ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

চিয়াং মাইয়ের রাতের বাজার

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:০৮, ২৭ জুন ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
চিয়াং মাইয়ের রাতের বাজার

(ভিয়েতনামের পথে : ৩১তম পর্ব)
ফেরদৌস জামান : আমার এই ভ্রমণ পরিকল্পনা প্রায় ছয়-সাত মাস আগে থেকে করা। ভ্রমণ শুরুর এক মাস আগেও তালিকায় চিয়াং মাই ছিল না। একদিন কথা হচ্ছিল আমার বহু ভ্রমণের অন্যতম সঙ্গী জাকারিয়া পারভেজের সাথে। কথা প্রসঙ্গে এখানকার ধারণাটি তার কাছ থেকেই পাওয়া। বড় বোন তুল্য তার এক বান্ধবী সম্প্রতি থাইল্যান্ড ঘুরে গেছে। তিনি ব্যাংককে বেশি দিন টিকতে না পেরে হঠাৎ সিদ্ধান্ত নেন চিয়াং মাই ভ্রমণের। কয়েক দিন এখানে অবস্থান করে নাকি তিনি বেশ আনন্দ পেয়েছেন। তার ভ্রমণ সার্থক হয়। কী ছিল সেই সার্থকতার পেছনের গল্প, সেই কথা শুনতে শুনতেই জানতে পারি পাহাড়-পর্বত ঘেরা চিয়াং মাই-এর খবর। এরপর আর কোন খোঁজখবর না নিয়েই পরিকল্পনায় যুক্ত করি চিয়াং মাই। গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। তাতে কি, অভিজ্ঞতার ঝুলিতে যুক্ত হওয়া এটাও কি কম! ধন্যবাদ জাকারিয়াকে, ধন্যবাদ তার উড়নচণ্ডী বান্ধবীকে।

গিরিখাত ভ্রমণে শরীরের উপর অনেক অত্যাচার চালিয়েছি। আজকের দিনের জন্য আর বের হতে ইচ্ছা হচ্ছে না। পরে ভেবে দেখলাম এই সময় আর কোনো কালে ফিরে পাওয়ার নয়। তাছাড়া দ্বিতীয়বার আসার সুযোগ মিলবে কি না তারও  নিশ্চয়তা নেই। ওদিকে ইউবিন ও মানন সওসি শনিবারের বাজারে যাওার জন্য পস্তুত। ওদের সাথে আজ সকালে পরিচয় হয়েছে, এই হোটেলেই আছে। মাননের সাথে পরিচয় একটু আকস্মিক। হোটেলের নিচ তলায় এক অংশে ডাইনিং টেবিল এবং চেয়ার পাতা, পাশে ফ্রিজার, টোস্টার, অভেন এবং কিছু মগ, পিরিচ, হাফপ্লেট জাতীয় তৈজসপত্র রাখা। অতিথিদের জন্য এটি একটি বাড়তি সেবা। চাইলে বাইরে থেকে নিজের খাবার এনে ফ্রিজারে রাখা যায় আবার খাবার সময় হলে গরম করে খাওয়া। সোজা কথা এখানে রাখা সমস্ত কিছুই অতিথিদের ব্যবহারের জন্য। তবে প্রতিটি জিনিস ব্যবহারের একটি নিয়ম আছে। খাবার খাওয়ার পাত্র ব্যবহারের পর ধুয়ে পরিষ্কার করে রাখার দায়িত্ব ব্যবহারকারী নিজের। পরিষ্কার করার ব্যবস্থা ভবনের পেছনে; ঘাসে ঢাকা ছোট্ট চত্বরের এক কোণে। সকালে নস্তার পর প্লেট এবং মগ পরিষ্কার করার জন্য দরজা ঠেলে পেছনে বেরিয়েই দেখি কেউ একজন দেয়ালে ঠেস দিয়ে মাটিতে বসে আছে। মোবাইল ফোনের পর্দায় গভীর মনোযোগ, হারিয়ে গেছে অন্য জগতে। বসার জন্য পাশ থেকে কুড়িয়ে নিয়েছে এক ময়লা কাপড়ের টুকরো। একটু অসাবধান থাকলেই নির্ঘাৎ তাকে মাড়িয়ে যেতাম। পরিচয়ের পর জানা গেল বেশ কয়েকদিন হলো এখানেই আছে। তার একটু আগেই টেবিলে নাস্তা খেতে খেতে পরিচয় হয় দক্ষিণ কোরিয়ান ইউবিন-এর সাথে। সেও প্রায় দুই সপ্তাহ এখানে অবস্থান করছে। পিতা-মাতার সাথে বনিবনায় কমতি আছে তাই একরূপ রাগ করেই থাইল্যান্ডে চলে আসা এবং অল্প সময়ের জন্য অভিবাসী হওয়া। এখান থেকে জার্মানি যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। পাশাপাশি স্পা, মাসাজের উপর সংক্ষিপ্ত কর্মশালাতেও মনোনিবেশ করেছে। চিন্তা ভাবনায় কেমন জানি এলোমেলো ঠেকল। ওদিকে ইতিহাস অধ্যয়নেও ব্যাপক আগ্রহ।



সন্ধ্যা হয়ে গেছে। বাজারে যাওয়ার উপযুক্ত সময়। মানন আগ্রহ হারিয়ে ফেললো। ইউবিনের অবস্থাও একই তবে একটু পর হারানো আগ্রহ পুণরুদ্ধার করে আমাদের সাথে চললো। পিছে পিছে মাননও দৌড় দিল। কিছু একটা ছেড়ে এসেছে তাই আবারও ফিরে যেতে যেতে কি বললো তা ঠিক বোঝা গেল না। শুধু এতটুকু অনুমান করা গেল- তোমরা এগোতে থাক আমি আসছি! শনিবারের বাজারের অবস্থান অন্য জায়গায়। থাপায়া গেট মোড় থেকে যে রাস্তা বাম দিকে এগিয়ে লেকের পাড় ধরেছে তারও অনেক পরে। ইতিমধ্যে ইউবিন আমাদের বন্ধু হয়ে গেছে।তাকে সঙ্গ দিতে সুজিত পূর্ণ মনোনিবেশ করলো। লেকের পাড় ধরে আরও কিছুদূর এগিয়ে জনস্রোত ঢুকে গেছে তুলনামূলক সরু রাস্তার মধ্যে। লোকে লোকারণ্য। সরু জায়গা হওয়ায় মানুষের সংখ্যা আরও বেশি মনে হচ্ছে। মানুষের এত চাপ যে একসাথে চলা দুস্কর। তিনজনে ঠিক করা হলো, চলতি পথে কেউ কোথাও হারিয়ে গেলে পেছনের ঐ উঁচু বাতির নিচে এসে দাঁড়িয়ে থাকব। একে তো মানুষে ঠাসা তার উপর দিয়ে গরম। উদ্ধার হলাম বরফ কুচি দেয়া এক মগ করে লেবুর শরবত পেয়ে। একটু করে গলছে আর নলের মাথায় ছোট্ট করে চুমুক! পেরিয়ে গেছে অনেকটা সময়। দোকানের পণ্য সামগ্রী সবই আকর্ষণীয়। এক পলকে দেখেই পার হয়ে যাওয়া দুস্কর। দৌড়াদৌড়ি করে এক ঝলকেই সমস্তটা বাজার দেখতে হবে এমন কথা নেই। যতটুকু দেখব তা সময় নিয়ে এবং মনোযোগ দিয়ে।

গতকালের বাজার এবং আজকের বাজারের বিক্রেতা এবং ক্রেতা-দর্শনার্থীর বেশিরভাগ সেই একই লোক। তারপরও আবহ এবং পারিপার্শ্বিকতায় এক ধরণের ভিন্নতা। ঠিক কি সেই ভিন্নতার কারণ তা সঠিক করে বলা মুশকিল। এ্যালোমুনিয়ামের তৈরি নকশাদার পাত্রগুলি পূঁজা-প্রার্থনার অর্ঘ্য ধারণে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। একজন বিক্রেতা নানান আকারের পাত্র বিছিয়ে দাম হাঁকছে। এই জিনিসটি সংগ্রহ করার ইচ্ছা সেই মে হং সনের ওয়াট ফ্রাথাট ডই কং মু দেখার পর থেকে। এক বৃদ্ধ দম্পতির সাথে আলাপকালে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল। পরক্ষণে খাতির হওয়ার সুবাদে হাতে নিয়ে পরখ করেছিলাম। আর একটু সময় পেলে হয়তো তা হস্তগতই করে ফেলতাম। এর পর থেকেই একটি অর্ঘ্য পাত্র সংগ্রহে মনোস্থির করা। এবার যখন পেয়েছি তখন মনের সেই ইচ্ছার পূর্ণতা দিতে এতটুকুও কুণ্ঠিত হলাম না। অদূরেই স্থানীয় যন্ত্রপাতি সহযোগে গানের পরিবেশনা চলমান। কালো পোশাক পরিহিত গায়ক দলে যুবক থেকে শুরু করে ষাট/সত্তুর বছরের বৃদ্ধও আছে। কি চমৎকার পরিবেশনা! শ্রোতাদের কেউ কেউ সামনে দু’চার বাথ করে রেখে যাচ্ছে। পা বাড়ালাম মূল বাজার থেকে বেরিয়ে যাওয়া আলাদা এক পথে। এ পথ বাছাই করার কারণ পথের শেষ প্রান্তের আকাশে নানান বর্ণের আলোর আভাস। গিয়ে দেখি মন্দির গৃহ ঘিরে আরও ছোট ছোট স্থাপনা। স্বয়ংক্রীয়ভাবে এবং পালাক্রমে এসবের গায়ে সবুজ, বেগুনি, হলুদ ইত্যাদি রঙের আলো ফেলা হয়েছে। তারই কিছুটা গিয়ে ভেসে উঠছে মাথার উপর রাতের অন্ধকারে। ভেতরে প্রার্থনা চলমান। পর্যটকদের অনেকেই ঢোকার জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছে। এখান থেকে যে পথ বামে গিয়েছে, তা আবারও বাজারে মিশেছে। বাজার শেষপ্রান্ত খুঁজে পাওয়ার কোন লক্ষণ নেই, আরও কত দূর পর্যন্ত এগিয়েছে তা আন্দাজ করা কঠিন। রাত বেড়ে চলেছে কিন্তু মানুষের ভিড় আগের মতই। আমরা এখনও কেউ হারিয়ে যাইনি। ভিড়ের ঠেলায় মাঝে মধ্যে পেছন থেকে একজন অন্যজনের কাঁধে হাত রেখে সংযুক্ত থাকতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে এখানেও দেখা হলো কানাডিয়ান দুই বন্ধুর সাথে। তারা ঢুকছে আর আমরা বেরিয়ে পরছি। ভিড়ের কারণে হাই-হ্যালো পরোবর্তী সংক্ষিপ্ত কথার মধ্যে দিয়েই বিদায় নিতে হলো। আমরা যেমন পেছন ফিরে তাকিয়ে থাকলাম তেমনি তারাও, যেন আরও কিছু বলার ছিল, জানার ছিল- নতুন জায়গায় কী কী দেখলে, কোথায় কোথায় গেলে ইত্যাদি।



চিয়াং মাই আসা পর্যটকের বড় এক অংশ শুধুমাত্র এই বাজারগুলি দেখার জন্যই এসে থাকে। নেই কোনো উচ্চ শব্দ, মাইক অথবা বিক্রেতাদের উচ্চ শব্দের হাঁকডাক। হাজার হাজার মানুষ অথচ পাশের জনের স্বাভাবিক কথাবার্তাও স্পষ্ট শোনা যায়। ফেরার সময় হয়ে এসেছে। তার আগে রাতের খাবারটা খেয়ে নেয়া দরকার। বাজার থেকে বেরিয়ে মূল সড়কে এলে অনেক খানি জায়গা নিয়ে খাবারের এলাকা। কমপক্ষে দেড়শ দোকান হবে। দুই সড়কের মাঝে চওড়া বিভাজন। গাছপালায় আবৃত বিভাজনেই খাবারের বাজার। প্রতিটি দোকান অস্থায়ী। দোকানের কর্মীরা যার পর নেই ব্যাস্ত সময় পার করছে। খাবারের কথা বলে অপেক্ষার পরও কোনো সাড়া শব্দ নেই। এদিকে অনেকেই আশপাশে দাঁড়িয়ে আছে, খাবার শেষ হলেই বসে পরবে। এক পর্যায়ে উঠে গিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে  খাবার প্রস্তুত করিয়ে আনতে হলো। আগামী দুই দিনের পরিকল্পনায় দূরবর্তী কোথাও যাওয়ার ইচ্ছা নেই। সুতরাং, যত রাত খুশি বাইরে বসে গল্প করা যেতে পারে। গেস্টহাউজের প্রবেশ দ্বারের পাশে ছোট্ট বসার জায়গা। সমান্য উঁচুতে কাঠের পাড়ন, তার উপর ছাউনি দেয়া। চৌচালা ছাউনির মিলন বিন্দুতে একটি মিটমিটে আলোর বাতি। এমন জায়াগা পেলে সারা রাত পার করে দেয়া কোন বিষয়ই নয়। (চলবে)



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৭ জুন ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়