ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

যমজ টেলিপ্যাথির রহস্য

মাহমুদুল হাসান আসিফ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:১৯, ৪ এপ্রিল ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
যমজ টেলিপ্যাথির রহস্য

প্রতীকী ছবি

মাহমুদুল হাসান আসিফ : যমজ সে যেমনই হোক; ফ্রাটারনাল বা আইডেন্টিক্যাল, তারা নজর কাড়ে সবারই। যমজ মানুষগুলোর ক্ষেত্রে দেখা যায় তাদের সম্পর্কটা খুবই ঘনিষ্ট হয়ে থাকে। জিনগত মিল ছাড়াও তাদের কাপড়চোপড়, খাওয়াদাওয়া, বন্ধুবান্ধব, গোপনীয় বিষয়- সবকিছুর মধ্যেই একটি মেলবন্ধন পাওয়া যায়।

সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয় হচ্ছে, আইডেন্টিক্যাল অর্থাৎ অভিন্ন যমজদের ক্ষেত্রে দাবি করা হয়ে থাকে যে, প্রতি  পাঁচটি যমজের মধ্যে একটি যমজে আধ্যাত্মিক এক প্রকারের সম্পর্ক থাকে। অর্থাৎ তারা একে অন্যের মনের কথা বুঝতে পারে অনেকটা মাইন্ড রিডিং এর মতো, যাকে ডাক্তারি ভাষায় টেলিপ্যাথি বলে।

যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণকারী প্রতি ৩০টি শিশুর মধ্যে একটি শিশু যমজ হয়ে থাকে এবং অভিন্ন যমজ বাচ্চাগুলো বেশি আকর্ষণীয় হয়ে থাকে; কেননা তাদের জিনগুলো একই রকম হওয়ার পাশাপাশি তারা দেখতেও একই রকম হয়। কিছু যমজ দাবী করে থাকেন যে, তারা পরস্পরের অনুভূতি বা চিন্তা বুঝতে পারেন অর্থাৎ বিশেষ মানসিক সংযোগ থাকে তাদের মধ্যে। কিন্তু চমকপ্রদ এই ব্যাপারটির পেছনের রহস্যটা কি? এটা কি কেবলই কাকতালীয় ব্যাপার, আধ্যাত্মিক ক্ষমতা নাকি অন্যকিছু?- এ বিষয়েই আজকের এই প্রতিবেদন।

যমজদের মধ্যে একটা ব্যাপার লক্ষনীয়। সেটা হচ্ছে তাদের চিন্তাভাবনা, কথাবার্তা, আচরণ একই রকমের হয়। আসলে এটার পেছনে টেলিপ্যাথির চেয়ে যেটা বেশি কাজ করে তা হচ্ছে, একই ধরনের জীবনাচরণ এবং পরিবেশ। সুতরাং তাদের মধ্যে মনের মিল থাকাটা রহস্যজনক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ নয়। কেননা সাধারণ মানুষদের ক্ষেত্রেও দুটি মানুষ যারা একে অন্যকে ভালোমতো জানে এবং চেনে, একই পরিবেশে বেড়ে উঠেছে এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গেছে তাদের মধ্যেও যমজের মতো ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে। যেমন: একই পরিবারের ভাই-বোন (যমজ নয়), বৃদ্ধ দম্পতি এমনকি যাদের মধ্যে ঘনিষ্ট বন্ধুত্বের সম্পর্ক আছে, তারাও যমজের মতো আচরণ করতে পারে যা দেখলে হয়তো আমরা অবাক হব।

যমজ মানুষের মধ্যে টেলিপ্যাথি সংযোগের ব্যাপারটি এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে আলোচিত। ১৮৪৪ সালে আলেকজান্ডার দমাসের লেখা ‘দ্য করসিকান ব্রাদার্স’ বইটি বেশ উল্লেখযোগ্য। বইটিতে দুই করসিকান যমজ ভাইয়ের কথা বলা হয়েছে, যারা জন্মের পর আলাদা হয়ে যায় এবং পরিণত বয়সেও তাদের চিন্তাভাবনা এবং আচরণ একই রকম ছিল। বইটিতে যমজ দুই ভাইয়ের মধ্যে একজনের জবানীতে বলা আছে, ‘আমরা পরস্পর থেকে দূরে থাকলেও আমাদের শরীর ও মন একই আছে। আমাদের মধ্যে একজনের অনুভূতি বা শারীরিক বা মানসিক অবস্থা যেমন হয়, আরেকজনের অবস্থাও একই হবে।’ দমাস তার বইটিতে যমজদের ‘দুই মন এক শরীর’ হিসেবে তুলে ধরেছিলেন এবং বেশিরভাগই নেতিবাচক হিসেবে।

এক শতাব্দী আগে পশ্চিম আফ্রিকাতে যমজ জন্মের হার পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় চারগুণ বেশি ছিল। এমনকি পশ্চিম আফ্রিকার ইউরোবা উপজাতি এবং নাইজেরিয়ানদের মধ্যে যমজ শিশু জন্মানো আতঙ্কের কারণ হিসেবে ভাবা হতো। অনেকসময় মা সহ শিশুকে নির্বাসনে পাঠানো হতো অথবা হত্যা করা হতো।

লোকতত্ববিদ এম.এ র‍্যাডফর্দ ১৯৬১ সালে ‘দ্য এনসাইক্লোপিডিয়া অব সুপারস্টিশনস’ নামে একটি বই প্রকাশ করেন যেখানে একইরকম দেখতে যমজদের সম্পর্কে বেশ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেওয়া হয়। সেখানে বলা হয়, ‘একই রকম দেখতে যমজরা তীব্র সমবেদনার বন্ধনে আবদ্ধ থাকে, যার ফলে তারা একে অন্যের মানসিক অবস্থা বুঝতে পারে। এমনকি তারা ভিন্ন জায়গায় অবস্থান করলেও আরেকজনের বিপদ-আপদ সম্পর্কে বুঝতে পারে এবং রহস্যময়ভাবে একজনের আনন্দ বা খুশি অন্যজনের মধ্যে প্রতিফলিত হতে দেখা যায়।’ বইটিতে আরো বলা হয়, ‘যমজের মধ্যে যদি একজন মৃত্যুবরণ করে, তাহলে অপরজনও দ্রুত মৃত্যুবরণ করে।

কিন্তু আসল ব্যাপার হচ্ছে, কোনো যমজের মধ্যে দুজন যদি একইসময় মারা যায় তা বেশ রহস্যময় ঘটনা। উদাহারণস্বরুপ- ২০১৭ সালে মারথা উইলিয়ামস এবং জেন হ্যালি নামে ৯৭ বছর বয়সি এক যমজ জুটি তাদের রোড আইল্যান্ডের বাড়ির বাইরে ঠান্ডা আবহাওয়ায় একসঙ্গে মৃত্যুবরণ করেন। এর তিন বছর আগে অর্থাৎ ২০১৪ সালে হেলেন মেই কুক এবং ক্লারা মেই মিচেল নামে ৮৩ বছর বয়সি আরেক যমজ জুটি একদিন আগে পরে মারা যান। দুই বোনের মধ্যে প্রথমে হেলেন হার্ট অ্যাটাকে মারা যান এবং পরের দিন ক্লারা অ্যালঝেইমা’র্স রোগে দীর্ঘ দিনের সংগ্রাম শেষে মারা যান। আসলে এই দুই যমজ জুটির একসঙ্গে মৃত্যুর ঘটনা ব্যতিক্রমধর্মী দুটি ঘটনা, যা সচরাচর ঘটে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যমজদের মৃত্যুর ব্যবধান মাস, বছর আবার কখনো যুগের কোটায় গিয়েও দাঁড়ায়।

হেলেন এবং ক্লারা যমজযুগলের মৃত্যুর কারণ আসলে তাদের বয়স। ৮৩ বছর বয়সে দুইজনের একইসঙ্গে মারা যাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক একটি বিষয়। উদাহারণরস্বরূপ বলা যায়, ২৩ বছর বয়সি কোনো যমজ জুটির একসঙ্গে মারা যাওয়ার ঘটনা কিন্তু শোনাই যায় না। অভিন্ন যমজ জুটি জীবনের প্রায় একই পর্যায়ে মৃত্যুর ঘটনা প্রত্যাশিত হতে পারে কারণ যারা যমজ নয় তাদের তুলনায় ‍যমজদের জিন একই হওয়ায় হৃদরোগসহ অন্যান্য রোগ উভয়ের মধ্যেই বিকশিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আরেকটি ব্যাপার হতে পারে যে, যমজদের মধ্যে অনেক তীব্র সহমর্মিতা এবং ভালোবাসার বন্ধন থাকে যার ফলে একজন মারা গেলে আরেকজন এই গভীর শোক সহ্য করতে পারে না। এই মৃত্যুর কারণ হার্ট অ্যাটাক বা গভীর স্নায়ুবিক আঘাত হতে পারে। সুতরাং যমজদের কাছাকাছি সময়ে মৃত্যুর পেছনে তাদের মধ্যে কোনো আধ্যাত্মিক ব্যাপার থাকে না।

অবিশ্বাস্য প্রমাণের পেছনের রহস্য
যমজ টেলিপ্যাথির বেশিরভাগ প্রমাণই বৈজ্ঞানিক নয়, বরঞ্চ মনগড়া কাহিনি। ২০০৯ সালে যমজ টেলিপ্যাথির একটি ঘটনা ঘটে যা তৎকালীন সময়ে গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার প্রচারণা পেয়েছিল। ঘটনাটি হচ্ছে, গেমা হাউটন নামে এক ব্রিটিশ তরুণী বাড়িতে থাকা অবস্থায় হুট করে তার মনে হয় যমজ বোন লিন হাউটন কোনো বিপদের মধ্যে আছে। গেমা লিনকে খুঁজতে গিয়ে তাকে বাথরুমের মধ্যে অচেতন অবস্থায় পান। তৎক্ষণাৎ তিনি লিনকে কিছু প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পর তাকে হাসপাতালে নিয়ে যান এবং এভাবেই তিনি লিনের জীবন বাঁচিয়েছিলেন। গেমা এবং লিনের এই ঘটনা যমজ টেলিপ্যাথির উদাহরণ হিসেবে ব্যাপকভাবে উল্লেখ করা হয়। গাই লিওন প্লেফার নামে একজন লেখক তার একটি বইয়ে গেমা এবং লিনের এই ঘটনা উল্লেখ করেন যমজ টেলিপ্যাথির নিদর্শন হিসেবে এবং এটাও বলেন যে, যমজ টেলিপ্যাথি মানুষের জীবন বাঁচাতে পারে।

আসলে ঘটনাটি যেমন শোনাচ্ছে বা প্রকাশিত হয়েছিল, ব্যাপারটি কিন্তু তেমন নয়। লিন হাউটন নানান শারীরিক সমস্যায় ভুগছিলেন এবং গেমা সহ তার পুরো পরিবার তাকে নজরে নজরে রাখত। লিনের শারীরিক অসুস্থতার কারণে সে প্রায়শই অচেতন হয়ে যেত। সেদিন সে একা একা বাথরুমে গোসল করছিল এবং বেশ কিছুক্ষণ ধরে কোনো আওয়াজ না পাওয়ায় আশঙ্কায় গেমা ছুটে যান এবং লিনকে অচেতন অবস্থায় পান। লিনের অসুস্থতার কারণে গেমা সবসময় তাকে নিয়ে সচেতন থাকতেন, সে কারণেই গেমা সেদিন লিনের জীবন বাঁচাতে সক্ষম হন। এখানে লিনের বিপদের কথা জানার জন্য কোনো টেলিপ্যাথির দরকার নেই। তাছাড়া পরিবারের অন্য কোনো সদস্য যারা যমজ নয় তাদের বেলায়ও বিপদের আশঙ্কায় এমন ঘটনা ঘটতেই পারে। এখানে টেলিপ্যাথি কাজ করে বলা হলে তা নিছক গল্প ছাড়া আর কিছুই নয়। এক্ষেত্রে লিনের মা যদি তার জীবন বাঁচাত তাহলে হয়তো তা এতোটা রসালো গল্প হিসেবে প্রচার পেত না।

আসলে যমজ টেলিপ্যাথির ব্যাপারটা নেহায়েত গুজব ছাড়া আর কিছুই নয়। এক হিসাব অনুযায়ী, পৃথিবীতে ১০০ মিলিয়নের মতো যমজ মানুষ আছেন এবং তারা নিজেদের মধ্যে কোনোরকম রহস্যময় টেলিপ্যাথিক যোগাযোগ অনুভব করেন না। যদি সত্যিই তাদের মধ্যে এমন কোনো যোগাযোগ থাকতো তাহলে আমরা মাত্র কয়েকটি নয়, কয়েক লক্ষাধিক ঘটনা শুনতে পেতাম। প্রকৃতপক্ষে এরকম আধ্যাত্মিক ক্ষমতা বা শক্তি অথবা টেলিপ্যাথির কোনো নির্ভরযোগ্য বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পৃথিবীতে নেই। যমজ বা সাধারণ মানুষ কারো মধ্যেই টেলিপ্যাথি বা কোনো আধ্যাত্মিক ক্ষমতার নিখাদ প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি।

তথ্যসূত্র : লাইভ সায়েন্স



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৪ এপ্রিল ২০১৮/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়