময় তিনি গর্ভবতী ছিলেন।  কিন্তু সব দিক থেকে তাকে ঘিরে ফেলায় রাজকন্যা নিজেকে পাথরে রূপান্তরিত করে ফেলেন এবং সে কারণেই গর্ভবতী নারীর মতো দেখতে এই দ্বীপ। এরই মধ্যে চলে এসেছি প্রেগন্যান্ট মাইদিন আইল্যান্ডে। এখানে আছে প্রাণীর অভয়ারণ্য। আছে প্রচুর বানর এবং অন্যান্য প্রাণী। সব প্রাণী না দেখতে পেলেও এখানে বানরের দেখা মিলবে প্রচুর। আর এখানে থাকতে হবে সতর্ক, কারণ বানরগুলো আপনার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে যেতে পারে। আর আছে স্বাদু পানির লেক। যেখানে নেমে সাঁতার কাটতে পারবেন। চারপাশে পাহাড় ঘেরা লেকে সাঁতার কাটার অভিজ্ঞতা নিতে নেমে পড়লাম লেকে। সমুদ্রের নোনা পানিতে সাঁতার কেটে এসে, স্বাদু পানিতে নেমে মনে হলো নিজের ওজন অনেকখানি বেড়ে গেছে। তবে অভিজ্ঞতা দারুণ হলো। ফিরে যাওয়ার সময় হয়ে যাওয়ায় উঠে পড়লাম। আমার গাইড সাবরী আছেন অপেক্ষায়। সুন্দর এই পরিবেশকে বিদায় জানিয়ে ফিরে এলাম বোটে।

শুরু হলো সমুদ্রের বুকে বোটের অ্যাক্রোবেট শো। বেশ উপভোগ করতে করতে ফিরে এলাম লাঙ্কাউই শহরে। কিছু সময় শপিংয়ে কাটানোর জন্য চলে এলাম চেনাং বীচ এলাকায়। সময় যেহেতু হাতে কম তাই দ্রুত সেরে নিলাম শপিং। এবার রাতের খাবারের পালা। আস্ত গ্রিল করা নাম না জানা এক সামুদ্রিক মাছ দিয়ে হলো রাতের খাওয়া। ফিরে এলাম হোটেলে। আজই এখানে শেষ রাত। কাল আবার ফিরে চলা গতানুগতিক জীবনে। খুব ভোরে উঠতে হবে, তাই গাইড সাবরীকে বিদায় জানিয়ে চলে এলাম হোটেল রুমে। খোলা জানালা দিয়ে সুমদ্রের বাতাসও এসে জানিয়ে গেল বিদায়, দূরে সমুদ্রের বুকে তখন মিটমিট করে জ্বলছে শত শত মাছ ধরা নৌকোর আলো।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮/শান্ত/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়