ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

প্রজাপতির পাখায় উড়ে ঘুরে এলাম ভুটান: সূচনা পর্ব

শিহাব শাহরিয়ার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:২৯, ৪ এপ্রিল ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
প্রজাপতির পাখায় উড়ে ঘুরে এলাম ভুটান: সূচনা পর্ব

।। শিহাব শাহরিয়ার ।।

প্রজাপতির পাখায় উড়ে ঘুরে এলাম ভুটান। এ এক অসাধারণ আনন্দ ভ্রমণ। জীবনের এতোটুকু সাধ, এতোটুকু আনন্দের অহংকার আগেও পেয়েছি কক্সবাজার কিংবা লাঙ্কাওই কিংবা লং আইল্যান্ডে, কিন্তু পাহাড়ি বনজ বৃক্ষ, বনজ ফুল, ঝরনা, জল-পাথরের কলকল নদীর সৌন্দর্য এমন করে আর কখনো উপভোগ করিনি। আত্মজ এবং আত্মীয়সহ এই উপভোগ আরো আনন্দঘন হলো। দশ দিনের স্বল্প সময়ে এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে ছুটে যাওয়া, ঝরনার শরীরে চোখ রাখা, দূর থেকে ছুটে আসা সাদা-কালো মেঘগুলো হাত দিয়ে ধরে ফেলা, বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়া কি যে ভালো লাগল বর্ণনার বাইরে! বলা যায়, বাড়ির পাশের এই ছোট্ট পাহাড়ি দেশটি পৃথিবীর অনন্য একটি দেশ। ধুলা নেই, বালি নেই, কোলাহল নেই, কলরোল নেই, কলহ নেই, অশান্তি নেই। নির্মল, নির্জন, নিরিবিলি শুধু অবারিত সবুজে অবগাহন। বাংলাদেশের পরম বন্ধু এই দেশটি ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর প্রথম আমাদের স্বাধীনতার স্বীকৃতি দিয়েছিল। মনে পড়ল সেই কথাটিও। বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান। অনুপ্রাসের আবরণে আবদ্ধ শুধু নয়, পৃথিবীতে এই তিনটি দেশ অন্য রকম সৌন্দর্যে ভরপুর। বঙ্গোপসাগরঘেরা বাংলাদেশ, পাহাড়ি সমাবেশে ভুটান আর পাহাড়-সমুদ্র-মরুভূমি মিলিয়ে ভারত- পৃথিবীর পর্যটকদের কাছে নিশ্চয়ই সৌন্দর্যের প্রতীক।



ভুটান হিমালয় পর্বতমালার পূর্বে অবস্থিত। ভুটানকে হিমালয়-কন্যা নেপালের জায়া বলা যেতে পারে। দেশটির ইতিহাস মোটমুটি এরকম- উত্তরে চীনের তিব্বত অঞ্চল এবং দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিমে ভারত। ভুটান শব্দটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ ‘ভূ-উত্থান’ থেকে যার অর্থ ‘উঁচুভূমি’ অন্য মতে, ভুটান এসেছে ভোটস-আন্ত, অর্থাৎ ‘তিব্বতের শেষ সীমানা’ হতে, যেহেতু ভুটান তিব্বতের ঠিক দক্ষিণে অবস্থিত। ভুটান দক্ষিণ এশিয়ার একটি রাজতান্ত্রিক দেশ। ভুটানের বর্তমান রাজধানীর নাম থিম্পু। আগে রাজধানীর নাম ছিল পারো। এক সময় ভুটান পাহাড়ের উপত্যকায় অবস্থিত অনেকগুলো আলাদা আলাদা রাজ্য ছিল। ষোল শ’ শতকে একটি ধর্মীয় রাষ্ট্র হিসেবে এর আবির্ভাব ঘটে। ১৯০৭ সাল থেকে ওয়াংচুক বংশ দেশটি শাসন করে আসছেন। ১৯৫০-এর দশক পর্যন্ত ভুটান একটি বিচ্ছিন্ন দেশ ছিল। ১৯৬০-এর দশকে ভারতের কাছ থেকে অর্থনৈতিক সাহায্য নিয়ে দেশটি একটি আধুনিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হতে শুরু করে। তবে এখনও এটি বিশ্বের সবচেয়ে অনুন্নত দেশগুলোর একটি। ভুটানের অধিবাসীরা নিজেদের দেশকে মাতৃভাষা জংকা ভাষায় দ্রুক ইয়ুল বা বজ্র ড্রাগনের দেশ নামে ডাকে। ঐতিহাসিকভাবে বিভিন্ন সময়ে ভুটান বিভিন্ন নামে খ্যাত ছিলো। যেমন, লোমন বা দক্ষিণের অন্ধকারাচ্ছন্ন রাজ্য, লোসেন্দেঞ্জং বা সেন্দেন সাইপ্রেস বৃক্ষমণ্ডিত দক্ষিণের রাজ্য, লোমেন খাঝি বা দক্ষিণের রাজ্য যাতে চারটি প্রবেশ পথ রয়েছে, ও লোমেন জং বা দক্ষিণের রাজ্য যেখানে ঔষধী বৃক্ষ পাওয়া যায়।

ভুটানের প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে সেখানে প্রচলিত পৌরাণিক কাহিনির চেয়ে বেশি সুস্পষ্ট কিছু জানা যায় না। এখানে হয়ত খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দেও বসতি ছিল, তবে নবম শতকে এখানে তিব্বতি বৌদ্ধধর্মের প্রচলনের পরেই এলাকাটির সম্পর্কে আরও জানা যায়। সেসময় বহু তিব্বতি বৌদ্ধ ভিক্ষু পালিয়ে ভুটান চলে আসেন। বার শ’ শতকে এখানে দ্রুকপা কাগিউপা নামের বৌদ্ধধর্মের একটি ধারা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এটিই বর্তমানে ভুটানের বৌদ্ধধর্মের প্রধান রূপ। ভুটানের বৌদ্ধ মন্দির ও ধর্মশিক্ষালয় দেশটির রাজনৈতিক ইতিহাসের উপর সবসময় প্রভাব ফেলেছে। ১৬১৬ সালে নগাওয়ানা নামগিয়াল নামের এক তিব্বতি লামা তিনবার ভুটানের উপর তিব্বতের আক্রমণ প্রতিহত করলে ভুটান এলাকাটি একটি সংঘবদ্ধ দেশে পরিণত হতে শুরু করে। নামগিয়াল বিরোধী ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলিকে পদানত করেন, একটি ব্যাপক ও সুক্ষ্ম বিবরণসমৃদ্ধ আইন ব্যবস্থা প্রচলন করেন এবং একটি ধর্মীয় ও সিভিল প্রশাসনের উপর নিজেকে একনায়ক বা শাবদ্রুং হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর মৃত্যুর পর অন্তকোন্দল ও গৃহযুদ্ধের কারণে পরবর্তী ২০০ বছর শাবদ্রুঙের ক্ষমতা সীমিত হয়ে পড়ে। ১৮৮৫ সালে উগিয়েন ওয়াংচুক শক্ত হাতে ক্ষমতা প্রয়োগে সক্ষম হন এবং ভারতের ব্রিটিশ প্রশাসনের সাথে সখ্য গড়ে তোলেন।



১৯০৭ সালে উগিয়েন ওয়াংচুক ভুটানের রাজা নির্বাচিত হন এবং ঐ বছর ডিসেম্বরের ১৭ তারিখ সিংহাসনে আরোহণ করেন। তার উপাধি ছিল দ্রুক গিয়ালপো বা ড্রাগন রাজা। ১৯১০ সালে রাজা উগিয়েন ও ব্রিটিশ শক্তি পুনাখার চুক্তি স্বাক্ষর করে যেখানে ব্রিটিশ ভারত ভুটানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক না গলানোর প্রতিশ্রুতি দেয়। উগিয়েন ওয়াংচুক ১৯২৬ সালে মারা গেলে তার পুত্র জিগমে ওয়াংচুক পরবর্তী সময়ে শাসক হন। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা লাভের পর ভুটানকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে গণ্য করে। ১৯৪৯ সালে ভুটান ও ভারত একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে যেখানে ভুটান ভারতের কাছ থেকে বৈদেশিক সম্পর্কের ব্যাপারে পথনির্দেশনা নেবার ব্যাপারে সম্মত হয় এবং পরিবর্তে ভারত ভুটানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার প্রতিশ্রুতি দেয়। ১৯৫২ সালে জিগমে ওয়াংচুকের ছেলে জিগমে দর্জি ওয়াংচুক ক্ষমতায় আসেন। তাঁর আমলে ভুটান পরিকল্পিত উন্নয়নের পথে এগোতে থাকে এবং ১৯৭১ সালে জাতিসংঘের একটি সদস্য রাষ্ট্রে পরিণত হয়। তাঁর সময়েই ভুটানে একটি জাতীয় সংসদ, নতুন আইন ব্যবস্থা, রাজকীয় ভুটানি সেনাবাহিনী এবং একটি উচ্চ আদালত প্রতিষ্ঠা করা হয়।

১৯৭২ সালে ১৬ বছর বয়সে জিগমে সিঙিয়ে ওয়াংচুক ক্ষমতায় আসেন। তিনি আধুনিক শিক্ষা, সরকারের বিকেন্দ্রীকরণ, জলবিদ্যুৎ উৎপাদন, পর্যটন এবং পল্লী উন্নয়নের মতো ব্যাপারগুলোর ওপর জোর দেন। তিনি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের পাশাপাশি জনগণের সামগ্রিক সুখের একজন প্রবক্তা; উন্নয়ন সম্পর্কে তাঁর দর্শন কিছুটা ভিন্ন এবং এই ভিন্নতার কারণে তিনি আন্তর্জাতিক পরিচিত পেয়েছেন। তার আমলে ধীরে ধীরে ভুটান গণতন্ত্রায়নের পথে এগোতে থাকে। ২০০৬ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি রাজার পদ ছেড়ে দেন এবং তাঁর ছেলে খেসার নামগিয়েল ওয়াংচুক ভুটানের রাজা হন। ২০০৮ সালের ১৮ই জুলাই ভুটানের সংসদ একটি নতুন সংবিধান গ্রহণ করে। এই ঐতিহাসিক দিন থেকে ভুটানে পরম রাজতন্ত্রের সমাপ্তি ঘটে এবং ভুটান একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্র ও সংসদীয় গণতন্ত্রে পরিণত হয়। ভুটান হলো একটি রাজতন্ত্র বিশিষ্ট দেশ। এখানে বর্তমানে রাজতন্ত্র বিদ্যমান। ভুটানে অতীতে একটি পরম রাজতন্ত্র প্রচলিত ছিল। বর্তমানে এটি একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্র। ভুটানের রাজা, যার উপাধি ড্রাগন রাজা হলেন রাষ্ট্রের প্রধান। মন্ত্রীদের একটি কাউন্সিল রাষ্ট্রের নির্বাহী কার্য পরিচালনা করে। সরকার ও জাতীয় সংসদ উভয়ের হাতে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা ন্যস্ত। এছাড়াও যে খেনপো উপাধিবিশিষ্ট দেশের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা রাজার সবচেয়ে কাছের পরামর্শদাতার একজন। ২০০৭ সালে একটি রাজকীয় আদেশবলে রাজনৈতিক দল নির্মাণের উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে দেওয়া হয়। বর্তমান সংবিধানে দেশটিতে একটি দুই-দলবিশিষ্ট গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নির্মাণের কথা বলা হয়েছে। জিগমে খেসার নামগিয়াল ওয়াংচুক বর্তমানে ভুটানের রাজা।



ভুটানের আয়তন ৪৬,৫০০ বর্গকিলোমিটার। থিম্পু এর রাজধানী শহর এবং এটি দেশের মধ্য-পশ্চিম অংশে অবস্থিত। অন্যান্য শহরের মধ্যে পারো, ফোয়েন্ডশোলিং, পুনাখা, চোঝুম, টিসিমাশা ও বুমথং উল্লেখযোগ্য। ভুটানের ভূপ্রকৃতি পর্বতময়। উত্তরে সুউচ্চ হিমালয় পর্বতমালা, মধ্য ও দক্ষিণভাগে নিচু পাহাড় ও মালভূমি এবং দক্ষিণ প্রান্তসীমায় সামান্য কিছু সাভানা তৃণভূমি ও সমভূমি আছে। মধ্যভাগের মালভূমির মধ্যকার উপত্যকাগুলোতেই বেশিরভাগ লোকের বাস। ভুটানের জলবায়ু উত্তরে আল্পীয়, মধ্যে নাতিশীতোষ্ণ এবং দক্ষিণে উপক্রান্তীয়; জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে বৃষ্টিপাত হয়। স্থলবেষ্টিত দেশ ভুটানের আকার, আকৃতি ও পার্বত্য ভূ-প্রকৃতি সুইজারল্যান্ডের সদৃশ বলে দেশটিকে অনেক সময় এশিয়ার সুইজারল্যান্ড ডাকা হয়। বহির্বিশ্ব থেকে বহুদিন বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে ভুটান প্রাণী ও উদ্ভিদের এক অভয়ারণ্য। এখানে বহু হাজার দুর্লভ প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদ দেখতে পাওয়া যায়। ভুটানের প্রায় ৭০ শতাংশ এলাকা অরণ্যাবৃত। এই অরণ্যই ভুটানের জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষিত করে চলেছে যুগ যুগ ধরে।

০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭ তারিখ রাতে স্ত্রী শামীমা হক, দুই পুত্র প্রাচুর্য শাহরিয়ার, সমৃদ্ধ শাহরিয়ার ও আরো ১৬ জন স্বজনকে সঙ্গে নিয়ে সড়ক পথে ভুটানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। স্বজনরা হলেন ফররুখ আহমেদ, আমাতুর রহিম ফাতিমা, তাহমিদ আহমেদ, ফারিবা নুসরাত, মাসুদ আহমেদ, সুমনা আহমেদ, উপমা, নোবা, তাসনিয়া, নিভৃতা, নূরু, সারা, শেফালি ও আলমগীর ভাই। রাত আটটায় ঢাকার কল্যাণপুর থেকে প্রথমে যাত্রা করলাম বুড়িমারী সীমান্তের দিকে। লালমনিরহাট, পাটগ্রাম হয়ে ভোরে গিয়ে নামলাম বুড়িমারী। তখন সূর্য ওঠেনি। সারারাত সড়ক পথে যাত্রার ক্লান্তি সবার চোখে-মুখে। সকাল ন’টার আগে ইমিগ্রেশন খোলে না, তাই সীমান্তের নির্জন পরিবেশে হেটে, বসে সময় পার করতে থাকলাম। মজার ব্যাপার বুড়িমারীতেই আছে বুড়ির খাবার হোটেল। টিউবওয়েলের পানিতে হাত-মুখ ধুয়ে খেতে গেলাম বুড়ির হোটেলে। সে এক অন্য রকম ঘটনা। খুব সকাল বেলা গরম ভাত, মুরগির মাংস, আলু ভর্তা, ডাল ইত্যাদি খাবার খেলাম পেটভরে। তারপর ধীরে ধীরে এগোলাম ইমিগ্রেশনের দিকে। চোখে পড়ল কাঁটাতারের বেড়া। দু’দিকেই ধানখেত, ঘরবাড়ি অথচ মাঝখানে কাঁটাতার! আমি এই প্রথম এই সীমান্ত দিয়ে পার হয়ে ভারতে ঢুকছি। তেমন কোনো উন্নতির লক্ষণই চোখে পড়ছে না, খুবই নিম্নমানের সীমান্ত পারাপার ব্যবস্থা। সরকারি কর্মকর্তা বলে আমাকে এবং আমাদেরকে বেশ সমীহ করল বাংলাদেশ সীমান্তের ইমিগ্রেশন ও কাস্টমসের লোকজন। শুধু দুই কদম, তারপরেই আরেক দেশ। প্রবেশ করলাম। ইমিগ্রেশন হলো ও পারেও। ওই পার মানে ভারতের কোচবিহার।
(চলবে)




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৪ এপ্রিল ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়