ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

পর্বতারোহণ সাধনার বিষয়, শেখার বিষয়

ইকরামুল হাসান শাকিল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৪৯, ২১ নভেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পর্বতারোহণ সাধনার বিষয়, শেখার বিষয়

ইকরামুল হাসান শাকিল : মে মাসের ২ তারিখ। আজ আমরা বেসক্যাম্পের উদ্দেশ্যে রওনা হবো। আজ যাবো তেলা ক্যাম্প। ক্যাম্পাসের বাসে প্রায় তিন ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে চলে এলাম ভুকি। এই পর্যন্তই বাসের পথ। এখান থেকে শুরু হবে আমাদের ট্রেকিং। ভুকি বাজার থেকে কিছুটা পথ নেমে গঙ্গার উপর ঝুলন্ত সাসপেনশন ব্রিজ পার হয়ে শুরু হলো চড়াই। সবাই এক লাইনে ট্রেকিং করতে হয়। তাই সবাইকে একই গতিতে থাকতে হয়। সাপের মতো দীর্ঘ একটা আঁকাবাঁকা লাইন পাহাড়ের খাড়া গাঁ বেয়ে উপরে উঠে আসছে। ভুকি গ্রামের ভিতর দিয়ে আমরা সামনে এগিয়ে চলেছি।

উপর থেকে ভুকি বাজার অনেক ছোট দেখা যাচ্ছে। শরীরের ভিতর থেকে একদম তেল বের করেই ছাড়লো এই তেলা ক্যাম্পের পথ। পা আর সামনে এগুতে চাইছে না। কিন্তু থামলেও চলবে না। বাধ্য হয়ে হাঁটতে হচ্ছে। অবশেষে বিকেল তিনটার দিকে আমরা ক্যাম্পে পৌঁছে গেলাম। সমুদ্রসমতল থেকে এর উচ্চতা ৮ হাজার ২০০ ফুট। প্রত্যেক রোপ তাদের নিজেদের তাবু নিজেরাই লাগাচ্ছে। আমরা আমাদের তাবু ঠিক করে দুপুরের খাবারের আয়োজন করলাম। বলাবাহুল্য পেটে তখন প্রচণ্ড ক্ষুধা। বিকেল থেকে আবহাওয়া খরাপ হতে শুরু করল। আবহাওয়া খারাপ হতে দেখে সন্ধ্যার মধ্যেই রাতের খাবার শেষ করতে হলো। সন্ধ্যার পরেই শুরু হলো ঝুম বৃষ্টি। তাবুর ভিতরেও পানি ঢুকে গেছে। সেই ভেজা জায়গাতেই মেট্রেস বিছিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।



সকালে উঠে দেখি মেট্রেস ভিজে স্লিপিং ব্যাগও কিছুটা ভিজে গেছে। বুটের ভিতরেও পানি ভর্তি। পানি ফেলে দুই জোড়া মোজা পরে তারপর বুট পরলাম। আজ প্রায় ১০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে যেতে হবে গুজ্জারহাট। পথটাও যেমন লম্বা তেমনি শুধু চড়াই আর চড়াই। সমুদ্রসমতল থেকে ১১ হাজার ১৫০ ফুট উপরে যেতে হবে। পাহাড় আর ঝিরি ধরে এগিয়ে চলছি। বড় বড় গাছ আর ঘন সবুজের ভিতর দিয়ে কচ্ছপ গতিতে পা টিপে হাঁটছি। যতই উপরে উঠছি ঠান্ডা ততই বেড়ে যাচ্ছে। ভেজা বুট থেকে মোজা ভিজে গিয়ে স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে গেছে। ঠান্ডায় ডান পা অসার। মাঝপথে দুপুরের খাবারের বিরতি দেয়া হলো পাহাড়ের ঢালে। সবাইকে প্যাকেট খাবার দেয়া হয়েছিলো তেলা ক্যাম্প থেকে। সেগুলো ঠান্ডায় শক্ত হয়ে গেছে। সেগুলো খেয়েই আবার ট্রেকিং শুরু হলো। গুজ্জারহাট পৌঁছানোর আগেই শুরু হয়ে গেলো তুষারপাত। এই উচ্চতায় বৃষ্টি হয় না। হয় তুষারপাত। সাথে সাথে তাপমাত্র নেমে গেলো শূন্যের কাছাকাছি। সেই তুষারপাতের মধ্যেই হেঁটে চলেছি। চারপাশ সাদা হয়ে গেলো । এমন কি সবুজ গাছপালাও। গুজ্জারহাট পৌঁছেই তাঁবু লাগিয়ে ভিতরে শরীর গরম করে নিলাম।



আজকের আকাশ বেশ পরিষ্কার। রোদও উঠে গেছে। আমরা তাবু গুছিয়ে সকালের খাবার খেয়ে বেসক্যাম্পের উদ্দেশ্যে ট্রেকিং শুরু করলাম। আজকের পথ অনেকটা কম। মাত্র ৫ কিলোমিটার হাঁটলেই বেসক্যাম্প। আমরা এখন ট্রি লেভেলের উপরে চলে এসেছি। এখান থেকে কোনো গাছপালা নেই।  তিন দিনের ট্রেকিং পথ পারি দিয়ে ১২ হাজার ৩০০ ফুট উচ্চতায় বেসক্যাম্পে পৌঁছে গেলাম ৪ তারিখ। ডুকরানি বামক গ্লেসিয়ারে এনআইএম-এর বেসক্যাম্প। দুপুর পর্যন্ত আবহাওয়া খুবই ভালো ছিলো। কিন্তু বিকেল হতে না হতেই চারপাশ অন্ধকার করে মেঘে ছেয়ে গেলো। শুরু হলো তুষারপাত। প্রাই ছয় ইঞ্চি পুরু হয়ে বরফ জমেছে। এখানেই থাকতে হবে ৮ তারিখ পর্যন্ত। চারপাশে উঁচু পাহাড়। মাঝখানে সমতল মাঠেই বেসক্যাম্প। এখানে স্থায়ী টয়লেট, কিচেন ও একটি ছোট ঘর রয়েছে। এই ঘরেই ক্লাস হয়।



এখানে সন্ধ্যা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুতের ব্যবস্থা আছে। এখানে একটি ভলিবল খেলার মাঠও আছে। এখানেও গ্লেশিয়ারে বেসিকের টেকনিক প্র্যাকটিস এবং উচ্চতর প্রশিক্ষণের নতুন নতুন টেকনিক শেখানো হয়। আর এই উচ্চতর প্রশিক্ষণের মূল হচ্ছে পর্বত অভিযানের দলনেতা তৈরি করানো, রেসকিউ, নেভিগেশন, রোড ওপেনিং, রোপ ফিক্সিং, অভিযান প্ল্যানিং, একক অভিযান ও উচ্চতায় প্রাথমিক চিকিৎসা শেখানো হয়। এখানে একটা বিষয় বলে রাখতে চাই। আমাদের বাংলাদেশে বেশ কিছু নবীন ট্রেকার বা স্ব-ঘোষিত পর্বতারোহী আলপাইনিজম শুরু করেছে। এটা শুনতে ভালো লাগে তবে এটা কতটুকু আলপাইনিজম সেখানে প্রশ্ন থেকেই যায়। একা একা বা সহযোগী ছাড়া ট্রেকিং করলেই কি আলপাইন হয়ে যায়? কখনও হয় না।



একজন আলপাইনিস্টকে পর্বতের সকল ব্যাকরণ জানতে হয়। সহজ কথায় বলতে গেলে ‘সকল পর্বতারোহী আলপাইনিস্ট নয়, সকল আলপাইনিস্টই পর্বতারোহী।’ পর্বতারোহণ হলো সাধনার বিষয়, শেখার বিষয়। তাই নবীনদের না জেনেশুনে হঠাৎ করে আবেগ ও রোমাঞ্চিত হয়ে কিছু করা সত্যিই বোকামি। ফলে অপূরণীয় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। (চলবে)



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২১ নভেম্বর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়