ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

ভিয়েতনামের পথে : ২১তম পর্ব

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:০০, ৩১ মার্চ ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ভিয়েতনামের পথে : ২১তম পর্ব

ফেরদৌস জামান: ঝরনার নিচে ছোট্ট পুকুর, তার পাড়েই সুবৃহৎ পাথর খণ্ড। পাশ দিয়ে দুরন্ত বেগে নেমে যাচ্ছে মে ইয়েনের ঠান্ডা পানির ধারা। পাথরের চূড়ায় এখনও বসে আছি। ছায়াময় শান্তির আশ্রয় পেয়ে শরীর আর উঠতে চাইছে না। এখানে সময় অপচয় করলে সন্ধ্যার আগ দিয়ে পাই ফেরা অনিশ্চিত হয়ে দাঁড়াবে। শরীর ও মন উভয়ের উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ চালিয়ে ফিরতি পথ ধরতে বাধ্য হলাম। পথ মাঝে মাঝে খানিকটা এদিক সেদিক হয়ে গেলেও একেবারে ভুল হলো না। কারণ মূল ট্রেইলের শাখা-প্রশাখা দিয়ে পুনরায় সঠিক পথেই ফিরে এসেছি। এমন পরিস্থিতিতে পথ নিয়ে সামান্য বিভ্রান্ত হলেও মনের ভেতর ভীতি বলে জিনিসটি বাসা বাঁধতে পারেনি। পথে মিলে যায় বিপরীত দিক থেকে আগত নতুন এক দল পর্যটক। দু’চার কথায় তাদের প্রতি শুধু এতটুকুই পরামর্শ- বেলা গড়িয়ে গেছে, ঝরনা দেখে ফিরতে ফিরতে নিশ্চিতভাবে রাত হয়ে যাবে। তারুণ্যের উচ্ছাস বলে কথা, আমাদের পরামর্শ আমলে নিলেও এগুতে থাকল ঝরনার টানে। হাঁটছি আর মনে মনে ভাবছি ছাউনির নিচে সেই মাচার দেখা কখন মিলবে। এদিকে সঙ্গে রাখা খাবার পানির মজুদও শেষ। খাল বেয়ে চলে আসা ঝরনার পানি বেশ স্বচ্ছ কিন্তু পান করতে রুচি হলো না। কারণ অল্পক্ষণ আগেও দেখে এসেছি রেখে আসা সকলেই মনের আনন্দে ঝরনার নিচে ভিজছে।

শুধু মানচিত্র আর পথে পাওয়া দু’একজন মানুষের দিকনির্দেশনাকে অবলম্বন করে এমন একটা অভিযান সমাপ্ত করাকে একটা অর্জন বলেই মনে হলো। এই তো সামনেই মাচা। চারপাশের ভীষণ নীরবতায় পরিবেশটা কেমন যেন ভূতুরে রূপ নিতে চাইছে। আমাদের পক্ষ থেকে একটু প্রশ্রয় পেলেই তা ঠিক ভীতিকর হয়ে উঠবে। সুতরাং, সে সুযোগ না দিয়ে মাচায় কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে আবারও পথ ধরলাম এবং ঠিক করলাম এক টানে গিয়ে উপস্থিত হবো সেই পাথুরে মেঠো পথের প্রান্তে। চলতি পথের অনেকটাজুড়ে পাতানো প্লাস্টিকের মোটা নল। এই নলের মাধ্যমে বহু দূর থেকে মিষ্টি পানি এগিয়ে যায় নগরের বসিন্দাদের দোরগোড়ায়। কি দারুণ ব্যবস্থা, ঘরে বসে ঝরনার পানি পান করা! এক-দেড় ঘণ্টার মধ্য অন্ধকার নেমে আসবে। অথচ, চার-পাঁচজন জাপানি মে ইয়েন দেখতে কেবল রওনা করছে। আমরা খালের ভাটিতে এসে পাথুরে পথের শেষ প্রান্তে সবে ভিড়েছি তখন তাদের সাথে দেখা। জনপ্রতি একটি করে স্কুটি এনেছে। আমাদের পরামর্শে তার যাত্রা স্থগিত করল তবে প্রত্যেকের চোখেমুখে প্রকাশ পেল হতাশার ছবি। আমাদের পিছে পিছে সেই প্রেমিক যুগোলও চলে এসেছে। তাদের মধ্যে ছেলেটির হাফ প্যান্ট পরা উদোম ঠ্যাং-এ লতাপাতার আঁচড়ে কত প্রকার নকশা যে এঁকে বসেছে তার হিসেব নেই! সে বিষয়ে সমবেদনামূলক দুকথা বলায় তারা অনেক খুশি হলো। অতি সামান্য বিষয়েও খুশির কারণ- কেউ অন্তত তার কষ্টের খোঁজ নিল। এক সাথে পথ চলতে চলতে সন্ধ্যার আগেই পাই পৌঁছলাম।
 


পরের দিন দেখতে যাব পাই এর বিখ্যাত এক গুহা। লড কেইভ নামে পরিচিত গুহাটির স্থানীয় নাম প্যাং মা ফা। খোঁজখবর নিয়ে জানতে পেলাম পাই শহর থেকে তার দূরত্ব প্রায় ত্রিশ কিলোমিটার। এ আর পায়ে হেঁটে সম্ভব নয়। একটা স্কুটি ভাড়া করা ছাড়া আপাতত কোনো বিকল্প নেই। দোকানে সাজিয়ে রাখা সারি সারি স্কুটি ও মোটর সাইকেল। সিসি বা সক্ষমতাভেদে একেকটির ভাড়া একেক রকম। অটো গিয়ারওয়ালা না ম্যানুয়াল নিলে ভালো হবে, এই নিয়ে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে দোকান ঘুরে ঘুরে চললো সুজিতের অযাচিত যাচাইবাছাই। এখানে আছি আর মাত্র একদিন। অতএব, এমন পরিস্থিতিতে এক ঘণ্টা অপচয়ের অর্থ অনেকটা পেছনে পরে থাকা। এমনকি বাকি সময়টাকে অনিশ্চিয়তার দিকে ঠেলে দেয়ার সামিল। অবশেষে এক দোকনে ঠিক হলো চব্বিশ ঘন্টার ভাড়া আড়াইশ বাথ। প্রয়োজনীয় জ্বালানি নিজেদের কিনে নিতে হবে। সব ঠিকঠাক, এবার পছন্দের স্কুটিটা বুঝে নিয়ে গেস্ট হাউসে ফেরার পালা। দোকানি বলে পাসপোর্ট জমা রাখতে হবে অথবা পাঁচ হাজার বাথ। এ কেমন কথা, সাদা চামড়াদের বেলায় পাসপোর্টের ফটোকপি আর ভাড়া জমা দিলেই হয়ে যাচ্ছে, অথচ আমাদের বেলায় ভিন্ন, এটা বৈষম্য ছাড়া অন্য কিছুই হতে পারে না! জীবনের প্রথম পাসপোর্ট হারিয়েছি পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা সুরক্ষিত জায়গার একটি আইরিশ হোম অথরিটি, ডাবলিন থেকে। যে ভোগান্তি আমাকে আজও বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। অতএব, এই বস্তুটির বিনিময়ে যে কোন প্রকারের সওদায় আমি নারাজ। আর পাঁচ হাজার বাথ, সে তো এই মূহূর্তে থাকলে জমা দেয়ার প্রশ্ন। তাছাড়া, এই টাকায় একটা নতুন স্কুটিই কেনা সম্ভব। আর কোন পথ অবশিষ্ট থাকল না।
 


শরণাপন্ন হতে হলো টুর অপারেটরের। যেই জিনিসটি আমার সব থেকে অপছন্দের অবশেষে সেই টুর অপারেটরের প্যাকেজ কিনতে বাধ্য হলাম। কেউ বলে এক হাজার, কেউ আটশ তো কেউ বলে পাঁচশ বাথ। এদের মধ্যে কারও পাকেজে আছে দশটি জায়গা ঘুরে দেখার সুযোগ এবং কারও আছে পাঁচটি। তবে লড কেইভ নামক জায়গাটি প্রত্যেকটিতে অন্তর্ভূক্ত। আপাতত আমাদের একমাত্র লক্ষ্য কেইভ। কারণ প্যাকেজে অন্তর্ভূক্ত বেশ কয়েকটি গন্তব্য ইতিমধ্যেই দেখা শেষ। শুধু কেইভটাই বাকি। এটা দেখা হলে পাইতে আমাদের দেখার আর কিছু নেই বলা যায়। প্যাকেজের অন্যান্য গন্তব্যে না গিয়ে শুধু কেইভে কীভাবে যাওয়া যেতে পারে সেই ফন্দিফিকিরে কোন কূলকিনারা না হওয়ায় পাঁচশ বাথে পুরো প্যাকেজটাই কিনতে বাধ্য হলাম। জলাঞ্জলি গেল স্কুটি চালিয়ে লড কেইভ দেখতে যাওয়ার ইচ্ছা। টুর অপারেটর কার্যালয় থেকে জানানো হলো, পরের দিন সকাল নয়টায় এখান থেকে গাড়ি ছেড়ে যাবে, উপস্থিত হতে হবে তার আধা ঘণ্টা আগে।
 


আশাহত হলেও নিশ্চিন্ত মনে হাঁটতে থাকলাম দুই দিনে পরিচিত হয়ে ওঠা রাস্তাগুলোয় আর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অবলোকনের চেষ্টা করলাম চারপাশটা। একটা দোকানের সামনে ঐতিহ্যের কালো পোশাক আর গহনা পরা রমণী অনর্গল নৃত্য করে যাচ্ছে। শব্দ যন্ত্র থেকে ভেসে আসছে আবহ সঙ্গীত। তালে তালে ধীর লয়ের নৃত্য। কেউ এগিয়ে গেলে ধরাধরি করে নৃত্যের তালে ছলায়-কলায় ছবি তোলার সুযোগ করে দিতে শিল্পীর কোনো কার্পণ্য নেই। সামনে রাখা বাক্সে লেখা টিপ বক্স। ইচ্ছে হলে কেউ দুচার বাথ উপহার দিয়ে বিদায় হচ্ছে। এখানে জটলা ধরে নৃত্য উপভোগ করা দর্শকের বড় অভাব। তাছাড়া শিল্পীর নৃত্যে যেন কলা সংকট বিরাজমান। কেবল হাতে গোনা কয়েকটি কলারই পুনরাবৃত্তি ঘটছে। অদূরেই ভ্রাম্যমাণ দোকানে জ্বলছে উজ্জল আলো। সামনে একটার পর একটা বাঁশের টুকরো সাজিয়ে রাখা। কাচা বাঁশের টুরোগুলো আট-দশ ইঞ্চি লম্বা। এক প্রান্ত খোলা মুখ, অপর প্রান্ত গিরা দ্বারা বন্ধ, যেন একেকটি পেয়ালা। পেয়ালার গায়ে আাঁচড় কেটে স্থানীয় বর্ণমালায় কিছু একটা লেখা। এসবের উপরের থাকে সার করে রাখা পাঁচ-ছয়টা মাটির হাড়ি। বাঁশের টুকরোর পেয়ালায় করে বিক্রি হচ্ছে নানান স্বাদের চা অথবা অন্যান্য গরম পানীয়।
 


পর্যটক বা পথচারিদের হাতে পানীয় ভর্তি বাঁশের পেয়ালা তুলে দিচ্ছে এক জোড়া খাঁড়া শিংওয়ালা টুপি পড়া বিক্রেতা। রাতের শহরের রাস্তায় হেঁটে হেঁটে সৌখিন পর্যটক ক্ষণে ক্ষণে নলে টান দিয়ে মুখে তুলে নিচ্ছে স্বাদের উষ্ণ পানীয়। এদিকে মুসলমান দোকানের গলির মুখে একজন প্রৌড় দৃষ্টিনন্দন পোশাকে সজ্জিত হয়ে পরিবেশন করছেন বাঁশি এবং তিন তারের বিশেষ এক যন্ত্রের সুর। বাঁশির মাঝখানে গোলাকৃতির বস্তু এবং তার সম্মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে উপর-নিচে দইটি নল, যেন সাপুরের বিন। খানিক পর বাঁশি রেখে ঘারে ঝুলে নিলেন দোতারার মতো তিন তারের এক টুংটাং শব্দের যন্ত্র। কি চমৎকার তার পরিবেশনা! মাথায় পুরু টুপি, গায়ে ফুল হাতা কালো জামা। গলা থেকে দুই কাঁধ ছাপিয়ে বুক পর্যন্ত পুতি দিয়ে গাঁথা চওড়া অলঙ্কার। পড়নে কালো প্যান্ট, তার উপর দিয়ে ফুল প্যান্টের চেয়ে একটু খাটো আকাশি রং এর ঢোলা পিড়ান। কেমরের সম্মুখ অংশে জামার নিচ থেকে একটুখানি ঝুলে এসেছে কুচি করা লাল কাপড়ের গুছি। সব শেষে ডান কাঁধ থেকে বাম পাশে ঝুলানো চুমকি দিয়ে কারুকাজ করা একটি রঙ্গিন থলে। আপন মনে তুলে যাচ্ছেন একটার পর একটা সুর। সম্মুখে রাখা স্কলারশিপের বাক্সে যে যা পারছে রেখে যাচ্ছে। কিসের স্কলারশিপ তা জানা হয়ে উঠল না।

রোটি কমুসার দোকান থেকে ভেসে আসছে তেলে ভাজার সুগন্ধ। ভ্রাম্যমাণ ছোট্ট দোকানটাতে নানান পদের রুটির মূল্য তালিকা ঝুলিয়ে দেয়া। কলা, ডিম, মাখন, অথবা কনডেন্সড্ মিল্ক দিয়ে একেক রকমের পরোটা। পাতলা ফিনফিনে রুটির মাঝে উপরুক্ত কোন একটি উপকরণ দিয়ে চারপাশ ভাঁজ করে তুলে দিয়ে; এদিক সেদিক সামন্য ভেজে তুলে পরিবেশিত হচ্ছে। খেতে কেমন হবে তার চেয়ে অধিক আকর্ষণের বিষয় হলো পরোটা বানানোর কাজে লোকটির ধ্যান এবং গভীর মনোনিবেশ। ঠোঁটের উপর ঠোঁট তুলে দিয়ে কি মনোযোগে তৈরি করছেন রোটি কমুসা। মুখের মধ্যে যেন ধরে রেখেছেন সুগন্ধে গড়িয়ে আসা বেশ খানিকটা লালা। খানিক এগিয়ে একটি দোকানে অপেক্ষাকৃত বেশি ভিড়। সাজানো আছে হলুদ রং এর পাকা আম। পাশের গামলায় প্লাস্টিকের কাঁচ দিয়ে বন্ধ করে রাখা ভাত। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করলাম এই খাবারের ভক্তরা প্রায় সকলেই স্থানীয় বাসিন্দা। আপেক্ষমান প্রত্যেকের চোখে মুখে ফুটে উঠেছে গভীর আগ্রহের অভিব্যক্তি। নরম এবং চ্যাটকা ভাতের সামন্য পরিমাণ বাটিতে নিয়ে তার উপর কয়েক ফালি আম কেটে দিয়েই পরিবেশন। পদের নাম ইংরেজিতে স্টিকি রাইস উইথ ম্যাঙ্গো তবে স্থানীয় কোন নাম অবশ্যই আছে। অতি সাধারণ এই পদ তাদের নিকট এত অধিক আগ্রহের খাবার হিসেবে গণ্য হল কেন তা উদ্ধারে আর মনোনিবেশ করলাম না। রাত যা হয়েছে তা খুব বেশি নয় তবে সারদিন যে পরিমাণ পরিশ্রম হয়েছে তাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পরা উত্তম। অতএব, প্রশান্তির ঘুমের জন্য আপাদত কেন্টার হাউজের পথ ধরা যাক।   (চলবে)

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩১ মার্চ ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়