ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

কাশ্মিরের দিনরাত্রী ১

জম্মুতে রাত পোহালো

ছাইফুল ইসলাম মাছুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:২০, ১৪ মে ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
জম্মুতে রাত পোহালো

ছাইফুল ইসলাম মাছুম : দিল্লী থেকে দ্রুতগামী ট্রেনটি যখন পৌঁছালো জম্মু রেল স্টেশনে তখন পুবের আকাশটা বেশ পরিচ্ছন্ন দেখাচ্ছিল। বাংলাদেশ থেকে যাত্রা করে বাস, প্লেন ও ট্রেনে দীর্ঘ ৩৬ ঘণ্টার জার্নির পর আমাদের মূল গন্তব্য জন্মুর মাটিতে পা রাখলাম। ১২ মার্চ যখন ভারতীয় ভিসা হাতে পেয়ে নিশ্চিত হলাম আমরা জম্মু বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় আন্তর্জাতিক বিজনেস আইডিয়া প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছি, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান স্যারের সাথে সাক্ষাত করে আমাদের বাংলাদেশ টিমের ছয় সদস্য। ঐ দিন রাত ১০টায় দেশ ট্রাভেলে করে আমাদের যাত্রা শুরু হয়। যদিও ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে পৃথিবীকে জানিয়ে দিয়েছিলাম আমরা জম্মু কাশ্মির যাচ্ছি। তারপরও গাড়িতে বসে অনেককে ফোনে আবার বিষয়টি জানালাম।

ভিসা পাওয়ার আগে যেমন উৎকণ্ঠা কাজ করছিল, ভিসা পাবো তো? গাড়িতে উঠেও কেমন ভয় ভয় করছিল! অবশেষে ভারতের মাটিতে পা রাখতে পারবো তো? ভয় আরো বাড়লো, যখন পাটুরিয়া ফেরি ঘাটের কাছে এসে দীর্ঘ তিন কিলোমিটার জ্যামে আটকা পড়লো আমাদের গাড়ি। দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করেও জ্যাম ছাড়ার সম্ভাবনা না দেখে টিম লিডার আহসান রনি ভাইয়ের সিদ্ধান্তে আমরা বাস থেকে নেমে পড়ি। কোন কারণে সময় মত পৌঁছতে না পারলে আমাদের ভারত সফরের পুরো পরিকল্পনা পাল্টে যাবে। কারণ আগে থেকেই নির্ধারিত সময় বেঁধে ভারতের প্লেন ও ট্রেনের টিকেট কেটে রেখেছি। রিকশায় ফেরী ঘাটের কাছে গিয়ে খুব অনুরোধ করে অন্য একটি এসি গাড়িতে ওঠার সুযোগ হয়। আর এভাবেই ১৩ মার্চ খুব ভোরে আমরা যশোরের বেনাপোল সীমান্ত বন্দরে গিয়ে পৌঁছি।

 



সীমান্ত বন্দরে দালাল, ফটকাবাজ, ব্যবসায়ী নানা ধরনের লোকের আনাগোনা। কাগজপত্র জমা দিয়ে কাজ সেরে আমরা হেঁটেই পার হলাম বাংলাদেশ ভারতের সীমানা। ভারতের কলকাতা অংশে পা রেখে প্রথমে ভিন দেশ মনে হয়নি, কারণ মানুষের মুখে বাংলা কথা, সাইন বোর্ডে বাংলা লেখা, দেখতেও দেশি মানুষের মতোই। বেনাপোলের কলকাতা অংশে এসে প্রথমে আমাদের কাছে থাকা নগদ বাংলাদেশি টাকাগুলো রুপিতে রুপান্তর করি। বাঙালি খাবার ডাল ভাত মাছে সেরে নিই সকালের খাবার। বেলা ১১টা নাগাদ আমরা একটি মাইক্রোবাস ভাড়া নিয়ে কলকাতা নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি।

বিকালে বিমান বন্দরে প্রবেশ করে একটা ভিনদেশী ভাব পেলাম। বিমান বন্দরটি আধুনিক কাঠামোতে বেশ পরিপাটি গোছানো। এটি পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতা শহর থেকে ১৭ কিলোমিটার দূরে। এর দুইটি সমান্তরাল রানওয়ে আছে। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন বিশিষ্ট নেতা নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর নামে এই বিমানবন্দরের নামকরণ করা হয়েছে। আগে এটি ‘দমদম বিমানবন্দর’ নামে পরিচিত ছিল। কলকাতা বিমানবন্দরে আমাদের সাথে যুক্ত হলেন আরেক টিম মেম্বার ঢাকা এফএম-এর আরজে শান্ত। তিনি প্লেনে ঢাকা থেকে এসেছিলেন। শেষ বিকালে বিসতারা বিমানে আমরা যাত্রা শুরু করলাম ভারতের রাজধানী দিল্লীর উদ্দেশ্যে। বিমানে উঠে বেশ রোমাঞ্চ অনুভব করলাম, এই প্রথম আমার বিমানে চড়ার অভিজ্ঞতা। আকাশ থেকে মাটির পৃথিবী দেখার অভিজ্ঞতা। বিমানে ভিন দেশের হরেক রকমের মানুষের পাশে বসার অভিজ্ঞতা। আমার পাশের সিটে ছিল পাঞ্জাবের অধিবাসী কলেজপড়ুয়া বিশাল। বাবার ব্যবসার কারণে সে কলকাতার একটি কলেজে পড়ছেন। তার সাথে কথা বলে বেশ মজা পেলাম, বিশাল সাতটি ভাষায় কথা বলতে পারে, তার মধ্যে ইংরেজি, হিন্দি ও পাঞ্জাবি ভাষায় লিখতে পারে। বিশালের সাথে কথা বলে মনে হয়েছে, সে বেশ রাজনীতি সচেতন, ইন্ডিয়ান ও বিশ্ব রাজনীতি সম্পর্কে বেশ ধারণা রাখে। বাংলাদেশ সম্পর্কেও তার জানাশোনা আছে। বিশাল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমের সদস্যদের নিয়ে কথা বলেছে, জানতে চেয়েছে।

 



কলকাতা টু দিল্লী বিমানভ্রমণ বেশ আরামদায়ক ছিল। বিসতারা পরিবেশিত রাতের খাবারটা বিমানে সেরেছি। সাড়ে তিন ঘণ্টা বিমান জার্নি শেষে ইন্ধিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমেছি যখন তখন রাত সাড়ে নয়টা। বিমানবন্দর থেকে প্রিপেইড ট্যাক্সিক্যাব নিয়ে আমরা ছুটলাম রেল স্টেশনের দিকে, কারণ জম্মুগামী সাড়ে দশটার ট্রেন আমাদের ধরতে হবে। যেহেতু অনলাইনে আগেই টিকেট কাটা ছিল, তাই মিস করলে পুরো টাকা লস হবে। ট্যাক্সিক্যাবে বসে স্বল্প সময়ে দেখার সুযোগ হয়েছিল দিল্লীর অসম্ভব সুন্দর অচেনা রূপ! এত বড় শহর, তবু তেমন জ্যাম চোখে পড়েনি, সবাই ট্রাফিক সিগনাল বেশ মেনে চলছেন। সময়ের একটু আগেই আমরা ট্রেন ধরতে পেরেছি। ট্রেনের সিটগুলো ভিন্ন ধরনের, বাংলাদেশের ট্রেনের সিটের মতো নয়। এই সিটে বসে শুয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা আছে। ট্রেনের ভিতরের দৃশ্য একটু চেনা চেনা মনে হচ্ছিল, এমন দৃশ্য হিন্দি সিনেমা ‘বজরঙ্গি ভাইজান’-এ দেখেছি। সবাই বসে ঘুমিয়ে, গল্প করে, আরাম করেই যাচ্ছিলেন। আমরা রেলের হকারদের থেকে ভাজাপোড়া খেয়েই কোন রকম সেরেছি রাতের খাবার। আমাদের সিট পড়েছিল শিখ ধর্মালম্বী এক পাঞ্জাবি পরিবারের সাথে। আমাদের বাংলাদেশ টিমের সদস্যরা থোড়া থোড়া হিন্দি ভাষায় বেশ গল্প করছিলেন। বাংলাদেশে থেকে যাত্রার পর থেকে প্রচণ্ড গরমের মধ্য দিয়ে আসলেও, আমাদের ট্রেন রাতের নীরবতা ভেদ করে যতোই জম্মুর কাছাকাছি যাচ্ছিল, ততই আমরা শীত অনুভব করতে লাগলাম।

ট্রেনটি যখন জম্মুতে প্রবেশ করলো, তখন উঁচু নিচু পাহাড়ের ফাঁকে ভোরের আলো একটু একটু উকিঁ দিচ্ছিল। ট্রেনের জানালা দিয়েই চোখে পড়ছিল জম্মুর পরিবেশ। অনেক নারী-পুরুষকে খোলা মাঠে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে দেখলাম। এই অঞ্চলের মানুষগুলো বেশ সুন্দর ও পরিপাটি হলেও যত্রতত্র ময়লার স্তূপ চোখে পড়ল। জম্মু ভারতের জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের বৃহত্তম শহর এবং রাজ্যটির শীতকালীন রাজধানী। জম্মু শহরটি তাউই নদীর তীরে অবস্থিত। ১৪ মার্চ জম্মু রেলস্টেশনে নেমে আমাদের টিম মেম্বারের দীর্ঘ জার্নির পরও সবার মুখে জয়ের হাসি। দীর্ঘ জার্নিতে কারো চেহারায় একটু ক্লান্তি নেই, গন্তব্যে পৌঁছার আনন্দে সবাই অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে। আমরা ছুটলাম আমাদের জন্য জম্মু ইউনিভার্সিটি কর্তৃক নির্ধারিত হোটেল কালিকাধামে। ফ্রেশ হয়ে, সকালের নাস্তা সেরে আবার ছুটতে হবে জম্মু বিশ্ববিদ্যালয়ে, সেখানে ১১টা থেকে তৃতীয় আন্তর্জাতিক বিজনেস আইডিয়া প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে হবে।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ মে ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়