ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

ছোটনাগপুর মালভূমির পরেশনাথ

ইকরামুল হাসান শাকিল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৩৬, ২২ অক্টোবর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ছোটনাগপুর মালভূমির পরেশনাথ

ইকরামুল হাসান শাকিল : রাত সাড়ে বারোটার দিকে ট্রেন প্লাটফর্মে এলো। ট্রেনে উঠে আমাদের সিট খুঁজে পেতে কষ্ট হলো। আমাদের দুই জনেরই এসি লোয়ার স্লিপার সিট। একজন ভদ্রলোক স্ত্রী ও দুটো বাচ্চা নিয়ে আমাদের কামড়াতে উঠলো। তাদের সিট উপরে। ভদ্রলোক আন্তরিকতার সাথে বললো- আমরা যদি আমাদের নিচের সিট দুটো ছেড়ে দিয়ে তাদের উপরের সিটে যাই তাহলে বাচ্চাদের জন্য সহজ হবে। এই ছোট ছোট বাচ্চা নিয়ে উপরে ওঠা-নামা বেশ কষ্টসাধ্য। আমরা দু’জন উপরে তাদের সিটে গিয়ে আমাদেরটা ছেড়ে দিলাম। তারা যাবে উত্তর প্রদেশ পর্যন্ত। সেখানেই তাদের বাড়ি, কলকাতা এসেছিল বেড়াতে। আরো একটি পরিবার আমদের কামড়াতেই উঠলো। তারা চারজন। দুইজন আমাদের কামড়ায় আর বাকি দুইজন পাশের কামড়ায়। তারাও অনুরোধ জানালো আমাদের সিট তাদের দিয়ে আমরা যেনো তাদের সিটে যাই। তাহলে তারা একসঙ্গে যেতে পারবে।  তাদেরকেও আমরা সিট ছেড়ে দিলাম। যে ট্রেন রাত সাড়ে আটটায় ছাড়ার কথা ছিলো সেই ট্রেন রাত প্রায় একটায় ছাড়লো।

ঝক্ ঝকা ঝক্ শব্দে ট্রেন ছুটে চললো। শীতাতপ নিয়ন্ত্রীত কামরা হওয়ায় জানালা খুলে বাইরের বাতাস গায়ে ছোঁয়াতে পারলাম না। বাইরে রাতের অন্ধকার থাকায় তেমন কিছু দেখাও যাচ্ছে না। রাত এগিয়ে যাচ্ছে নতুন দিনের দিকে। তাই সবাই নিজ নিজ সিটে শুয়ে ঘুমের সমুদ্রে সাঁতার কাটছে। আমিও চেষ্টা করছি ঘুমানোর। আগের রাতেও বাসে তেমন ঘুমাতে পারিনি। সারাদিনেও বিশ্রাম নেয়ার সুযোগ হয়নি। চলন্ত ট্রেনের শব্দে, দুলতে দুলতে একসময় আমিও ঘুমিয়ে পরলাম।

‘এই চায়ে, চায়ে... পাঁচ রুপিয়া। এই চায়ে, চায়ে...’ হকারের ডাকে ঘুম ভেঙে গেলো। নিচে তাকিয়ে দেখি সানভি ভাই জানালার পাশে বসে আছে। আমিও নিচে এসে জানালার পাশে বসলাম। বাইরে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম আমরা এখন পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে ঝাড়খণ্ড এসে পরেছি। ঝাড়খণ্ডের ছোটনাগপুর মালভূমির উপর দিয়ে ট্রেন ছুটে চলছে। এই মালভূমি দাক্ষিণাত্য মালভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন একটি মালভূমি। এটি পূর্ব ভারতের পাঁচটি রাজ্য জুড়ে বিস্তৃত। এই রাজ্যগুলি হলো ঝাড়খণ্ড, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা ও ছত্তীসগঢ়। তবে এই মালভূমির বেশির ভাগ অংশ ঝাড়খণ্ড রাজ্যে অবস্থিত। ছোটনাগপুর মালভূমিকে ভারতের ‘খনিজ ভাণ্ডার’ বলা হয়। কারণ ভারতে উৎপাদিত বেশির ভাগ খনিজ এই মালভূমি অঞ্চল থেকে আহরণ করা হয়। এই মালভূমির সব থেকে উঁচু স্থানের নাম পরেশনাথ পাহাড়। এর উচ্চতা ১ হাজার ৩৫০ মিটার। এই পাহাড়ে চব্বিশজন তীর্থঙ্করের মধ্যে বিশজন সমাধির মাধ্যমে মোক্ষলাভ করেছিলেন বলে জৈন মতে বিশ্বাস করা হয়। এছাড়া তেইশতম তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথ এই পাহাড়ে মোক্ষলাভ করেছিলেন বলে এই পাহাড়কে পার্শ্বনাথ বা পরেশনাথ পাহাড় নামে নামকরণ করা হয়।

এই মালভূমির উপর দিয়ে তিনটি প্রধান নদী বরাক নদী, দামোদর নদ, সুবর্ণরেখা নদী বয়ে গেছে। বরাক নদী হচ্ছে দক্ষিণ আসামের একটি প্রধান নদী এবং সুরমা-মেঘনা নদীর অংশ। এই নদী উৎপত্তি হয়েছে মণিপুর রাজ্যের পাহাড়ে। বদরপুরের কাছে এসে সুরমা ও কুশিয়ারা নামে দুটি শাখায় বিভক্ত হয় এবং বাংলাদেশের সিলেটের সমভূমিতে এসে দুটি শাখা আবার মিলিত হয়েছে। এই মিলিত ধারা সাধারণভাবে বরাক নদী হলেও স্থানভেদে এটি কালনী, ভেড়ামোহনা, বলেশ্বর ও মেঘনা নামে পরিচিত।
ঝাড়খণ্ড রাজ্য ছেড়ে বিহার হয়ে ট্রেন এখন উত্তরপ্রদেশ। এই উত্তরপ্রদেশের রাজধানী লখ্‌নৌ। হঠাৎ মনে পড়ল- অতুলপ্রসাদ সেনের কথা। ‘মোদের গরব, মোদের আশা। আমারি বাংলা ভাষা’ গানটি মুক্তিযুদ্ধের সময় অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের। তিনি ব্রিটিশ ভারতবর্ষের ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি গীতিকার, সুরকার ও গায়ক ছিলেন। তিনি একজন বিশিষ্ট সঙ্গীতবিদও ছিলেন। তাঁর রচিত গানগুলোর মূল উপজীব্য বিষয় দেশপ্রেম, ভক্তি ও প্রেম। তাঁর জীবনের দুঃখ ও যন্ত্রণাগুলি তাঁর গানের ভাষায় বাঙ্‌ময় মূর্তি ধারণ করেছিল: ‘বেদনা  অতুলপ্রসাদের গানের প্রধান অবলম্বন’। এই অতুলপ্রসাদ সেনের অর্ধেক জীবন কেটেছে লখ্‌নৌতে।



ট্রেনে একটি রাত ও একটি পুরো দিন কেটে গেলো। আবার সন্ধ্যা নেমে এলো। স্টেশনে স্টেশনে যখন ট্রেন কিছু সময়ের জন্য থামতো তখন জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে শুধু মানুষের ছুটে চলা, ট্রেনের অপেক্ষায় বসে থাকা কৌতূহলী মানুষগুলো দেখছি। এই ট্রেনেই পরিচয় হলো গৌতম চৌধুরী ও নিলয় বন্ধু করের সাথে। তাদের দুইজনের বয়স প্রায় ষাটের কোটায়। তারাও কলকাতা থেকেই উঠেছেন। তারা যাচ্ছে চারধাম। চারধামগুলো হলো গঙ্গোত্রী, যমুনোত্রী, কেদারনাথ এবং বদ্রীনাথ। এর আগেও এসেছিল একটিতে। তারা অবশ্য তীর্থযাত্রী হিসেবে আসেনি। এসেছে ট্রেকিং করতে। দুইজনেই চাকরি থেকে অবসরে আছেন। তাই সময় করেই মাঝে মাঝে বেড়িয়ে পরেন কোথাও না কোথাও।

আজও সারারাত ট্রেনেই কেটে যাবে। তাই রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে শুয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলাম। অন্ধকারের মধ্যে গাছপালা, গ্রাম, ঘরবাড়ি উল্টো পথে দৌড়ে চলছে। দূরের জনপদ থেকে জোনাকির আলোর মতো লাইট দেখা যাচ্ছে। ট্রেনে দ্বিতীয় রাতটিও কেটে গেলো। উত্তরাখাণ্ড রাজ্যের সূর্য আমাদের স্বাগত জানালো। আমাদের ট্রেন যদি সময় মতো হাওড়া থেকে ছেড়ে আসতো তাহলে আমরা সকালেই পৌঁছে যেতাম। যেহেতু ট্রেনটি দেরি করে ছেড়ে এসেছে সেহেতু আমাদের ট্রেন স্বাভাবিকভাবেই দেরিতে পৌঁছাবে। অবশেষে আমরা বিকেল তিনটেয় হরিদ্বার এসে পৌঁছলাম। আজ আমাদের এখানেই হোটেলে থাকতে হবে। আমাদের সাথে কলকাতা থেকে আসা গৌতম চৌধুরী ও নিলয় বন্ধুকর আগে থেকেই এখানে হোটেল বুকিং করেই এসেছেন। তারা যে হোটেল উঠবেন সেখানে ফোনে কথা বলে আমাদের জন্যও একটি রুম নেয়া হলো। তাদের সাথেই হোটেলে চলে এলাম। হোটেলটা গঙ্গাঘাটের খুব কাছেই। হোটেলের মালিক বাঙালি। নাম পীযুষ রায়। অনেক হাসিখুশি মানুষ। তার বাড়ি পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশপরগনায়। প্রায় বিশ বছর যাবত তিনি এখানে আছেন। হোটেলে চেক-ইন করে গোসল সেরে নিলাম। তিন দিন ধরে গোসল করা হয়নি। তাই শরীর ভারী হয়ে আছে। (চলবে)



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২২ অক্টোবর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়