ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

প্রজাপতির পাখায় উড়ে ঘুরে এলাম ভুটান : চতুর্থ পর্ব

শিহাব শাহরিয়ার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:০৩, ১ মে ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
প্রজাপতির পাখায় উড়ে ঘুরে এলাম ভুটান : চতুর্থ পর্ব

শিহাব শাহরিয়ার : পুনাখার রস পান শেষে আরেকটি মিষ্টি রোদের দঙ্গল পেরিয়ে রওয়ানা করলাম পারোর দিকে। পারো ভুটানের পূর্বের রাজধানী। এটিও একটি উল্লেখযোগ্য শহর। এখানে বিভিন্ন পবিত্র স্থান এবং ঐতিহাসিক স্থাপনা ছড়িয়ে আছে। এখানেই ভুটানের একমাত্র বিমানবন্দর পারো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর অবস্থিত। গাইড গাড়ি চালাতে চালাতে বর্ণনা করছেন পারোর কিছুটা ইতিহাস। ওর কথা শেষে যা দাঁড়াল, তাহলো: পারো উপত্যকার দুর্গ আশ্রম রিনপুং ডিজং-এর এক দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে।

দশম শতকের শুরুতে এই স্থানে পদ্মসম্ভব প্রথম একটি আশ্রম স্থাপন করেন। ১৬৪৪ সালে পুরনো ভিত্তির উপর ভুটান একটি বড় আশ্রম নির্মাণ করে। শতাব্দীব্যাপী এই পাঁচতলা ভবনটি তিব্বতীয়দের বহুবিধ আক্রমণ থেকে কার্যকর সুরক্ষা দিয়েছে। কাদামাটির পরিবর্তে প্রস্তর দিয়ে গড়া এই ডিজং-এর নাম রাখা হয়েছে রিনপুং যার অর্থ ‘রত্নের স্তুপ’। কিন্তু ১৯০৭ সালে অগ্নিকাণ্ডে রিনপুং এর ‘থংদেল’ নামক একটি তলায় অঙ্কিত চিত্র ব্যতীত সব সম্পদ ধ্বংস হয়ে যায়। অগ্নিকাণ্ডের পর এটি পুনরায় নির্মাণ করা হয়। এর দেয়ালগুলো পবিত্র মুখোশ ও পরিচ্ছদে সুশোভিত। কয়েক শতক আগে দাওয়া পেঞ্জর অন্যদের সাহায্য করেছিল, আর তার উত্তরসূরি পেনলপৎশেরিং অধুনা এই কাজ করেন। ডিজং পর্বতের উপরে একটি প্রাচীন পর্যবেক্ষণ কক্ষ রয়েছে যা ১৯৬৭ সাল থেকে ভুটানের জাতীয় জাদুঘর হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। পাহাড়ের উপরে গ্রেগর থানবিচলের সৌধ ও প্রতিকৃতি আছে, যিনি ১৯৯৫ সালে ক্ষমতা লাভ করেছিলেন। ডিজং-এর নিচে একটি মধ্যযুগীয় সেতু বরাবর পেনলপৎশেরিং পেঞ্জর-এর রাজকীয় ভবন ‘আগয়েন পেলরি প্রাসাদ’ অবস্থিত। মূল সড়কের পাশে ছোট ছোট দোকান, প্রতিষ্ঠান, রেস্তোরাঁ প্রভৃতির ঐতিহ্যবাহী একটি পাড়া দেখা যায়।



নতুন সেতুর কাছে ১৫ শতকের একটি পুরনো মন্দির দুংৎসে হাখাং রয়েছে, এর বেড়া থেকেই উগায়েন পেরলি প্রাসাদ দেখা যায়। রাজপরিবারের সদস্যরা এখানে থাকেন। কাছেই একটি পুরনো সেতু আছে। উল্লেখযোগ্য হোটেলগুলোর মধ্যে ওলাথাং হোটেলটি বেশ সুসজ্জিত। পারোর ১০ কিলোমিটার বা ৬ মাইল দূরে বিখ্যাত ও পবিত্র তাকস্থাং অর্থাৎ বাঘের বাড়ি আশ্রম রয়েছে। এটি প্রায় এক হাজার মিটার অর্থাৎ ৩২৮১ ফুট খাড়া উঁচু পর্বতঢালে অবস্থিত। এই স্থানটি ভুটানীয়দের নিকট খুব পবিত্র। তারা বিশ্বাস করে ভুটানের বৌদ্ধধর্মের জনক গুরু রিনপোচ বা পদ্মসম্ভব ব্যাঘ্রপৃষ্ঠে এখানে এসেছিলেন। বাঘের বাড়ি ভ্রমণ করতে সোজা পথে প্রায় তিন ঘণ্টা লাগে। বাঘের বাড়ি থেকে পারো শহরের সৌন্দর্য দেখা যায়। এর ১৬ কিলোমিটার অর্থাৎ ১০ মাইল দূরে আরেকটি দুর্গআশ্রম দ্রুকয়েল ডিজং-এর ধ্বংসাবশেষ পর্যন্ত একটি রাস্তা গেছে, যেটি ১৯৫১ সালে অগ্নিকাণ্ডে আংশিক ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। পারো বিমানবন্দরকে পৃথিবীর সবচেয়ে সংকটপূর্ণ বাণিজ্যিক বিমানবন্দর বলা হয়। এর মাত্র একটি রানওয়ে আছে। উড়োজাহাজকে এপ্রোচে ৫৫০০ মিটার হিমালয় পর্বতশৃঙ্গ পার হয়ে ১৯৮০ মিটার রানওয়ে দিয়ে যেতে হয়। এলাকাটির গড় উচ্চতা অত্যন্ত মাত্রায় কম হওয়ায় এর প্রতিকূলতা দ্বিগুণ কঠিন। ফলে মুষ্টিমেয়সংখ্যক বৈমানিক এখানে উড়োজাহাজ চালানোর অনুমতি পান। যেমন- ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে মাত্র ৮ জন অনুমতি পেয়েছেন। প্রতি বছর প্রায় ৩০,০০০ যাত্রী এই বিমানবন্দরে এসে পৌঁছায়।



বিমানের কথা বলতে বলতেই আমরা এসে পড়লাম পারোর প্রাণকেন্দ্রে। এ আরেক সুন্দর জায়গা। এখানেও শহরের মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে একটি নদী। নাম পারসু রিভার। নদীটি শহরটিকে নান্দনিক করে তুলেছে। সারাক্ষণ জলের সুর-শব্দ। আমার কাছে নদী ভালো লাগে। নদী মনকে উদার করে, হালকা করে। নদীর পাড় ধরেই যেতে লাগলাম। তারপর ওয়েংডি ঝুলন্ত একটি ব্রিজ দিয়ে নদীর অপর পাড়ে নিয়ে গেলেন। ধীরে ধীরে উপরের দিকে উঠতে থাকল তার গাড়ি। এক সময় এসে থামল। যেখানে থামল তার নাম টাউনভিউ রিসোর্ট। নদী তীরবর্তী এই রিসোর্টটি অত্যন্ত সুন্দর। খোলামেলা, বাগানবেষ্টিত, পরিচ্ছন্ন- এক কথায় চমৎকার। খুব পছন্দ হলো দুই দিনের নিবাসের জন্য। আমাদের এই রিসোর্টটির পাশেই ভুটানের জাতীয় জাদুঘর। কাঠের পাটাতন দিয়ে প্রতিটি কক্ষ, বারান্দা-জানালাশোভিত দারুণ একটি রিসোর্ট; ভাড়াও তুলনামূলক কম। বারান্দায় দাঁড়ালেই সামনে নদী, বিস্তীর্ণ পাহাড়ভূমি আর পারো শহরের প্রায় পুরোটাই দেখা যায়। সময়টাও সুন্দর- হালকা শীত। দারুণ আবহাওয়া। আসলে বিদেশে থাকা ও খাওয়াটা ভালো না হলো, ভ্রমণে আনন্দ পাওয়া যায় না। পারোতে এসে এই অভাব দূর হলো। এই রিসোর্টেই খাবার ভালো ব্যবস্থা রয়েছে। সুতরাং ঘুরে বেড়ানো।



পরদিন সকালের রোদ আছড়ে পড়ল আমাদের কক্ষের জানালায়। ঘুম থেকে ওঠে জানালা দিয়ে তাকালাম দূর পাহাড়ের দিকে। মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নিয়ে ভাবলাম কিছুকাল না হয় থেকে যাই এইখানে- এই এমন মনোরম পরিবেশে। সবাই তৈরি হয়ে নাস্তা সেরে প্রথমেই গেলাম ভুটানের জাতীয় জাদুঘরে। আমাদের রিসোর্ট থেকে জাদুঘরটি খুবই কাছে। ছোট্ট জাদুঘর। মাত্র কয়েকটি গ্যালারি। গ্যালারিগুলোতে পাহাড়ি দেশ ভুটানের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং প্রাকৃতিক সম্পদের নানামাত্রিক নিদর্শন প্রদর্শিত পাচ্ছে। দর্শকরা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। আমরা সময় নিয়ে দেখে বেরিয়ে পড়লাম। গাড়িতে ওঠার পর ওয়েংডি আমাদের নিয়ে চলল শহর বেয়ে পারো বিমান বন্দরের দিকে। বিমান বন্দরটি দেখার জন্য একটি ভিউপয়েন্ট আছে। আমরা সেখানে গেলাম। দর্শক বা পর্যটকরা এখানে দাঁড়িয়েই ছোট্ট বিমান বন্দরটির নান্দনিক দৃশ্য উপভোগ করে। আসলে বিমান বন্দর দেখার তো কিছু নেই, এখানে দেখার একটিই বিষয়, সেটি হলো, পাহাড়ের পাদদেশে পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট বিমান বন্দরের একটি, যার চতুর্দিকে পাহাড়ের সবুজ উপত্যকাজুড়ে বাড়ি-ঘর, এক পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে পাহাড়ি খরস্রোতা পাথর সংবলিত স্বচ্ছ জলের নদী- তার মাঝখানে এই বিমান বন্দরটি।  এখানে কোনো আন্তর্জাতিক বিমান যাতায়াত করে না, কেবল ঢাকা থেকে এখানে বিমান যাতায়াত করে। বিমানগুলোও ছোট ছোট। তো সেই ভিউপয়েন্টে সবাই দাঁড়িয়ে ছবি উঠালাম আর দেখলাম অসম্ভব সুন্দর দৃশ্য।



এরপর বেরিয়ে পড়লাম অজানা পাহাড়ের চূড়ার উদ্দেশ্যে। এই পাহাড়টির নাম চেলালাপাস। এটিই ভুটানের সর্বোচ্চ পাহাড়। উচ্চতা ৩ হাজার ৯ শত আটাশি মিটার। উপরের দিকে যাচ্ছি আর মনে হচ্ছে যেন ইতোমধ্যে পাহাড়ের সাথে আমাদের একটি সখ্য গড়ে উঠেছে। সেই একই আঁকাবাঁকা, উঁচুনিচু পথ বেয়ে গাড়ির ছুটে চলা। রাস্তার পাশেই আপেল বাগানগুলো আমাদের সকলকেই খুব নাড়াচ্ছে। দেখতে খুব ভালো লাগছে। আর কত ধরনের যে, ফুল আর গাছ-গাছালি, তা হিসেব করবে কে? কয়েক ঘণ্টা পেরিয়ে উঠলাম শীর্ষ পাহাড়ে। খুব ঠাণ্ডা এখানে, বাতাসে গা শিরশির করছে। সবাই মোটা জামাকাপড় পরে ঘুরতে লাগলাম। দেখলাম অনেকগুলো গরু চড়ে বেড়াচ্ছে, উঁচুনিচু জায়গায় হেঁটে হেঁটে ঘাস খাচ্ছে, তবে প্রত্যেকটি গরুর গলায় ঘণ্টি পরানো। আর দেখলাম ছোট ছোট পতাকার মতো সাদা ও রঙিন কাপড় দীর্ঘ রশিতে লাগানো আছে। শুনলাম, যেখানে এগুলো টানানো আছে, সেখানে মৃতদের লাশ পুড়ানো হয়। এরকম সারা ভুটানজুড়েই রয়েছে- কিছু জায়গা পরে পরেই। আমরা তাকালাম পূর্ব-উত্তর দিকে। ওয়েংডি জানালো, ওই দিকেই হিমালয়। হিমালয়ে হয়তো আর কোনদিন যাওয়া হবে না, ওঠা হবে না। মনে পড়ল ফিদেল কাস্ত্রোর সেই উক্তিটি- ‘আমি হিমালয় দেখেনি কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি’। তাহলে হিমালয় কত উঁচু, শেখ মুজিবও কত উঁচু! তারপর আমরা তাকালাম নিচে, দূরের শহরের দিকে, সে এক অন্যরকম দৃশ্য। কখনো রোদ, কখনো মেঘ এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে আমাদেরকে। প্রকৃতি আর নিসর্গ মানুষকে যে আবেগায়িত করে, তার প্রমাণ এখানে এসে আবারো পেলাম। যেন মন কবিতার মতো বার বার উড়ছে- আহা! (চলবে)



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১ মে ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়