ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

থাই রেস্টুরেন্টে ভাষা না বোঝার জ্বালা

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:১৪, ৪ জুন ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
থাই রেস্টুরেন্টে ভাষা না বোঝার জ্বালা

(ভিয়েতনামের পথে : ২৬তম পর্ব)

ফেরদৌস জামান: আকাশ রাঙিয়ে আসার সাথে সাথে আমাদের বিদায়ের সময় ঘনিয়ে এলো। চাইনিজ প্রদর্শনী ও বিক্রয় কেন্দ্র ঘোরাঘুরি সম্পন্ন হলেও মূল বসতিতে প্রবেশের ইচ্ছাটা অপূর্ণ রাখতে হলো। তবে জানালাসর্বস্ব মাটির তৈরি খাবারের দোকানে বসে তাদের নিজ হাতে তৈরি ঐতিহ্যবাহী খাবার খেয়ে দেখা যেতে পারে। কী কী আছে জানতে চাইলে তালিকার কাগজটা সামনে দেয়া হলো। যা কিছু দেখা যায় তার অনেক পদই বাংলাদেশের রেস্টুরেন্টগুলোতে পাওয়া যায়। ছবি দেখে লোভনীয় লাগল পিঠা। চারটি পিঠার সাথে অতিরিক্ত হিসেবে ছোট্ট বাটিতে করে পরিবেশিত হয়েছে কনডেন্সড মিল্ক। পিঠার সাথে মিল্ক মাখিয়ে খাওয়া। আরও নিলাম একটি নুডল স্যুপ। এখন পর্যন্ত ধরেই নিয়েছি পাই পর্যন্ত পায়ে হেঁটে যেতে হবে। অত্র এলাকায় প্রবেশের প্রধান তোরণকে পেছনে রেখে রং ছড়ানো গোধূলী বেলার স্নিগ্ধতা ভেদ করে পা বাড়িয়েছি পাই এর পথে।

অদূরেই থেমে থাকা কালো রঙের পিক আপ ভ্যানটা দেখে হাত তুলে ইশারা দিলে চালক নিজ থেকেই জানতে চাইলেন কোন দিকে যাব। আমাদের গন্তব্য আর তার পথ মিলে গেল সোনায় সোহাগার মতো। দুর্দান্ত গতিতে মাত্র ত্রিশ মিনিটে পৌঁছে গেলাম পাই। চালককে ধন্যবাদ জানিয়ে পকেট থেকে টাকা বের করতে নিলে বাধা দিয়ে বললেন, তার নাম টাইগার আমাদের উপকার করতে পেরে অনেক খুশি। রাতের পাই প্রতিদিনের মত আলোয় আলোয় ভরে উঠেছে। মাত্র চার দিন হলো এখানে এসেছি। অথচ, মনে হচ্ছে কবেই না এসেছি! এই অল্প সময়ের মধ্যে যে পরিমাণ ঘোরাঘুরি হয়েছে তাতে এমন মনে হওয়াটা স্বাভাবিক। দুই পায়ের উপর ভর করে কত জায়গায় গেলাম আর কত মাইল যে হাঁটলাম সে হিসেব বের করা বড়ই কঠিন। পাই শহরের বোধহয় হেন পথ রইল না যেখানে আমাদের পদস্পর্শ পড়ল না। পথের ধারের অস্থায়ি দোকানদারদের কারও কারও মুখ চেনা হয়ে গেছি। ছবি তুলতে চাইলে এখন আরও বেশি প্রস্তুত হয়ে পোজ দিচ্ছে। পুরনো ধাচ ও ব্যতিক্রম নকশার অলঙ্কার বিছিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দোকানি ধরেই নিল এবার অন্তত কিছু না কিছু কিনছি। আগ্রহের সবটুকু দিয়ে দেখাতে লাগল একের পর এক অলঙ্কার। খানিকটা বেকায়দায় পরে যাওয়ার মত পরিস্থিতি। পাশের সাসলিক বিক্রেতা কাঠিতে গেঁথে রেখেছে তিন-চার টুকরো ঢেরস। তেল জাতীয় কিছু মাখানো ঢেরস পোড়া আমাদের মতো বাঙালির জন্য অতোটা আকর্ষণীয় হবার কথা নয়। ঠিক আছে ঢেরস না হয় না হোক, দুই টুকরো মাংসের সাথে পেঁয়াজ এবং আনারস ফোঁড়ানো কাঠি নিশ্চই পছন্দ হবে কিন্তু তাও যে হবার নয়, বিষয়টি আগে জানলে বিক্রেতা নির্ঘাৎ আমাদের পছন্দ মত তাৎক্ষণিক কোন কিছু আবিষ্কার করে ফেলতেন।
 


পাই ছেড়ে যাবার আগে আজ মনটা চাইছে এমন কোন পদের স্বাদ নিতে যা খেলে দেশী দেশী মনে হবে। অর্থাৎ একটু ঝাল, একটু লবণে পরিপূর্ণ কিছু। সেদিন গিরিখাত দেখে ফেরার পথে শহরে প্রবেশের পর মিনিট দশেক এগিয়ে আসার পর যে বাজার অতিক্রম করতে হয়েছিল সেখানে মাছ পোড়া ও মুরগির মাংস ভাজতে দেখেছিলাম। গিয়ে উপস্থিত হলাম। দাম খুব বেশি নয়, এক টুকরো মুরগির মাংসের দাম চল্লিশ বাথ। মাংস ভেজে ছোটখাটো একটা স্তুপ করে রাখা। অনেকক্ষণ আগে ভেজে রাখা। ইতিমধ্যে ঠান্ডাও হয়ে গেছে। একটু গরম করে দিতে বললে মুখের উপর বলে দিল সেটা অসম্ভব। সামান্য আবদারের এত কর্কশ প্রতিক্রিয়ায় আৎকেই উঠলাম। লোকজন আসছে আর এক-দুইটা করে টুকরো খরিদ করে ঠোঙ্গা নাচিয়ে ঘরে ফিরছে। এদিকে আমরা ফিরে আসব ভাবছি। বিক্রেতা আমাদের মনের কথা আন্দাজ করতে পারলেন। চেহারায় ও আচরণে আর একটু বেশি পরিমাণে রুঢ় মনোভাব ফুটিয়ে তুললেন। এবার বোধহয় একটু ভয় পাওয়া উচিৎ। কিন্তু ভেবেই পেলাম না তাওয়ার নিচে আগুন জ্বলছে, তাতে ছেড়ে দিয়ে শুধু এপিঠ-ওপিঠ করলেই আমাদের আশা পূরণ হয়। অথচ, এই সামান্য আবদার প্রতিহত করতে তার এত প্রকার কলাকৌশলের আশ্রয় নেয়ার দরকারটা কি? লাল করে ভেজে রাখা এক টুকরোয় কামড় দিতেই প্রথমে ঝাল-লবণের স্বাদে মুখের ভেতরটা জরিয়ে আসবে তারপরই দাঁতের নিচে কুরকুর শব্দে চুরমার হবে মুড়মুড়ে হাড়হাড্ডি! সুজিতের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি তার চোখ মুখ দিয়েও একই ভাবনার ভাষা বেরিয়ে আসছে। এবার কঠিন সিদ্ধান্তে উপনিত হয়ে বিক্রেতাকে বললাম, গরম করার দরকার নেই একটা দিন। কোন কথা না বলে খপাত করে এক টুকরো তুলে নিলেন এবং দা দিয়ে ছোট ছোট টুকরো বানিয়ে ঠোঙ্গায় ভরে দিলেন। অমাদের ক্ষেত্রে যেমন এই ধরনের পদগুলো গরম না হলে অখাদ্যের কাছাকাছি হিসেবে বিবেচিত হয়, তাদের বেলায় সম্পূর্ণ উল্টো না হলেও গরম বা ঠান্ডায় তাদের কিছু যায় আসে না।
 


আজ শুধু খাওয়া। এত খাবার খাবো যে গত চার দিনেও তা খাইনি। মুরগির মাংসের টুকরোটা এত বড় ছিল যে ওতেই রাতের খাবার হয়ে গেছে। এবার একটু মিষ্টি জাতীয় কিছু খেলে জমে উঠতো। ফিরে এসে আবার প্রবেশ করলাম পর্যটক বহুল পথটায়। আজকের সমাগম একটু বেশিই জমজমাট মনে হচ্ছে। মিষ্টি জাতীয় কি খাওয়া যায়? এমন ভাবনায় এগিয়ে যেতেই দেখি কেউ একজন হাতে একটা সবুজ রঙের কুলফি আইসক্রীম নিয়ে হেলেদুলে এগিয়ে আসছে। জানতে চাইলে হাতের ইশারায় ঠিকানা দেখিয়ে দিল। ভিড় ঠেলে প্রবেশ করে দেখি কয়েক প্রকার আইসক্রীম। হাতে একটা করে নিয়ে পরের দিনের রসদ খরিদ করতে প্রবেশ করলাম সেভেন ইলেভেনে। তারপর টিকিট কাউন্টারে। পরের দিনের গন্তব্য চিয়াংমাই। জনপ্রতি ভাড়া একশ বিশ বাথ। কাউন্টারে বসা নারী নামধাম জেনে নিয়ে কম্পিউটারের কিবোর্ডে সবে খুটখাট শব্দে টাইপ করছেন অমনি পেছন থেকে ভেসে এল এক নারীর কন্ঠ- লোকাল সার্ভিসে চিয়াংমাই ভাড়া কত? ভেতর থেকে জানানো হলো ষাট বাথ। আমরা খামাখা দ্বিগুণ দামের টিকিট কেন কাটছি? একটু থামেন, আমাদেরকেও লোকাল সার্ভিসের টিকিট দিন। ঠিক আছে বলে কয়েক সেকেন্ড পর টিকিটের সাথে ফিরে দিলেন ষাট বাথ। আর কোথায়? বললেন, টিকিট পরিবর্তনের জন্য ত্রিশ বাথ করে মাশুল কেটে নেয়া হয়েছে। বিষয়টি আগে জানালে তার কোনো ক্ষতি হতো না বরং আমাদের কিছু অর্থ বেচে যেত। এই সহজ কথা তাকে কে বোঝাবে? বুঝাতে চাইলে আগে ছয় মাস থাইল্যান্ডে অবস্থান করে তাদের ভাষা রপ্ত করতে হবে।
 


ঘরে ফিরে কাপড় ছেড়ে মাত্র বারান্দায় বসেছি। অমনি মনে হলো পাউরুটি আর মাখনের ডিব্বা কই, আরে সে তো কাউন্টারে ফেলে এসেছি! গিয়ে দেখি কাউন্টার বন্ধ করা হচ্ছে। আমার আচরণ দেখে একজন গাড়ি চালক এগিয়ে এসে জানতে চাইলেন, কিছু খুঁজছি কি না? হ্যাঁ বলায় ব্যাগ এনে সামনে ধরে বলেন, এটা বোধহয় আপনার। পাউরুটি মাখন ফিরে পাবার আনন্দে তাকে ধন্যবাদ জানাতেও ভুলতে বসেছিলাম। যখন বললো, সব ঠিক আছে তো? তখন ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলাম। ফিরে দেখি এ্যামো বারান্দাতেই বসে আছে। মনোযোগ দিয়ে কাজ করছে। কাজের ফাঁকে দু’একটা কথা হচ্ছে। এর বেশি নয়। সে এখনও জানে না কাল ভোরেই আমরা পাই ছেড়ে চলে যাচ্ছি। আমি প্রতীক্ষায় আছি কখন তার বিয়ারের বোতলে শেষ চুমুকটি পড়বে আর তখনই সামনে এসে দাঁড়িয়ে শিশু সূলভ দু’হাত মলতে মলতে বলবে, আর একটা সিগারেট ধার দাও! কয়েক দিন হলো চলমান এই অতি সরল প্রার্থনার বিষয়টি আমার কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছে। সামনে এসে যখন দাঁড়ায় তখন ওকে আর প্রাপ্ত বয়স্ক মনে হয় না যেন পনের বছরের কিশোর। আরও মনে হয় ওর সাথে যেন আমার কত দিনের জানাশোনা! বোধহয় দশ মিনিটও পার হয়নি, তালগাছ লম্বা এ্যামো কাঠের সিঁড়ি দিয়ে সুরসুর করে নেমে সামনে এসে হাজির- এটাই শেষ তোমার কাছে আর ধার চাইব না! বললাম, চাইলেও আর তা হবার নয় কারণ এই রাতটাই এখানে শেষ, কাল ভোরের গাড়িতে চিয়াংমাই রওনা করছি। (চলবে)




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৪ জুন ২০১৮/তারা 

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়