ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

পুলিশ স্টেশনে একজন পুলিশেরও দেখা মিলল না

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৪১, ৩০ জুন ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পুলিশ স্টেশনে একজন পুলিশেরও দেখা মিলল না

(ভিয়েতনামের পথে : ৩২তম পর্ব)

ফেরদৌস জামান : সেভেন-ইলেভেন থেকে কফি এনে রেখেছিলাম। সকালের নাস্তার পর নিচ তলার ডাইনিং টেবিলে বসে আরাম করে কফি পান করছি। ইউবিন অনেক খুশি কারণ গতকাল বাজারে ঘোরাঘুরি ছিল তার জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি। কথার এক পর্যায়ে তারই কৌতূহলে আলোচনা মোড় নিল ১৯৭১ সালে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তার কাছে সম্পূর্ণ নতুন এক অধ্যয়। হাতে একটি মোটা বই, বসে বসে পড়ছিল। কথার মাঝ থেকে দুই-এক লাইন বইয়ের মাঝে ফাঁকা জায়গা দেখে টুকে রাখছে। কথা দিলো ৭১ সাল নিয়ে অধ্যয়নের জন্য কিছু দিনের সময় বের করে নেবে। নাস্তার বাক্স হাতে নেমে এলেন আামাদের ঘরের অন্য অতিথিদ্বয়। চিকন গলায় সমস্বরে হাই বলে অভেনের দিকে এগিয়ে গেলেন। এদের সবকিছুতেই এক ধরনের সমন্বয় আছে। যেমন কোন কথা বললে প্রায় সময়ই তা দু’জনের মুখ থেকে একই সাথে বেরিয়ে আসে। হাঁটে ঠিক পিটি-প্যারেড করার মতো। যাহোক, কফি শেষ, আলোচনা আর দীর্ঘায়িত করা যাবে না। আজকে আমাদের লক্ষ্য ওয়াট ফ্রা সিংহা।

চিয়াং মাইযের প্রায় দেড় হাজার মন্দিরের মাঝে এটি অন্যতম। আপন পিতার স্মরণে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শহরের গোড়াপত্তনকারী রাজা লা না। থাপায়া গেট দিয়ে প্রবেশ করে মূল সড়ক ধরে সোজা যেতে হলো। আজ রবিবার। বাজার বসবে এই পথে। তার আয়োজন এখন থেকেই শুরু হয়ে গেছে। শহরের মাঝামাঝি স্থানীয় পুলিশ স্টেশন। বড় জয়গার মাঝে দালানটিও বেশ বড়। সাইনবোর্ড লক্ষ্য না করলে বোঝার উপায় নেই তা পুলিশ স্টেশন। এখানে রাস্তাঘাটে কোনো পুলিশের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। তার অর্থ তো এমন হতে পারে না খোদ পুলিশ স্টেশনেও একজন পুলিশের দেখা মিলবে না। ব্যাপারটি আমাদেরকে রীতিমত বিস্ময়ের মধ্যে ফেলে দিলো। কমপক্ষে সদর দরজাতেও কি একজন বন্দুক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে না? বড় অদ্ভুত দেশ! আমাদের কাছে বিস্ময় বা অদ্ভুত প্রতীয়মান হলেও বাস্তবতা তো আসলে এমনই হওয়ার কথা। কৌতূহল বেড়ে যাওয়ায় খানিকক্ষণ দাঁড়িয়েই থাকলাম, এদেশের পুলিশ কেমন তা এক নজর দেখার জন্য। এমন পরিস্থিতিতে স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের হাসা না কাঁদা উচিৎ সে হিসেব কষতে হিমসিম খাওয়ার জোগাড়। অতএব, কৌতূহল আর না বাড়িয়ে তাতে বরং লাগাম টেনে এ ভাবনায় ইস্তফা দিতে বাধ্য হলাম।
 


থাপায়া গেটের অপর প্রান্তের কাছাকাছি অর্থাৎ রাস্তার শেষে ওয়াট ফ্রা সিংহার অবস্থান। দূর থেকেই দৃশ্যমান হলো মন্দির গৃহের সুউঁচ্চ চূড়া। সদর দরজার পর সম্মুখে ফুল পাতাবাহার গাছ ঘেরা ভস্কর্যের পর মূল মন্দির। তার আশপাশে একই আদলের আরও একাধিক মন্দির। কেউ এসেছে প্রার্থনার জন্য তো কেউ শুধুমাত্র দর্শনের উদ্দেশ্যে। জুতা খুলে নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে সিঁড়ি কেটে উপরে উঠতে বলা হলো। পাশেই টিকিট হাতে বসে আছে এক ভিক্ষু মহাশয়। প্রবেশ মূল্যের বিনিময়ে ভেতরে ঢুকতে হবে। কক্ষের ঐ প্রান্তে স্থাপিত মূর্তি সামনে রেখে অনুরাগীগণ প্রার্থনা করছে। স্বর্ণের মতো চকচকে করলেও নিশ্চিত করে বলা যাবে না তা স্বর্ণ নাকি অন্য কোন ধাতব পদার্থে তৈরি। যে পদার্থেই তৈরি হোক, বৈদ্যুতিক বাতির আলোয় তার শরীরে এক অব্যাহত ঝলক বিদ্যমান। প্রশস্ত দরজার বাহির থেকে যতটুকু দেখা গেল তাতেই সন্তুষ্ট। কারণ অর্থের বিনিময়ে কোন ধর্মালয় পরিদর্শনে তার প্রতি সম্মান কতটুকু প্রদর্শন হলো তা একটি প্রশ্নবোধক জিজ্ঞাসা। মন্দিরের পাশ দিয়ে ছায়া ঢাকা সুশীতল পথ এগিয়ে গেছে পেছনের দিকে। মন্দিরের মূল সৌন্দর্য এই অংশে স্থাপিত। আগা গোড়া সোনালী পাতে মেড়ানো সুউঁচ্চ মট! তাকে কেন্দ্র করে আরও একাধিক মাঝাড়ি মট। মূল মটের চার দেয়াল ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে হাতির চার চারটি সোনালী মাথা। এখানকার মন্দিরে সোনালী রঙের প্রাধান্য। মটের গায়ে ধাতব পাতের আস্তরণ এতটাই সূীক্ষ্ম করে বসানো যে, সামান্য ছেদটুকু খুঁজে পাওয়া সাধ্যের অতীত।

সূর্যের আলোয় ঝলমলে মটের শরীর থেকে চারদিকে আরও আলো ছড়িয়ে পরছে। পাশে ছাউনির তলে বেশ কিছু মূর্তি স্থাপিত হয়েছে। ঠিক তার পাশে ঝুলে আছে একটি থালা সদৃশ্য বস্তু। দেখতে থালার মতো হলেও এটি আসলে থালা নয়, প্রার্থনারই কোন এক বিশেষ উপকরণ। ব্যাসার্ধ হবে একটি বুলডোজারের চাকার সমান। কেন্দ্রভাগের বাহিরের দিকটা সামন্য উঁচু এবং ভেতরে অংশে স্বাভাবিকভাবেই  গর্তের মতো। এই অংশে দু’পাশ থেকে দুইজন বিশেষ কায়দায় অনবরত দুই হাতের আঙুল ঘষলে কিছুক্ষণের মধ্যে উৎপন্ন হয় এক অসাধারণ শব্দ- উমমমম। যত ঘর্ষণ শব্দ তত উচ্চতর হয় এবং আরও বিস্তৃত এলাকা নিয়ে ছড়িয়ে পরে। চোখের সামনে এমন বিষয় দেখে একবার চেষ্টা না করে ফিরে আসা বড়ই আফসোসের। আমরা একাধিক বার চেষ্ট করেও এক বিন্দু শব্দ উৎপন্ন করতে পারলাম না। অথচ, তারা হাত দিলে কয়েক মুহূর্তেই বেরিয়ে আসে। আমাদের প্রচেষ্টা প্রত্যক্ষ করে দুইজন নারী আন্তরিকভাবে দেখিয়ে দিলেন কিন্তু কাজ হলো না। এবার একটু বিস্তারিত করে আবারও দেখিয়ে দিলেন। দুঃখের বিষয় তাতেও কাজ হলো না!
 


একটু একটু করে আকাশে মেঘ জমতে শুরু করল। মেঘ কালো হয়ে এলে বৃক্ষগুলোতে হালকা বাতাসের স্রোত বইতে শুরু করল। মেঘ কালো আকাশের নিচে সোনালী মটগুলো অদ্ভুত লাগছিল! দেরি করা সমীচীন হবে না ভেবে হোস্টেলের পথ ধরায় উদ্যত হতেই বাতাস জোরদার হয়ে মেঘেদের হার মানাল, যেন দুহাত দিয়ে কেউ আস্তে করে সমস্ত মেঘ সরিয়ে নিয়েছে। রোদ বেরিয়ে এলো। সদ্য বয়ে যাওয়া বাতাসে রাস্তার কালো শরীরজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কাচা-পাকা অজস্র পাতা। এই সময়টুকুর মধ্যে বাজারের আয়োজন অনেকটা এগিয়েছে। পিপাসাও পেয়েছে বেশ। সামনে ডাবের দোকান। কেবল ভ্যান থেকে নামিয়ে সাজানোর কাজ চলমান। তাতেই গিয়ে হানা। এই প্রথম থাইল্যান্ডে ডাবের বাহারের কাছে নতি স্বীকার। বিক্রেতা একটু অপেক্ষা করতে বললেন। কোন অপেক্ষার প্রয়োজন নেই। তাছাড়া, কেটে, চেঁছে ওই সমস্ত নকশা করারও দরকার নেই। শুধু এতটুকু বলেন এই অবস্থায় ডাব বিক্রি করতে কোন সমস্যা আছে কি না? হ্যাঁসূচক উত্তর এবং সঙ্গে সঙ্গে বরফ পানিতে ডুবিয়ে রাখা ডাব খচাখচ কেটে সামনে বারিয়ে ধরলেন। হোস্টেলের গলিতে ঢুকেছি অমনি দেখি বিপরীত দিক থেকে ইউবিন এগিয়ে আসছে। আমাদেরকে দেখা মাত্র তার অভিমান মেশানো উচ্ছলতা কয়েক গুণ বেড়ে গেল। দৌড়ে এসে অভিযোগের ফর্দ মেলে ধরল। এক দিনের বন্ধুত্বেই অধিকার প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে। গোসল করে দুপুরের খাবার খেতে বের হবো। প্রথম প্রশ্ন এতক্ষণ তোমরা কোথায় ছিলে? ওদিকে সে যাচ্ছে পাশের দোকানে ঠান্ডা কফি কিনতে। এই দৌড়ে যাব আর আসব তারপর তোমাদের সাথে খাবার খেতে যাব- আমাকে নেবে? কেন নেব না এমন উত্তর পেয়ে সে সত্যি সত্যিই দৌড় দিল। কিছুক্ষণ পর কফি হাতে ফিরে এসে দেখে আমরা অভ্যর্থনা কক্ষে বসে আছি। তার ধারণা এতক্ষণে হয়তো প্রস্তুত হয়ে বসে থাকব। অসহায়ত্বের কথা তাকে কীভাবে বুঝাই, উপরে গিয়ে এক দফা ধাক্কা খেয়ে এখানে এসে বসে আছি। আর ঘরময় ছড়িয়ে থাকা মিহি সুবাসের অণু-পরমাণুগুলি বিনাশ হওয়ার প্রতীক্ষা করছি।

পরশুদিন এখানে এসে যেখানে খেয়েছিলাম, সোজা সেখানে গিয়ে হাজির। মন্দির চত্বরের ছায়াতলে দোকানগুলি আজ অধিক রমরমা। নতুন আরও দোকান বসেছে। মানুষের সমাগমও কম নয়। কোণার দোকানে বড় করে লেখা ইন্ডিয়ান চিকেন বিরিয়ানি। আহা, এমন স্বাদের খাবার কত দিন খাই না! গামলায় তুলে রাখা জাফরান রঙের ভাত আর পাশের পাত্রে রান্না করা মুরগির মাংস। চারপাশটা ম ম সুগন্ধে ভরে গেছে। বিক্রেতা একজন ইন্ডিয়ান। বাইশ বছর হলো এখানেই আছেন। ঘরও বেঁধেছেন এখানে। এটি তার সাপ্তাহিক কারবার। মেয়েকে সাথে নিয়ে বিরিয়ানি বিক্রি করছেন। আজ তাহলে ইন্ডিয়ান বিরিয়ানিই আমাদের দুপুরের আহার। অতিথি ইউবিনকে বুঝিয়ে বলা হলো বিরিয়ানি বিষয়ক খুঁটিনাটি। এক কথায় রাজি। ক্ষুধা যে পরিমাণ পেয়েছিল তাতে এক থালিতে আমার ঠিক হলো না। অন্য হিসেবে ভালোই হয়েছে কারণ আজ এবং কাল দূরবর্তী কোথাও যাওয়ার পরিকল্পনা নেই। সুতরাং, আগেই ঠিক করে রেখেছি এই দুই দিন আর কৃচ্ছসাধন নয়, পথে পথে হাঁটব আর অনেক কিছু খাব।  (চলবে)




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩০ জুন ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়