ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

উচ্চতাজনিত অসুস্থতা আমাদের কেন হয়?

ইকরামুল হাসান শাকিল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৩৩, ১৪ নভেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
উচ্চতাজনিত অসুস্থতা আমাদের কেন হয়?

ইকরামুল হাসান শাকিল: প্রথম দিন ভোর পাঁচটার সময় ঘুম ভেঙে গেলো। ছ’টার সময় সবাই তৈরি হয়ে ফল-ইন করলাম নেহরুর ভাস্কর্যের সামনে তিন রাস্তার মোড়ে। শুরু হলো পাঁচ কিলোমিটার পাহাড়ি সর্পিল উঁচু-নিচু পথে দৌড়। দৌড়ের সাথে নানান ধরণের শারীরিক কসরত। দেহের শেষ শক্তি পর্যন্ত নিংড়ে বের করে নেয়া হলো। মনে হচ্ছিলো আর পারবো না, এখানেই থেমে যাই। আবার পরক্ষণেই মনে হলো- না থামবো না। যতক্ষণ দম আছে ততক্ষণ পিছ পা হবো না। চোখেও ঝাপসা দেখছিলাম। দেশেও প্রতিদিন রমনাপার্কে শরীর চর্চা করেছি, দৌড়েছি ৮ কিলোমিটার করে। সেসব কোনো কাজেই এলো না। মনে হলো অনেক কম প্রস্তুতি নিয়ে এসেছি। আর একটু বেশি প্রস্তুতি নিলে হয়তো কাজে দিতো। পা আর সামনে এগোতে চাচ্ছে না, তারপরও শেষ মুহূর্তের সিঁড়ি পথটুকু লাফিয়ে উঠতে হলো। তারপর শুরু হলো শারীরিক কসরত। শরীর থেকে টপটপ করে ঘাম ঝরে পরছে মাটিতে। মনেই হচ্ছে না আমরা শীতের মধ্যে আছি। হৃদস্পন্দন এত বেড়ে গেছে যে একে অপরের হৃদস্পন্দনের শব্দ শুনতে পাচ্ছি! শেষ পর্যন্ত সকালের পর্বটা ভালোভাবেই শেষ করলাম। তবে দেহের কোনো অংশই ব্যথার হাত থেকে নিস্তার পেল না। সকাল ৯টায় বিশ্রাম ও সকালের খাবার বিরতি পেলাম।

খাবার শেষে একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার চলে এলাম জ্ঞান হলের সামনে। এখানেই আমাদের রোপ ভাগ করা হলো। ছয়জন করে সাতটি রোপে ভাগ করা হলো। আমাদের বিদেশী তিনজনকে এক রোপে দিয়ে সাথে আরো তিনজনকে দিয়ে সাতজন মিল করে দেয়া হলো। থিনোয়ান গায়ান্থা (টিনো) কে অন্য একটি রোপে দেয়া হয়। আমাদের রোপ নাম্বার তিন। থমাস ম্যাকগাইভার (টম), এডেন গ্রেগরি, আরবিন রানা, নিরাজ ত্যায়াগি, আমানদীপ রাহী ও আমি। এখন থেকে আমরা এই ছয় জন ২৮ দিনের পরিবার। সকল কিছুই আমাদের একত্রে করতে হবে এবং একে অপরের সহযোগিতা করতে হবে। পর্বতারোহণ হলো একটি টিমওয়ার্ক। সকলের কাজের সমন্বয়েই সফলতা আসে।



প্রথমে আমাদের মেডিকেল চেকআপ হলো। তারপর আমরা স্টোর রুম থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহ করি। ব্যাকপ্যাক, মেট্রেস, স্লিপিং ব্যাগ, স্লিপিং ব্যাগ ইনার, ফেদার জ্যাকেট, উইন্ড প্রুফ জ্যাকেট ও ট্রাউজার, মিটন, হার্নেস, লং সিলিং, শর্ট সিলিং, টেপ সিলিং, জুমার, মেসটিন, মগ, চামচ, পানির বোতল, ক্র্যাম্পন, আইস এ্যাক্স, হেলমেট, পিএ সুজ, আইস বুট, গেটার, স্ক্রু ক্যারাবিনার, প্লেন ক্যারাবিনার, কিট ব্যাগ, দঁড়ি সবগুলো নিয়ে লাইব্রেরির সামনে এসে মেট্রেস বিছিয়ে চেক করে নিচ্ছি। যেন কোন প্রকার সমস্যা না থাকে। পরে সমস্যা দেখা দিলে পরিবর্তন করার সুযোগ পাওয়া যাবে না। দুপুরের খাবারের সময় হয়ে গেছে। ব্যাগে সবকিছু গুছিয়ে রুমে রেখে খাবারের লাইনে এসে দাঁড়ালাম।



বিকেল তিনটার সময় আমরা মৌলিক ও উচ্চতর প্রশিক্ষণার্থীরা সবাই অডিটোরিয়ামে চলে এলাম। এখন আমাদের প্রাথমিক চিকিৎসার ক্লাস হবে। ক্লাস নেবেন ভাইস-প্রিন্সিপাল ক্যাপ্টেন ডা. হিমেন্দ্রা সিং। পর্বতে উচ্চতাজনিত যেসব অসুস্থতা দেখা দিতে পারে এবং সেসবের চিকিৎসা সম্পর্কে ধারণা প্রদান করবেন। কেন উচ্চতাজনিত অসুস্থতা হয় আমাদের? আমাদের চারপাশে যে বায়ুচাপ আছে তাকে ব্যারোমেট্রিক চাপ বলে। যখন আমরা স্বাভাবিক উচ্চতা থেকে বেশি উচ্চতায় উঠে যাই, তখনই আমাদের এই সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। এর কারণ বায়ুচাপ ও অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যাওয়া। উচ্চতাজনিত সমস্যা শুরু হয় সাধারণত  ৮ হাজার ফুট উচ্চতা থেকে। উচ্চতায় তিন ধরণের সমস্যা দেখা দেয়। প্রথমত অ্যাকোয়ট মাউন্টেন সিকনেস (Acute Mountain Sickness – AMS)। এটি সাধারণত মধ্যম উচ্চতায় হয়ে থাকে। এর ফলে মাথা ঘোরা, মাথা ব্যথা, পেশী ব্যথা, বমিবমি ভাব, ঘুম কম হওয়ার লক্ষণ দেখা দেয়। দ্বিতীয়  উচ্চ উচ্চতাজনিত পালমোনারি ইডিমা (High Altitude Pulmonary Edema -  HAPE)। এটি হলে ফুসফুসে পানি আসে। ফলে কাশি হওয়া, বুকে কফ জমা, কফের সাথে রক্ত আসা, শ্বাসকষ্ট, মাথা ঘোরা, মাথা ব্যথা, পেশী ব্যথা, বমি বমি ভাব, ঘুম কম হওয়ার লক্ষণ দেখা দেয়। তৃতীয় উচ্চ উচ্চতাজনিত সেরিব্রাল ইডিমা (High Altitude Cerebral Edema - HACE)। ফলে মস্তিষ্কে পানি আসে যা সব থেকে বিপজ্জনক, এমনকি জীবন হুমকির সম্মুখীন হয়ে পরে। ফলে শরীর দুর্বল হওয়া, শ্বাসকষ্ট, হাঁটতে অসুবিধে হওয়া, ঘোরের মধ্যে থাকা, মাথা ঘোরা, মাথা ব্যথা, পেশী ব্যথা, বমি বমি ভাব, ঘুম কম হওয়ার লক্ষণ দেখা দেয়।



উচ্চতায় সুস্থ থাকতে হলে উচ্চতার সাথে সাথে দেহকে অ্যাক্লামাটাইজেশন করতে হয়। অ্যাক্লামাটাইজেশন হলো আবহাওয়ার সাথে দেহকে মানিয়ে নেয়া। এর জন্য কিছু নিয়ম ও শৃঙ্খলা মেনে চলতে হয়। ৮ হাজার ফুট উচ্চতা থেকে অ্যাক্লামাটাইজেশন শুরু করতে হয়। কমপক্ষে এক দিন থেকে আবহাওয়ার সাথে দেহকে মানিয়ে নিতে হয়। আর  প্রতি ৩ হাজার ফুট উচ্চতায় একাধিক দিন থাকতে হয়। যে উচ্চতায় রাতে ঘুমাতে হবে তার থেকে অধিক উচ্চতায় ঘুরে আসতে হয়। কথায় আছে Climb high and sleep lwo. প্রতিদিন কমপক্ষে ৩-৪ লিটার পানি পান করতে হয়। যত বেশি পানিসহ তরল খাবার  খাওয়া যাবে তত বেশি তারাতারি শরীর অ্যাক্লামাটাইজেশন হবে। যখনি উচ্চতাজনিত অসুস্থতা দেখা দিবে তখনি সাথে সাথে নিচে নেমে আসতে হবে। এটাই সব থেকে বড় প্রাথমিক চিকিৎসা। 




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ নভেম্বর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়