ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

মেঘ ঝরে ঝরে জল উড়ে উড়ে

সাইফ বরকতুল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:৪৬, ২ নভেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মেঘ ঝরে ঝরে জল উড়ে উড়ে

রাক্ষসপুরী,গ্যালেংগা

সাইফ বরকতুল্লাহ : যেদিন রাতে আমরা রওনা হবো, সেদিন সকালে ভারতে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ‘তিতলি’। ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে ওড়িশার গোপালপুর এবং কলিঙ্গপট্টনমে তিতলি আছড়ে পড়ে। সঙ্গে প্রবল জলোচ্ছ্বাস, বৃষ্টিপাত। সকাল ৮টার দিকে খবর পাই তিতলির আঘাতে ভারতের অন্ধ্র প্রদেশে দুইজন মারা গেছেন। ঘূর্ণিঝড়প্রবণ পাঁচ জেলায় রেড এলার্ট জারি করা হয়েছে। এদিকে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরসমূহকে ৪ নাম্বার স্থানীয় হুঁশিয়ারি সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। 

সকালে অফিসে যাই। শীত অনুভূত হচ্ছিল। চিন্তা করছি কীভাবে যাবো এই প্রতিকূল আবহাওয়ায়। এদিকে আমাদের ট্যুরের গ্রুপ লিডার কবি ও গীতিকার সৈয়দ জামিল কিছুক্ষণ পরপর ফেসবুকে স্টেটাস দিয়ে আপডেট জানিয়ে দিচ্ছেন। সকাল সাড়ে ৯টায় তিনি স্টেটাস দেন, ‘আশা করি তিতলি আমাদের বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। এই ছোটখাটো দুর্যোগ রাতেই কেটে যাবে। ফুঁ।’
 

পাহাড়ে ঝিরিতে


দিন কেটে গেল। বিকেলে সমুদ্র সংকেত নামিয়ে ফেলা হলো। আমরা রাতে রওনা দিলাম ঢাকা থেকে বান্দরবানের উদ্দেশ্যে। বাস যখন ঢাকা অতিক্রম করছিল তখন রাত সাড়ে দশটা। সৈয়দ জামিল ভাই ফেসবুকে জানিয়ে দিলেন, ‘বিরূপ আবহাওয়া আমাদের বাধা হয়ে উঠতে পারেনি। আমরা যাচ্ছি রাক্ষসপুরীতে। এইমাত্র বাস ছাড়ল আমাদের। কয়েকজন অবশ্য আবহাওয়া খারাপের জন্য যাত্রা বাতিল করেছে। এতে আমাদের কিছুটা অসুবিধা হলেও আমরা সেটাকে পাশ কাটিয়েই রওনা হলাম।’

আমরা যাচ্ছি। আমাদের যাত্রার সঙ্গী গল্পকার ও দ্য ক্লাউড ইকো রিসোর্টের হানিফ খোকন ভাই, শিল্পী তুষার নোমানী, কবি ইমতিয়াজ ইমতু, মহসিন মানসুর, মোরাদ ও জামিল ভাই। ঢাকা থেকে আমরা ৩৭৬ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে সকাল ৭টায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি বান্দরবান শহরে পৌঁছে যাই। পথে শেষ রাত থেকে টানা বৃষ্টি, হালকা শীত, মেঘ, ঝরনা আমাদের দারুণভাবে আকৃষ্ট করে। বান্দরবানের আয়তন ৪৪৭৯ বর্গ কিলোমিটার। রয়েছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য। আর অবারিত সবুজের সমাবেশ। আমরা যখন চট্টগ্রাম অতিক্রম করি তখন থেকেই একটানা বৃষ্টি হচ্ছে। বান্দরবান নেমে হাত-মুখ ধুয়ে হোটেলে সকালের খাবার খেলাম। তারপর বান্দরবান সদর থেকে ৪৭ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বদিকে লামা হয়ে আমরা গেলাম সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২২০০ ফুট উপরে নীলগিরির পাশ দিয়ে থানচি (বান্দরবান শহর থেকে থানচির দূরত্ব ৮২ কিলোমিটার)।
 

সাঙ্গু নদী হয়ে রুমা যাচ্ছি


পথে বৃষ্টি থামছেই না। বৃষ্টির সঙ্গে পাহাড়ে মেঘ যেন একদম আমাদের শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছে। শহর থেকে আমরা রিজার্ভ চাঁদের গাড়ি ভাড়া নিয়ে থানচি পৌঁছাই। যেতে সময় লাগে প্রায় তিন ঘণ্টা। যেতে আঁকাবাঁকা পথ আর বৃষ্টি, সঙ্গে পাহাড়- এ যেন অন্যরকম ভালোলাগা। এরপর থানচি উপজেলার বলীপাড়া বিজিবি ক্যাম্পে নাম এন্ট্রি করতে হয় আমাদের। তখনও গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। বলীপাড়া বাজারে প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করলাম। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে বড় বড় পলিথিন কিনলাম। কারণ এটিই শেষ বাজার। এরপর দুদিন আর কোনো বাজারের দেখা পাওয়া যাবে না। নেই বিদ্যুৎ।

বেলা ১২টা। বৃষ্টি হচ্ছে তো হচ্ছেই। আমরা বলীপাড়া ঐতিহাসিক সাঙ্গু নদীর ঘাট থেকে নৌকায় রুমা উপজেলার গ্যলেংগার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম। নদী পথের এই যাত্রায় আমরা পেলাম এক স্বর্গীয় অনুভূতি। দুপাশে পাহাড়, ঝরনা আর বিস্তীর্ণ সবুজ। নৌকায় আমরা। এদিকে বৃষ্টি হচ্ছে। আর সঙ্গে তুষার ভাইয়ের গলা ছেড়ে গান। আহা! কী আনন্দ। 
 

মেঘ পাহাড়ের  লুকোচুরি


প্রায় ঘণ্টাখানেক যাবার পর পৌঁছে গেলাম গ্যলেংগা ঘাটে। তখন দুপুর। বৃষ্টি হচ্ছেই। আমরা দ্য ক্লাউড ইকো রিসোর্টে ব্যাগ রেখে নদীতে গোসল সেরে নিলাম। একটানা বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে শরীর সিঁটিয়ে গেছে। শীত লাগছে। শরীর গরম করতে রিসোর্টের কেয়ারটেকার সবুর ভাইকে বললাম, শরিষার তেল আছে না কি? উনি বললেন না, এখানে পাওয়া যাবে না। পরে দুপুরের খাবার খেয়ে সবাই গা এলিয়ে দিল। দিতে দিতেই অনেকে তলিয়ে গেল ঘুমের রাজ্যে। আমি জেগে রইলাম। 

সন্ধ্যা। রিসোর্টে বসে আমরা মেঘ আর পাহাড় দেখছি। রাত বাড়তে থাকল। রাতে আমরা ক্যাম্প ফায়ার করলাম। অনেক ছবি তুললাম। একটা ছবি ছিল স্পেশাল। হানিফ ভাই আগুনের একটা কাঠ নাড়া দিতেই আগুনের শিখা লাফিয়ে ওঠে। ঠিক তখন, সেকেন্ডেরও কম সময়ের ব্যবধানে সেলফোন দিয়ে দৃশ্য ধারণ করা হয়। হানিফ ভাই ছবিটার শিরোনাম দিয়েছে ‘দ্য মোমেন্টাম’। গাওয়া হচ্ছে গান, কবিতা, কৌতুক। সঙ্গে হানফি ভাই, জামিল ভাই, তুষার ভাইয়ের গান। আমরাও গাচ্ছি। তুষার ভাই মাঝে মাঝেই সাদত হাসান মান্টো আর খুশবন্ত সিংয়ের গল্প শোনাল। 
 

দ্য মোমেন্টাম


রাত তখন ১১টা। সবার পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধা। ঝিরির কাঁকড়া আর সাঙ্গু নদীর মহাশোল পাওয়া যায়নি। গত কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে পানি বেড়ে যাওয়া এবং তীব্র স্রোতের কারণে জেলেরা নদীতেই নামছে না। ঝিরির গর্ত থেকে কাঁকড়াও বের হচ্ছে না। কাঁকড়া আর মহাশোলের বদলে আমরা খেলাম বন মোরগ, পাহাড়ি সবজি আর ডাল দিয়ে ভাত। রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লাম।

সকাল আটটা। সবাই ঘুম থেকে উঠল। সবুর ভাইয়ের রান্না ভুনা খিচুড়ি আর বন মোরগের ঝোল দিয়ে নাস্তা সেরে আমরা চলে গেলাম ‍রাক্ষসপুরীতে। চারপাশে পাহাড় আর মেঘ। এখানে জামিল ভাই বানিয়েছেন আড্ডা মাচাং। মাচাংয়ে উঠতেই মেঘ এসে আমাদের শীতল করে দিল। আহা কী প্রশান্তি। মন জুড়িয়ে গেল। চোখে ঘুম ঘুম ভাব। আমরা দেখছি মেঘ। মেঘের এত কাছাকাছি আর কোনোদিন যাওয়া হয়নি। এ এক অসাধারণ সময়, যা কোনোদিন ভুলবার নয়। আড্ডা মাচাং থেকে পাহাড়ে নামছি। পথে গাছ থেকে তুষার ভাই আর আমি পেয়ারা ছিঁড়ে খাওয়া শুরু করলাম।

আমরা চলে এলাম পাহাড়ি ঝিরিতে। এই ঝিরির ন্যাচারাল মিনারেল ওয়াটার এখানকার মানুষ পান করে। খুবই ঠান্ডা পানি, সুমিস্ট। স্থানীয়রা জানান, এখানে একজন আউলিয়া জীন বাস করে। অনেকেই তাকে দেখেছেন। পাশে জঙ্গল ঘেরা একটি মসজিদ আছে। সেখানে ইবাদত করে সেই জীন। আমরা দেখি নাই। এই ঝিরির রূপ অসাধারণ। তবে কেউ যেতে চাইলে অবশ্যই পবিত্র হয়ে যেতে হয়। কোনোভাবেই প্রস্রাব, পায়খানা বা গোসল করা চলবে না। এই ঝিরির ভেতরটা অদ্ভুত সুন্দর! ছবি তুলে এই সুন্দর বোঝানো যাবে না। তবে এখানে জামিল ভাইয়ের সাথে রহস্যময় ঘটনা ঘটেছে। ঝিরি ধরে অনেক পথ এগিয়ে যান তিনি। ফেরার সময় দুটি গাছের ডাল (ক্রসভাবে লেগেছিল) সরে যায় এবং একটি মাটিতে পড়ে যায়। তিনি সেটি হাতে নিয়ে সরিয়ে পাশ দিয়ে হেঁটে আসেন। দুবার এমন ঘটেছে। 
 

রুমা বাজারে চাঁদের গাড়ির অপেক্ষায়


পর দিন আমরা গ্যালেংগা থেকে সাঙ্গু নদী দিয়ে রুমা যাচ্ছি। পথে প্রায় ২০টির মতো ঝরনা দেখলাম। সাঙ্গুর গহীন অঞ্চলে আদিম বন আছে। নদীর তীরে নৌকায় চড়ে যেতে যেতে আমরা দেখতে পেলাম পাহাড়ি বুনো গয়াল। এরপর আমরা পৌঁছে গেলাম রিঝুক ঝরনা পয়েন্টে। তখন সাঙ্গু নদীতে পানি বিপদসীমার অনেক ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যেখানে ঝরনার জলে পর্যটক আনন্দে অবগাহন করে সেটা আনুমানিক বিশ ফিট পানির নিচে। আর সেই পানিতে জলের উল্টাপাল্টা ঘূর্নি। ফলে পানিতে আর নামা হলো না। তুষার ভাই বলল, চলেন ওপরে উঠি। নৌকায় সবকিছু রেখে কোমড়ে গামছা বেঁধে উঠে পড়লাম পাহাড়ে। ওপরে গিয়ে দেখলাম একটা নয়, ঝরনার উৎসমুখ অনেকগুলো। এখান থেকে গড়িয়ে গেলে সোজা নদীতে পড়ে ভাসতে হবে, নয়তো মৃত্যু। অতিরিক্ত জামাকাপড় না থাকায় গামছা পরেই গোসলে নেমে গেলাম আমরা। শীতল জলে দীর্ঘ সময় ধরে গোসল করলাম। এই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা যায় না!
 

পাহাড়ি খাবার মুরগির চাটনি, তোজা, বাঁশ কোড়ল, মরিচের চাটনি, স্যুপ


এরপর আমরা চলে গেলাম রুমা বাজার। এখানে চাঁদের গাড়িতে আমরা ফিরছি বান্দরবান শহরে। বিকেল পাঁচটা। আমরা বান্দরবান শহরে নেমে চলে গেলাম পাহাড়ি খাবার তৈরি করে এমন এক হোটেলে। সেখানে মুরগির চাটনি, তোজা, বাঁশ কোড়ল, মরিচের চাটনি, স্যুপ সঙ্গে জুম চালের সাদা ভাত খেলাম। অন্যরকম স্বাদ আছে খাবারে। তবে একটু ঝাল বেশি।

এবার বিদায়ের পালা। বাস ছাড়বে রাত সাড়ে আটটায়। আমরা কিছুটা কেনাকাটা সেরে নিলাম। অলস সময়টুকু চা, গল্প আর মোবাইল চার্জ দিতে দিতে (গত দুই দিন সবার মোবাইলে চার্জ না থাকায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, গ্যালেংগায় বিদ্যুৎ না থাকায় চার্জ দেওয়া সম্ভব হয়নি) কখন যে আটটা বেজে গেল বুঝতে পারিনি। যখন বাসে উঠি তখন বান্দরবান শহরে এক দোকান থেকে কানে ভেসে এলো গান- ‘মেঘ ঝরে ঝরে, জল উড়ে উড়ে/ভালবাসা তাই ভেজা মন থাক/ভালবাসা তাই ভিজে একাকার/ভেজা মন থাক রোদের আশায়/ইচ্ছে হলে ভালবাসিস, না হয় থাকিস/যেমন থাকে স্নিগ্ধ গাংচিল।’

আলোকচিত্র : হানিফ খোকন, তুষার নোমানী, ইমতিয়াজ ইমতু, মহসিন মানসুর ও লেখক




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২ নভেম্বর ২০১৮/সাইফ/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়