ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

দুধকোশি নদীর শীতল বাঁকে

ইকরামুল হাসান শাকিল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:২০, ১৩ আগস্ট ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
দুধকোশি নদীর শীতল বাঁকে

(কাঞ্চনজঙ্ঘার সোনালী আলোয়: চতুর্থ পর্ব)

ইকরামুল হাসান শাকিল: এখান থেকে উপর দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলাম একত্রে দুটি ঝুলন্ত ব্রিজ। ব্রিজ দুটি আমাদের চেয়ে অনেক উঁচুতে। একটি উপরে অন্যটি তার সামান্য নিচে। আমাদের উপরেরটা দিয়েই যেতে হবে। ব্রিজের উপর দিয়ে হেঁটে চলা মানুষগুলো খুব ছোট ছোট দেখাচ্ছে। বাহারি রঙের প্রার্থনা পতাকার জন্য ব্রিজ দুটি রঙিন হয়ে আছে। খাড়া চড়াই পার করে ব্রিজের উপরে উঠে এলাম। ব্রিজে দাঁড়িয়ে উপর থেকে দুধকোশি নদীর স্রোত দেখছি। এই ব্রিজটি আমি আগেও দেখেছি। তবে বাস্তবে নয়। হলিউডের এভারেস্ট (২০১৫) মুভিতে। এই ট্রেইলে বেশ কয়েকটি বিষয় ছিলো উল্লেখ করার মতো। ট্রেইলের মাঝে মাঝে ডাস্টবিন বানানো আছে। তিনটি নির্দিষ্ট স্থানে ময়লা ফেলতে হয়। প্লাস্টিক, কাচ ও অন্যান্য। মাঝে মাঝে টয়লেটও আছে। যেগুলো টাকা দিয়ে ও টাকা ছাড়াও ব্যবহার করা যায়।

পথের মাঝে অনেকগুলো বড় পাথর। এই পাথরের গায়ে খোদাই করা রয়েছে ধর্মীয় লেখা এবং হাঁটার সময় পাথরগুলো হাতের ডান পাশে রেখে হাঁটতে হয়। প্রার্থনা হুইলও আছে উল্লেখ করার মতো। হাঁটার সময় এগুলো ঘুরিয়ে যেতে হয়। নামচে বাজারের আগে একটি চেকপোস্টে এন্ট্রি করতে হয়ে। এখানে এসে দেখি সেই পাসাং লামু শেরপা। কিছু সময় তার সঙ্গে গল্প হলো। হঠাৎ ছায়াবিথী আপুর হাতে একটি মৌমাছি হুল ফুটিয়ে দিলো। তার চিৎকারে আমরা চমকে উঠলাম। নূর ভাই হুলটি বের করে দিলেন। পাসাং লামু ব্যাগ থেকে এন্টিসেপটিক বের করে ছায়াবিথী আপুর হাতে লাগিয়ে দিলেন। ১.১৫ মিনিটে আমরা নামচে বাজারে এসে পৌঁছলাম। অসম্ভব সুন্দর একটি জায়গা। ১১ হাজার ৩০০ ফুট উচ্চতায় মানব বসতি। এই নামচে বাজারকে শেরপাদের রাজধানী ও এভারেস্টের প্রবেশ দ্বার বলা হয়। নামচে বাজারের পশ্চিমে মাউন্ট খুয়াংদে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে।
 


আমরা এ.ডি. ফ্রেন্ডশীপ লজ অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে উঠেছি। লজের দ্বিতীয় তলার ডাইনিং-এ বসে মাসালা চা-পান করে শরীরের ক্লান্তি দূর করলাম। তৃতীয় তলার চারটি রুমে আমারা থাকবো দুই রাত। আজ আমার রুমমেট বিপ্লব ভাই। সবাই হাত-মুখ ধুয়ে দুপুরের খাবারের জন্য ডাইনিং-এ চলে এলাম। ভাত, ডাল, মুরগির মাংস দিয়ে দুপুরের খাবার। এখানে খাবারের আগে হাত মুখ মোছার জন্য মেনথল যুক্ত গরম পানির স্টিম দিয়ে গরম তোয়ালে দেয়। আমরা সেই তোয়ালে দিয়ে হাত মুখ মুছে নিলাম। মুখ মোছার পর অনেক আরাম লাগছে। খাবার শেষে সবাই কিছু সময় বিশ্রাম নিলাম।

দু’দিন ধরে দুপুরের পর থেকে আবহাওয়া খারাপ হচ্ছে দেখছি। আজও মেঘে চারদিক অন্ধকার হয়ে গেছে। শীতটাও অনেক বেড়েছে। আমরা শীতের পোশাক পরে হাইকিং-এ বের হলাম। নামচে বাজারের উপরে একটি প্রার্থনা হুইল আছে। সেই পর্যন্ত আমরা উঠে আবার নেমে এলাম। উচ্চতায় হাইকিং করতে হয় উচ্চতার আবহাওয়ার সাথে শরীরকে এক্লামাটাইজ করার জন্য। তাই আমরা ঘণ্টাখানেক হাইকিং করি। হাইকিং করার সময় নেপালের একটি ট্রেকার গ্রুপের সাথে দেখা হলো। তারা উপর থেকে নেমে আসছে। তাদের ক্লাবের নাম ন্যাচার লাভার। তাদের সাথে কিছু সময় কথা হলো। মুহিত ভাইয়ের পরিচয় পেয়ে তারা সবাই মুহিত ভাইয়ের সাথে ছবি তুলেছে। আমাদের এক্সপিডিশনের শুভকামনাও করল তারা।
 


সন্ধ্যায় হাইকিং থেকে ফিরে এলাম। লজের ডাইনিং-এ বসে রুমহিটারে শরীর গরম করছি আর গরম গরম জিঞ্জার চা পান করছি। সাথে পর্বতারোহণের ডকুমেন্টারি দেখছি টেলিভিশনে। ডকুমেন্টারিটি ছিলো ১৯২৪ সালে জর্জ ম্যালরির অভিযানের উপর। জর্জ ম্যালরি হলেন ইতিহাস। তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি এভারেস্টের প্রথম পরপর তিনটি অভিযানেই অংশ নেন। ১৯২১, ১৯২২ এবং ১৯২৪ সালের অভিযান। ১৯২৪ সালের অভিযানে ম্যালরি ও আরবিন নিখোঁজ হন। ৭৫ বছর পর ১৯৯৯ সালে ম্যালরির মৃতদেহ পাওয়া যায়। তার সাথে দেশলাই, নাইফ, হাতঘড়ি ও বোনের দেয়া চিঠি পাওয়া যায়। কিন্তু বুক পকেটে রাখা তার স্ত্রীর ছবিটা পাওয়া যায়নি। কথা ছিলো মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায় তার স্ত্রীর ছবিটা রেখে আসবেন। তাই ধারণা করা হয় ম্যালরি হয়তো সেদিন আরবিনকে নিয়ে এভারেস্টের চূড়ায় প্রথম মানব পদচিহ্ন এঁকেছিলেন। এখন শুধুই আরবিনের অপেক্ষায় পর্বতের ইতিহাস তাকিয়ে আছে। তাকে পেলে তার সাথে থাকা ক্যামেরাটাও পাওয়া যাবে। আর সেই ক্যামেরায় তোলা ছবিই হয়তো বলবে তাদের পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়া স্পর্শের ঐতিহাসিক ঘটনার কথা।

রাত ৮টার সময় আমাদের রাতের খাবার এলো। আজকের খাবারের মেনুটা একটু পরিবর্তন করেছেন মুহিত ভাই। খাবারের মেনুতে আছে আলুর চিপস্, মুরগির মাংস ও চমিন। খাবার সুস্বাদু হয়েছে। খুব মজা করেই খাচ্ছি। আমরা সবাই বাহাদুরী করে কাঁচামরিচ খেলাম। যা হবার তাই হলো। ঝালে লাল হয়ে গেলাম। চোখের পানি আর নাকের পানি একাকার। শামীম ভাই দুই কান চেপে ঝিম ধরে বসে আছেন। মুহিত ভাই, বিপ্লব ভাই, নূর ভাই, রিনি আপু ও ছায়াবিথী আপু সবার ঝালে চেহারা পরিবর্তন হয়ে গেছে। আর আমার কথা কী বলবো? কার্টুন ছবির মতো ঝাল যেন কান দিয়ে বের হচ্ছে। রাতে সবাই যখন ঘুমাতে যাবো তখন বিপ্লব ভাই গেছেন সেভ করতে। বেসিনের ঠান্ডা পানি দিয়ে মুখ ভিজিয়ে সেভিং ক্রিম লাগাচ্ছেন। আমরা দুষ্টুমি করে চলে এলাম তার কাছ থেকে। কিছুক্ষণ পর দেখি মুখে ক্রিম লাগানো অবস্থায় রুমে এলেন তিনি। রুমে আসার একটা মজার কারণ আছে। মুখে ক্রিম লাগিয়ে যখন তিনি রেজার টানছেন কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না। তখন তিনি আবিষ্কার করেন যে রেজারের মাথায় ব্লেড নেই।
 


সাতটার সময় সকালের খাবার খেলাম। আজ আমরা শুধু হাইকিং করবো। তাই কোনো তাড়া নেই। সাড়ে আটটার সময় আমরা খুমজুং-এর উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। নামচে বাজার থেকেই খাড়া চড়াই। চড়াই শেষে উঠে এলাম ৩৭৫৫ মিটার উচ্চতায়। এখানে স্যাংবুচে এয়ারপোর্ট। ছোট এই জায়গায় ছোট রানওয়ে। জরুরি প্রয়োজনে এটি ব্যবহার করা হয়। এখানে একটা বড় পাথরের বোল্ডার আছে। মুহিত ভাই আমাদের এই পাথরে ফ্রি-হ্যান্ড ক্লাইম্বিং প্র্যাকটিস করান কিছু সময়। ফ্রি-হ্যান্ড ক্লাইম্বিং হলো দড়ি, জুমার, ক্যারাবিনার, পিটন, ফ্রেঞ্চ, চোখ নাট, হারনেস ব্যবহার না করে ক্লাইম্বিং করা। রিনি আপু ও ছায়াবিথী আপু একদম নতুন। তাই তাদের কীভাবে ক্লাইম্বিং করতে হয়, হোলগুলোতে কীভাবে ধরতে হবে তা শিখিয়ে দিলেন মুহিত ভাই। (চলবে)

আলোকচিত্র: এম এ মুহিত


রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ আগস্ট ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়