ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

স্বর্গলোকের তোরণদ্বারে

ইকরামুল হাসান শাকিল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:০৫, ৩ নভেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
স্বর্গলোকের তোরণদ্বারে

ইকরামুল হাসান শাকিল : গাড়োয়ালের প্রবেশদ্বার বলা হয় হরিদ্বারকে। এখান থেকেই মূল যাত্রা শুরু হয়। ভোর পাঁচটায় চোখে এক সমুদ্র ঘুম নিয়ে উষ্ণ বিছানা ছেড়ে প্রস্তুত হয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে পরলাম। আজ আমরা এখান থেকে উত্তরকাশী যাব। সকাল থেকে মাঝ রাত পর্যন্ত মানুষের কোলাহলে মুখর জায়গাটি এখন একদম শান্ত। এই শান্ত রাস্তায় আমরা হেঁটে হেঁটে চলে এলাম মোটেল রাহীর সামনে। হরিদ্বার রেল স্টেশনের ঠিক সামনেই বাস স্ট্যান্ডের পাশে মোটেল রাহী। এটি সরকারি মোটেল। এখান থেকেই আমরা উত্তরকাশীর বাসে উঠব। ভোর পৌনে সাতটায় মাত্র একটা বাস এখান থেকে উত্তরকাশীর উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। আমাদের বাসের টিকেট আগে থেকে সংগ্রহ করা। সুতরাং ভাবনার কিছু নেই। সময়ও আছে কিছুটা। লক্ষ্য করলাম, পাশেই একটি ছোট চায়ের দোকান। চা-বিস্কুট দিয়েই সকালের নাস্তা সেরে নিলাম। বাস এসে দাঁড়াতেই উঠে গেলাম। ঠিক সময় মতো বাসটি উত্তরকাশীর উদ্দেশ্যে ছাড়লো।
 


হরিদ্বারের সমতল ভূমি ছেড়ে আমরা আস্তে আস্তে পাহাড়ের গাঁ বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করলাম। ঘন সবুজের ভিতর দিয়ে পাহাড়ি পথে এগিয়ে চলেছি। একুশ কিলোমিটার পথ পারি দিয়ে চলে এলাম ঋষিকেশ। হিমালয়ের পাদদেশে ঋষিকেশের অবস্থান। গঙ্গার পাড়ে এই তীর্থভূমি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক মায়াময় ও মোহময় জায়গা দখল করে আছে। স্বর্গলোকের তোরণদ্বার ঋষিকেশ তাই এর নাম দেবতার নামেই। এখান দিয়েই যাত্রা শুরু হয় পর্বতের দিকে দিকে। আকাশ ছোঁয়া পাহাড়, গঙ্গার শীতল জলের স্রোত আর সবুজের সমারোহের মিলনস্থল এই ঋষিকেশ। মহিমান্বিত হিমালয়বেষ্টিত সবুজ উপত্যকা যে কারো তৃষ্ণার্ত হৃদয় শান্ত করে তুলবে। ভারতবর্ষের বিভিন্ন পবিত্র স্থানের ন্যায় এখানেও মাংস, ডিম ও অ্যালকোহল নিষিদ্ধ। ঋষিকেশ বিশ্বজুড়ে যোগ ব্যায়ামের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অনেক লোক এখানে আসেন যোগশাস্ত্রের উপর শিক্ষা নিতে এবং আত্মাকে পুনরুজ্জীবনের জন্য প্রস্তুত করতে। এই প্রসিদ্ধ স্থানে আগেরবার থাকার দারুণ অভিজ্ঞতা রয়েছে আমার। দেখেছি সাধু-সন্ন্যাসীদের মিলন মেলা। সেবার তিনদিন নিজের মতো আবোল-তাবোল ঘুরে বেড়িয়েছি একা। এবার আর এই পূণ্যভূমিতে পা ফেলা হলো না। বাসটি শহরটির ভিতর দিয়ে এগিয়ে চলছে। বাসের জানালা দিয়ে শুধু রাস্তার পাশের দালান, দোকান, দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িগুলোর পেছনে ছুটে চলা দেখছি। এই চার বছরে ছোট্ট শহরটির কত পরিবর্তন হয়েছে। দেখতে দেখতে ঋষিকেশ শহর থেকে বেড়িয়ে এলাম। সামনেই আকাশ ছোঁয়ে সটান দাঁড়িয়ে আছে সবুজের কার্পেট মোড়ানো পাহাড়। বাস তার প্রায় সমস্ত শক্তি ব্যয় করে আকাবাঁকা সাপের মতো পথ ধরে আস্তে আস্তে উঠে এলো পাহাড়টির একদম উপরে। এখন উপর থেকে পুরো শহরটিকে দেখছি। কখনো পাহাড়ে গাঁ বেয়ে, কখনো আকাশ ছোঁয়া পাহাড়ের উপর দিয়ে, কখনো ভয়ে শরীরের রক্ত বরফ করে গভীর খাদের পাশ ঘেঁষে বাস এগিয়ে চলছে।

দূর থেকেই দেখা যাচ্ছে উত্তরকাশী শহর। এই ছোট্ট ছবির মতো সুন্দর জেলা শহরে প্রবেশ করতে হয় একটি পাহাড়ের ভিতর দিয়ে সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে। আগে যখন এসেছিলাম তখন এটি চালু হয়নি। নির্মাণ কাজ চলছিলো। আমার সবচেয়ে পছন্দের শহরও এটি। চারপাশে পাহাড় দিয়ে ঘেরা এই শহরটি যে কাউকে মুগ্ধ করবে। উত্তরকাশী শব্দটির অর্থ হলো উত্তরের কাশী। এটি ভারতের উত্তরাখণ্ডের একটি জেলা শহর। সমুদ্রতল থেকে ১ হাজার ১৫৮ মিটার উচ্চতায় ভাগীরথী নদীর তীরে এই শহরের অবস্থান। এখানে অসংখ্য মন্দির এবং আশ্রম দেখা যায়। কাশী (বারাণসী) অর্থাৎ বারাণসী শহরের সঙ্গে এই শহরের নামের সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। বরুণ পর্বতের পাশে বরুণা এবং অসি নদীর সঙ্গমস্থলে এই শহরের অবস্থান। উত্তরকাশী হিমালয়ের একটি অত্যন্ত প্রাচীন তীর্থক্ষেত্র। অসংখ্য সাধু সন্ত এখানে বিমুক্তকামী হয়ে সাধনা করেছিলেন। পবিত্র এই তীর্থক্ষেত্রকে অর্ধচন্দ্রাকারে বেষ্টন করে বয়ে চলেছে উত্তরবাহিনী গঙ্গা ভাগীরথী। উত্তরকাশীর মূল ভূখণ্ডের অধিকাংশই পাহাড়ি অঞ্চল এবং এই অঞ্চলের উপর দিয়ে উত্তরকাশী জেলার অনেক ছোট এবং বড় নদী প্রবাহিত হয়েছে। যার মধ্যে যমুনা এবং ভাগীরথী অন্যতম। ভাগীরথী যাকে সবাই গঙ্গা নামেই বেশি চেনে। এই ভাগীরথী বা গঙ্গাই সবচেয়ে বড় এবং পবিত্র নদী। এই দুই নদীর উৎপত্তিস্থল যমুনোত্রী ও গঙ্গোত্রী যা গোমুখ নামেও পরিচিত এই জেলাতেই অবস্থিত। উত্তরকাশীর গড় স্বাক্ষরতার হার শতকরা ৭৮ জন, যা জাতীয় গড়ের তুলনায় বেশি। পুরুষদের ক্ষেত্রে গড় স্বাক্ষরতার হার শতকরা ৮৩ জন এবং নারীদের মধ্যে এই হার শতকরা ৭১ জন। দুর্গম পাহাড়ি এলাকা হলেও এখানকার মানুষ শিক্ষায় পিছিয়ে নেই। অধিকাংশ মানুষই গাড়োয়ালি। এছাড়াও বৃহৎসংখ্যক পাঞ্জাবি, কুমায়ুনি ও উত্তর ভারতের অন্য অংশের লোকজন এখানে বসবাস করেন। এই অঞ্চলের মানুষ হিন্দি ও গাড়োয়ালি ভাষায় কথা বলেন।
 


২০০৩ সালে আশপাশের এলাকায় ভয়াবহ ধ্বসের ফলে অন্যান্য শহর থেকে অনেক লোক এই শহরে চলে আসে এবং বসবাস শুরু করেন। ফলে এই শহরের জনবসতি উল্লেখযোগ্যভাবে তখন থেকে বেড়ে যায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শহরের উন্নতি এবং জনসংখ্যা দুইয়েরই বৃদ্ধি হয়। কিন্তু ২০১২ এবং ২০১৩ সালে ভয়াবহ বন্যা বিপর্যয়ের ফলে এই শহর দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে এই শহর থেকে বহু লোক আবার দেরাদুনের মতো নিরাপদ স্থানে চলে যায়। এই শহরের প্রায় প্রতিটি অলিগলি আমার চেনা। বাস থেকে নামার পরই টের পেলাম শীতের দেশে চলে এসেছি। (চলবে)

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩ নভেম্বর ২০১৮/তারা  

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়