ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

চুনিয়ার পূর্ণিমার রাত অন্তরে পশেছে: ২য় কিস্তি

মাহমুদ নোমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:০৩, ১২ ডিসেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
চুনিয়ার পূর্ণিমার রাত অন্তরে পশেছে: ২য় কিস্তি

মাহমুদ নোমান: সকাল সকাল ভাত রান্না হয়ে যায় এখানকার নারীদের। তারপর চুনিয়ার নারীরা ক্ষেত খামারের দিকে ছোটে। কাঁধের পেছনে ঝুড়ি (থুরা), তাতে ইয়া লাম্বা একটা দা। ক্ষেত খামারের দিকে না ছুটলে লাকরি সংগ্রহে প্রায় প্রতিদিন যেতে দেখেছি পূর্ণিমার মাকে। প্রসঙ্গক্রমে জেনেছি, মায়ের নাম মিথিলা। বাহ্! খুব আধুনিক নাম। বন্ধুর মা মানে আমারও মা। তাই ‘মা’ বলে সম্বোধন করলাম।

ভাত খেয়ে সাড়ে নয়টা বাজতেই দুজন তৈরি হয়ে নিলাম। বনের ভেতরে যাওয়ার জন্য। পূর্ণিমা জানালো চুনিয়ায় একটা পাঠাগার আছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের উদ্যোগে বিশেষত জুয়েল বিন জহিরের একাগ্রতায় চুনিয়ার একটু পূর্বে জয়নাগাছার মোড়ে ‘মৃত্তিকা’ নামে গড়ে উঠেছে। জুয়েল বিন জহির মান্দি অন্তঃপ্রাণ বাঙালি। মান্দি থেকে বিয়েও করেছেন এবং মান্দির ইতিহাস-ঐতিহ্যে নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছেন পরম মমতায়। এমনকি মান্দির যে কোনো আচার অনুষ্ঠানে নিজেকে দিনদিন অগ্রগামী করেই যাচ্ছেন। স্যালুট, এমন মাটির মানুষকে।



মধুপুরের মান্দিদের ঐতিহাসিক নাম হা’বিমা। সবাই এই নামে চেনে। এর অর্থ- মাটির মা। আমরা দুজন যখন হেঁটে যাচ্ছি মৃত্তিকার দিকে গাছ-গাছালি, পাখির কুঞ্জনে আনারস-কলা-পেঁপে বাগানের মধ্য দিয়ে মাটির রাস্তায়, তখন এই শব্দটি আমার বুকে জড়াজড়ি করে লটকে গেছে। সত্যি, এই তো মাটির দুনিয়া। সব বাড়ির সামনে একটা হলেও শূকর কাদামাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। হয়তো এসবের গন্ধ অতিথিদের উৎকট লাগতে পারে। আমরা দুজন যখন টানা ২৫ মিনিট হেঁটেছি, একটা আনারস বাগান থেকে কয়েকটা নারী পূর্ণিমাকে দেখে কি যেন বলে ওঠল। বুঝেছি এতোটুকু, তারা একে অপরের কুশলাদি জিজ্ঞেস করছে। অদ্ভুত ব্যাপার যে, এখানে প্রায় নারী ভোরে মোরগ ডাকার সাথে ওঠে। ঘরের রান্নাবান্না করে ক্ষেত খামারে ছোটে বা লাকরি সংগ্রহ করে। অথচ মুখের হাসি উপচে পড়া কমে না! চুনিয়ার নারীরা কথায় কথায় হাসে। আর পুরুষদের প্রায় দেখেছি দোকানে বসে বসে ঝিমুচ্ছে। মদ গিলে গিলে নিজেদের গিলিয়ে দিচ্ছে। আমরা যখন জয়নাগাছায় পৌঁছলাম, তখন মাথার ওপর কড়া রোদ। পূর্ণিমার ছাতা আছে, কিন্তু আমি হাঁপিয়ে উঠছি। তবুও রোমাঞ্চে এসব কী আর ধারেকাছে ঘেঁষে! জয়নাগাছার মোড়ে একটা দোকান থেকে ঠাণ্ডা পানীয় কিনলাম। হয়তো ফ্রিজ নেই কোনো দোকানে, কিন্তু যেখান থেকে পানীয় কিনলাম, সেই দোকানে ঘরের ফ্রিজ থেকে বরফ এনে প্লাস্টিকে মুড়িয়ে রেখেছে। যাক, বাঁচলাম!

অনেকটা আরাম লাগছে। হাঁটছি পাঠাগারের দিকে। হঠাৎ একটা কলাবাগানে চোখ আটকে গেল। কলা পেকে আছে। হলুদ রং। আমার মন কী আর মানে? দৌড় দিলাম। পূর্ণিমাকে বললাম, কোনো সমস্যা হবে?

না, যাও। সে হাসছে।

আমি দেরি না করে গাছ থেকে কয়েকটা সাগরকলা ছিঁড়ে খেতে খেতে পাঠাগারে ঢুকলাম। টিনের তৈরি পাঠাগারটি এই এলাকার আলো। পাঠাগারে ঢুকে যখন চারদিকের জানালা খুলে দিলো পূর্ণিমা, তখন তার সৌন্দর্য আমাকে বিমোহিত করল। ভেতরে হারমোনিয়ামও দেখলাম। টেনে নিয়ে সা রে গা মা চলল কিছুক্ষণ। দেয়ালে মান্দি বীরদের ছবি সম্পর্কে পূর্ণিমার কাছে বিবিধ জানলাম। প্রায় আধ ঘণ্টা অবস্থান করে যখন বেরিয়ে এলাম, ততক্ষণে ১২টা পেরিয়ে গেছে। ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম- পাঠাগারটির আরো যত্ন প্রয়োজন। আরো অনেক মহৎ মানুষের সুনজরে আসা উচিত।



আসার পথে জয়নাগাছার ঐ দোকান থেকে কেনা একটা বড় ঠাণ্ডাপানীয় আনারস বাগানের মহিলাদের দিলাম। যাওয়ার সময় তাদের খাটুনি দেখে বড় মায়া লেগেছে। তাছাড়া এরা নাকি পূর্ণিমার আত্মীয়। তারা বাগান থেকে পাকা আনারস কেটে দিলেন। সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রসে হাত ভিজিয়ে খেয়ে নিলাম। আহারে! কী স্বর্গীয় শান্তি... খেতে খেতে সেলফি, বাগানের ভেতর দৌড়ে গিয়ে শিয়ালের মতো আনারসের ঝোঁপে বসে ছবির পোজ দিচ্ছি। পূর্ণিমার ফটোগ্রাফিতে বেশ প্রাণবন্ত এই আমি। ঘরে ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে গেছে। তেমন কিছু আর খাওয়া হলো না। বিকেল পেরুলেই রাতের খাবার। মানে সন্ধ্যায় রাতের খাবার খেয়ে ঘুমাতে যেতে হলো। ঘুম তো আর আসে না। চুনিয়ায় এসে রাত না জাগলে আপনি হতভাগা।

পরের দিন সকালে পূর্ণিমা নিয়ে গেল আচ্ছু জনিকের কাছে। যার বয়স ১১৪ পেরিয়ে গেছে অনেক আগে। চোখে দেখতে পান না তেমন, কানেও একটু কম শোনেন। কাছে গিয়ে জোরে জোরে কথা বলতে হয়। 'আচিক' ভাষার সাথে সাথে বাংলা ভাষাতে বেশ পারদর্শী। এমনকি বাংলাদেশের অতীত ও বর্তমান রাজনীতি তার নখদর্পণে। আধুনিকায়নে বা নিজেদের জীবনধারনের সহজায়নে চুনিয়ার প্রায় লোক ধর্মান্তরিত খ্রিস্টান হয়ে গেলেও আচ্ছু জনিক এখনো মননে, বোধে আর আচারে সাংসারেক। সাংসারেক মান্দিদের আদি ধর্মের নাম। আচ্ছু জনিকের আসল নাম জনিক নকরেক। তার সঙ্গে সাংসারেকের বিভিন্ন দেব-দেবী ব্রারারা ও দুংগা এমনকি আধ্যাত্মিক বিষয়াদি সম্পর্কে খুব অর্থবহ কথাবার্তা হয়েছে আমার। বেশ প্রাণোচ্ছ্বল কথা হলো। চুনিয়ার সম্পর্কে বিশদ আলোচনাও হয়েছে। ভারতের ত্রিপুরায় যখন চাষবাষ আর হচ্ছে না জনিক নকরেক ২০-২৫ জনের একটা দলসহ রেলে করে এই চুনিয়ায় আসেন। জনিক নকরেকের সাথে ছিলেন চুনিয়ার আগের সংমি নকমা (গ্রামের প্রধান বা রাজা) নরেন্দ্র নকরেকও। তখন জনিক নকরেক (আচ্ছু জনিক) সবেমাত্র কিশোর। চুনিয়া নামকরণ সম্পর্কে জানতে চেয়ে জানলাম- চুনিয়ায় প্রথম এসেছে জমিদার রাইচাঁন আর তার স্ত্রী ডেঙ্গা। তিনি ময়মনসিংহের ঐদিক থেকে এসেই জেনেছে এই এলাকার নাম চুনিয়া। একথা তাকে বলেছে পীরগাছার বলিরাম। কথাপ্রসঙ্গে বলেন চুনিয়াটা একটা পুকুরের নাম ছিল। আমার পাল্টাপাল্টি প্রশ্ন ছিল পুকুরের নাম চুনিয়া কীভাবে হলো? এ সম্পর্কে তিনি বলতে পারেন নি। তাই আমি ব্যাখ্যা দিলাম- আচ্ছু, আপনারা আচিক ভাষায় মদকে চু বলেন আর নিয়া মানে নিয়ে আসা বা বহন করা। তাহলে এই নামকরণে একজন বাঙালির সম্পৃক্ততা সহজেই অনুমেয়। মানে 'চু' (মদ) 'নিয়া' কেউ এসেছিল এখানে বা পুকুরপাড়ে কেউ চু গুঁজে রেখেছিল। এরপরে কোনো ঘটনাক্রমে এটার নাম চুনিয়া। আমার ব্যাখ্যা শুনে তিনি হো হো করে হেসে উঠলেন। পূর্ণিমাও হাসল।



আচ্ছু জনিকের কাছেই জানলাম চুনিয়া বাংলোতে বাংলাদেশের সংবিধান নিয়ে প্রথম বৈঠকের কথা। সেই বৈঠকে নাকি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও উপস্থিত ছিলেন। তাই বিকেলের দিকে চুনিয়া বাংলো ঘুরে এলাম। বন থেকে ছুটে এলো বানরের দল। দুজনের কদমের আগে আগে ঢুকে যাচ্ছে বনে, পাশের ধানখেতে। শালবনের বাকল শুঁকে শুঁকে পিছনে আসছে পূর্ণিমা। ওর বাকল শুঁকে দেখার পবিত্র দৃশ্য আমার মনে পশে গেল। এই চুনিয়ার বাংলোয় সালমান শাহ, শাবনূর অভিনীত ‘আনন্দ অশ্রু’ সিনেমার শুটিং হয়েছিল এসব কথা ভাবতে ভাবতে অটোতে চড়ে বাড়ির পথ ধরলাম।





রাইজিংবিডি/ঢাকা/১২ ডিসেম্বর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়