ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

সতের হাজার ফুট উচ্চতার সেই রাত!

ইকরামুল হাসান শাকিল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:২২, ১ সেপ্টেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সতের হাজার ফুট উচ্চতার সেই রাত!

(কাঞ্চনজঙ্ঘার সোনালী আলোয়: ষষ্ঠ পর্ব)

ইকরামুল হাসান শাকিল: ফিরে আসার আগ পর্যন্ত একদম যোগাযোগ বন্ধ। তাই একটু কষ্টও লাগলো। এই কয়দিনে কতো আপন হয়ে গেছি একে অপরের। যেন জন্ম থেকেই আপন আমরা। লম্বা সমতল মাঠ পার হয়ে আমরা কঠিন পাথুরে খাড়া ঢাল বেয়ে উঠছি। ছোট বড় পাথরের বোল্ডার। আলগা। পা দিলেই গড়িয়ে নিচে পড়ে যায়। ভালোভাবে পা রাখা যায় না। আবার উপর থেকেও পাথরের টুকরো পড়ছে। প্রতিটা মুহূর্ত বিপজ্জনক। যে কোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। প্রতিটা পায়ের স্টেপ সর্বোচ্চ সতর্কতার সাথে ফেলতে হয়।

হাইক্যাম্পে আমাদের কোনো বাড়তি জিনিস নেয়া হচ্ছে না। এমন কি খাবারও। সেখানে আমাদের শুধু তরল খাবার খেতে হবে। কোনো প্রকার ভারী খাবার নেই। আমাদের অতি প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস নিয়ে কিচেন বয় ও কিলি পেম্বা চলে গেছেন  আগেই। উপরে যেসব জিনিসের তেমন প্রয়োজন নেই সেগুলো বেসক্যাম্পে রেখে এসেছি। শুধু সাথে নিয়ে এসেছি মিটন, তিন সেট গ্লাভস, চার জোড়া মোজা ও এক জোড়া সামিট মোজা, ক্র্যাম্পন, হার্নেস সেট, হেলমেট, সান-গ্লাস, শীতের টুপি ও চকলেট। আইস বুট, ডাউন জ্যাকেট, উইন্ড প্রুফ জ্যাকেট ও ট্রাউজার, ফ্লিচ জ্যাকেট পরেই এসেছি।



আমরা পাথরের কঠিন চড়াই উঠে এসেছি। কিন্ত এখান থেকেই শুরু হলো বরফের রাস্তা। এখন বরফের কঠিন ঢাল বেয়ে নামছি। আবহাওয়া মুহূর্তের মধ্যেই খারাপ হয়ে গেলো। মেঘ এসে চারপাশ হোয়াইট আউট করে দিলো। ঠান্ডা বাতাসও যেন পাল্লা দিয়ে ছুটে চলছে। কয়েকশ ফুট দূরের কিছু দেখা যাচ্ছে না। রাস্তা খুব পিচ্ছিল। পা রাখাই যাচ্ছে না। তবু আস্তে আস্তে নিচে নামছি আমরা। প্রতি মূহূর্তে দুর্ঘটনার আশংকা। নূর ভাই ক্যামেরা নিয়ে আমাদের সমনে চলে গেলেন। আমাদের নিচে নামার ভিডিও করার জন্য। আমার এক পা পিছলে যাচ্ছিলো, কোনোভাবেই আটকে রাখতে পারছিলাম না। বসে পড়ে হাত দিয়ে বরফের খাঁজ ধরে পতন রোধ করলাম। বিপজ্জনক এই পথ নেমে আসতে আমাদের কিছুটা সময় লেগে যায়। ওদিকে আবহাওয়া খারাপ থেকে আরো বেশি খারাপ হতে শুরু করছে।



আমরা হেঁটে চলেছি গ্লেসিয়ারের মধ্য দিয়ে। লম্বা বরফের সমতল ভূমির উপর পা টিপে টিপে কচ্ছপ গতিতে হাঁটছি। দা কিপা, মুহিত ভাই ও নূর ভাই কিছুটা সামনে চলে গেছে। আমি, শামীম ভাই ও বিপ্লব ভাই পেছনে। শামীম ভাইয়ের হাঁটার গতি কিছুটা কমে গেছে। শামীম ভাই শারীরিকভাবেও কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েছেন। তিনি শরীরের ব্যালেন্স ঠিক রাখতে পারছিলেন না। মুহিত ভাই সামনে থেকে এসব লক্ষ্য করলেন। আমাদের জন্য তারা দাঁড়ালেন। কাছে আসার পর মুহিত ভাই শামীম ভাইকে সমস্যার কথা জিজ্ঞেস করলেন। যদি বেশি সমস্যা হয় তাহলে তাকে নিচে নেমে যাওয়ার কথা বললেন। কারণ উপরে গেলে আরো শরীর খারাপ হতে পারে। কিন্তু শামীম ভাই জানালেন উপরে যাওয়ার মতো সুস্থ আছেন তিনি।

সাথে আনা প্যাক লাঞ্চ এখানেই বরফের উপর বসে খেয়ে নিলাম। একটা কমলা, সেদ্ধ ডিম ও সিঙ্গারা খেয়ে আবার হাঁটা শুরু। বরফে পাথরের ছোট বড় বোল্ডার। এই পথেই এখন চড়াই। পথ আর সহজ হচ্ছে না।  আস্তে আস্তে কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে। আবহাওয়াও আর ভালো হচ্ছে না। এ এক ভয়ংকর আনন্দে সামনে এগিয়ে চলছি। চড়াই শেষ হচ্ছে না। হৃদস্পন্দন এতই বেড়ে গেছে যে দম নিতে পারছি না।  হৃৎপিণ্ড বের হয়ে যেতে চাইছে।  তবু থেমে নেই। সামনে যাওয়া ছাড়া বিকল্প কিছু নেই। তাই সামনে যেতেই হবে।



বিকেল ৩ টার সময় আমরা এই কঠিন চড়াই উঠে আসি। এখানেই আমাদের হাইক্যাম্প করা হয়েছে। আজকের মতো হাঁটা শেষে, তাই একটু দম ফিরে পেলাম। দা কিপাও আমাদের কিছু সময় আগেই এখানে চলে এসেছেন। আমরা আসার আগেই দা কিপা ও কিলি পেম্বা এখানে তাবু তৈরি করে ফেলেছে। আর দেরি না করে তাবুর ভেতরে ঢুকে গেলাম। এখানে তিনটি তাবু করা হয়েছে। আমরা সাতজন মানুষ তিনটি তাবু। একটি তাবুতে নূর ভাই, শামীম ভাই ও আমি থাকছি। পাশের তাবুতে মুহিত ভাই ও বিপ্লব ভাই। শেরপাদের তাবু আমাদের একটু উপরে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই দা কিপা আমাদের তাবুতে এসে গরম চা দিয়ে গেলেন। এক মগ চা। ছোট গ্যাস স্টোভে বরফ গলিয়ে গরম পানি করে চায়ে লিকার দিয়ে বানানো হয়েছে। চিনি ছাড় চা খেতে যেমন হয় তেমনি। তবু খেতে হচ্ছে। চা শেষ হতে না হতেই আবার দা কিপা স্যুপ দিয়ে গেলেন। কয়েকটি গাজর কেটে ও ভুট্টা দিয়ে স্যুপ বানানো হয়েছে। তাও আবার লবণ ছাড়া। মরিচ ছাড়া। তবু খেতে অমৃতের মতো লাগছে। লাগবেই না কেন? পেটে যে ক্ষুধার বদ্ধভূমি। এই সব খাবার ছাড়া আর কোনো খাবার নেই। বেসক্যাম্পে নেমে যাওয়ার আগ পর্যন্ত এসবই খেতে হবে।

পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা আজ হাইক্যাম্পেই রাত কাটাবো। কাল কেয়াজো-রির কোলে গিয়ে ক্যাম্প-১ স্থাপন করবো। তারপর সেখান থেকে আমরা সামিটের উদ্দেশ্যে আরোহণ করবো। কিন্তু সন্ধ্যায় কিলি পেম্বা শেরপা আজ রাতেই সামিট পুশ করার কথা বললেন। কারণ আবহাওয়া ভালো হতে শুরু করেছে। পথে তুষারের পরিমাণ কম। কোল থেকে সামিট পর্যন্ত রোপ লাগানো আছে। আর বড় কথা আমাদের শরীরও সুস্থ আছে। মুহিত ভাই আমাদের সকলে সম্মতি নিয়ে রাতেই সামিট পুশ করার সিদ্ধান্ত নেন। আর সবাইকে মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে বলেন।



সিদ্ধান্ত হলো রাত ১২টায় সবাই চা, স্যুপ খেয়ে আরোহণের জন্য প্রস্তুতি নেবো। ঠিক রাত একটায় আমরা সামিটের উদ্দেশ্যে আরোহণ করবো। তাই মুহিত ভাইয়ের কথামতো সবাই তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে গেলো। একটি মজার বিষয় হলো নূর ভাই খুব দ্রুত ঘুমিয়ে যায়। হোক বসে, হোক শুয়ে। ঘুমাতে একটু সময়ও লাগে না তার। আমি কিছু সময় আমার ছোট নোট বুকে কলমের সঙ্গ দিলাম। সবাই ক্লান্ত তাই ঘুমিয়ে পড়েছে দ্রুত। আমিও অনেক ক্লান্ত কিন্ত এক বিন্দুও ঘুম আসছে না। নানান চিন্তা মাথায় ভনভন করে ঘুরছে। মাথা ব্যথাটাও আছে। পেটে আছে ক্ষুধা। সামনে কি হবে না হবে। ইত্যাদি চিন্তা তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। বাড়ির কথা মনে পড়ছে। মা বাবা ছোট ভাই তাদের চেহারা চোখের সামনে ভেসে উঠছে। খুব মনে পড়ছে তাদের।
(চলবে)




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১ সেপ্টেম্বর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়