ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

কাশ্মীরের দিনরাত্রী-৩

স্বর্গীয় গ্রাম পেহেলগাম

ছাইফুল ইসলাম মাছুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:০১, ২২ মে ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
স্বর্গীয় গ্রাম পেহেলগাম

ছাইফুল ইসলাম মাছুম: ‘যখন তোমরা কাশ্মিরের দিকে অগ্রসর হবে, তখন উল্টো দিকের বাতাস তোমাদের স্বাগত জানাবে।’ জম্মু বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচয় হওয়া কাশ্মির বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রবন্ধু আতিব মোহাম্মদ বলেছিলেন কথাটি। ১৭ মার্চ জম্মু ছেড়ে আমাদের বহন করা মাইক্রোবাস (স্থানীয় নাম ইনোরা) যখন পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে এগিয়ে চলছিল, তখন উল্টো দিকের সতেজ বাতাস সত্যিই প্রাণ ছুঁয়ে যাচ্ছিল।

জম্মু থেকে কাশ্মীর যাওয়ার পথে সারি সারি পাহাড়ের গাঁ বেয়ে ঝকঝকে আঁকাবাঁকা রাস্তা। রয়েছে বেশ কিছু টানেল, পাহাড়ের বুক চিরে টানেল হয়ে আমাদের গাড়ি দ্রুত গতিতে ছুটছিল, গাড়িতে চলছিল খাটি কাশ্মীরি গান। রাস্তার কিছু অংশ একেঁবেঁকে উঠে গেছে পাহাড়ের উপরে। আকাশ ছোঁয়া পাহাড়ি রাস্তা থেকে আমরা দেখছিলাম নিচু ও সমতল এলাকার ভবনগুলো, উঁচু-নিচু পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে মানুষের বসতি। পাহাড়ের বুক চিরে নেমে আসা ছোট বড় ঝরনাধারা। দেখছিলাম দূরের লাল পাহাড়, পাথুরে পাহাড় আর পাহাড়ের চূড়ায় চূড়ায় মন্দিরের মিনার।
 


আমাদের গাড়ির ড্রাইভার রনজিৎ সিংহ। আট বছর ধরে জম্মু টু কাশ্মীর রুটে মাইক্রো গাড়ি চালান। তিনি হিন্দি কাশ্মীরি মিশিয়ে কথা বলেন। তার কথা বুঝতে সমস্যা হওয়ায়, ইশারা ইঙ্গিতে কথা হচ্ছিল তার সাথে। তিনি তথ্য দিলেন, সড়ক পথে জম্মু থেকে কাশ্মীরের শ্রীনগরের দূরত্ব ৩২২ কিলোমিটার। গাড়িতে সাত ঘণ্টা সময় লাগে, অন্য প্রতিকূলতা থাকলে ১০-১২ ঘণ্টাও লেগে যেতে পারে।

দীর্ঘ বাস ভ্রমণের মাঝে আমাদের জন্য চমক ছিল এশিয়া মহাদেশের সবচেয়ে বড় টানেল দেখার সুযোগ। এই টানেলটি জম্মু থেকে কাশ্মির যাওয়ার পথে পড়ে। ২০১৭ সালে টানেলের উদ্বোধন করেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ১০.৯ কিলোমিটারের চেনানি-নাশরি টানেলটি এশিয়া মহাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বড় মহাসড়ক টানেল। এই টানেলটি চালু করার ফলে জম্মু-শ্রীনগর মহাসড়কের চেনানি শহর থেকে নাশরি শহর পর্যন্ত দূরত্ব প্রায় ৩০ কিলোমিটার কমেছে। আগের ৪১ কিলোমিটার সড়ক দূরত্বের জায়গায় বর্তমান দূরত্ব দাঁড়িয়েছে প্রায় ১১ কিলোমিটার। এতে জম্মু থেকে শ্রীনগর ভ্রমণের সময়ও দুই ঘণ্টা কমেছে। টানেলটি নির্মাণে সাত বছর সময় লেগেছ আর ব্যয় হয়েছে তিন হাজার ৭০০ কোটি রুপি।
 


টানেলটি অতিক্রম করার সময় দারুণ অনুভূতি হলো, এশিয়ার সবচেয়ে বড় টানেলে মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। আমাদের টিম মেম্বারেরা ভিডিও করছিল টানেল পার হওয়ার চমৎকার মুহূর্তটি ধারণ করে রাখার জন্য। টানেল পার হওয়ার পর চোখে পড়লো দূর পাহাড়ের চূড়ায় মুক্তার দানার মতো ছড়ানো বরফ কণা। আর অনুভব করছিলাম দূর পাহাড় থেকে বয়ে আসা হিমেল হাওয়া। বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আমাদের গাড়ি ছুটে চলছে। আমাদের গন্তব্য সরাসরি শ্রীনগর নয়, শ্রীনগর থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরত্বে স্বর্গীয় উপত্যকা খ্যাত কাশ্মীরের স্বর্গীয় গ্রাম পেহেলগাম। পথে পথে ভারতীয় সেনা বাহিনীর চেক পোস্ট চোখে পড়ছিল, তারা সতর্কতার সাথে অস্ত্র নিয়ে সজ্জিত।

যতই পেহেলগামের নিকটবর্তী হচ্ছি ততই প্রচণ্ড শীত আমাদের জেঁকে ধরছিল। টাইটানিক ভিউ পয়েন্টে আমাদের গাড়িটি থামলো। এখানে একটি টং দোকানে জ্যাকেট, পশমের কান টুপি, হাত মোজাসহ শীতের পোশাক বিক্রি হচ্ছিল। ভাবছি যে সময়ে ঢাকার মানুষ গরমে সিদ্ধ হচ্ছে, ঠিক সে সময়ে প্রচণ্ড শীতে কাশ্মীরে আমরা শীতের পোশাক কিনতে বাধ্য হচ্ছি। আমি চারশ রুপি দিয়ে হাঁটু সমান বড় শীতের জ্যাকেট কিনলাম, পশমের কানটুপি কিনলাম একশ রুপি দিয়ে, একশ রুপি দিয়ে কিনলাম হাত মোজা। আমাদের টিম মেম্বাররা যারা বাংলাদেশ থেকে শীতের পোশাক এনেছিল, তারাও এখানে নতুন করে পোশাক কিনল, কারণ বাংলাদেশের শীতের পোশাক দিয়ে কাশ্মীরের শীত ঠেকানো অসম্ভব।
 


পেহেলগামের দিনের তাপমাত্রা ৯ কিংবা ১০ ডিগ্রি থাকলেও রাতের তাপমাত্রা আরো কমে যায়। অনেক সময় শূন্য ডিগ্রিতে নেমে আসে। নতুন কেনা শীতের পোশাক জড়িয়ে আমরা ছুটছি পেহেলগামের পথে। আমাদের গন্তব্য পেহেলগামের আইসবার্গ হোটেল। যেখানে আমরা রাত্রী যাপন করবো। রাত নয়টার সময় আমরা হোটেল আইসবার্গ খুঁজে পেলাম। আইসবার্গের দ্বায়িত্বরত কর্মীরা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। হোটেলে প্রবেশ করে ভাবলাম, একটু গোসল করে ফ্রেশ হয়ে নেই, কিন্তু এত বেশি ঠাণ্ডা যে, গোসল করার সাহস পেলাম না। পানিতে মাথা একটু ভেজাতেই মাথা জমে গেল। আমি যখন মাথা ভিজিয়ে বিপদে পড়লাম, টিমের অন্যরা তখন ফেসবুক ওপেন করার জন্য ওয়াইফাই খুঁজছে। আমরা যে পেহেলগামে- এটা সবাইকে জানাতে হবে না!
 


আসইবার্গ হোটেলটি কাঠের তৈরি দ্বিতল ভবন। শৈল্পিক কারুকাজ আর প্রযুক্তির ব্যবহারে রাজকীয় একটা ভাব আছে। বিছানায় ব্যবহার করা হয়েছে বিশেষ বৈদ্যুতিক হিটার। আইসবার্গের ভিতরে বৈদ্যুতিক হিটার আর দামি শীতের পোশাকে বেশ উঞ্চতা থাকলেও, বাহিরে স্তরে স্তরে জমে রয়েছে সাদা বরফ। দীর্ঘ ক্লান্তি নিয়ে সবাই লম্বা ঘুম দিতে শুয়ে পড়লাম। খুব ভোরে উঠতে হবে। দেখতে হবে স্বর্গীয় গ্রাম পেহেলগাম। (চলবে)




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২২ মে ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়