ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ত্রিপুরায় এক টুকরো বাংলাদেশ

ইকরামুল হাসান শাকিল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৫৪, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ত্রিপুরায় এক টুকরো বাংলাদেশ

ইকরামুল হাসান শাকিল: ত্রিপুরা নাট্য উৎসবে যোগ দিতে পদাতিক নাট্য সংসদ দলের সঙ্গে গিয়েছি। আগরতলার টাউন হলে দল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্প অবলম্বনে ‘সে’ মঞ্চস্থ করবে। রাতে নাটক করব। দিনে ঘুরে দেখব ত্রিপুরা। আগরতলার যে সংগঠন আমাদের নিয়ে গেছে তারাই ট্যুরিস্ট বাসের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। বাসের ভিতরে হইহুল্লোর করতে করতে পাহাড়ি পথে সবুজের ভিতর দিয়ে যাচ্ছি।

ভ্রমণ নিয়ে লিখতে বসে মনে হলো, ত্রিপুরা মিশে আছে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থান নিয়ে গড়ে উঠেছে অসংখ্য পর্যটন এলাকা। শুধু বাংলাদেশেই নয়, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও রয়েছে তেমনি বেশ কিছু স্থান।  বিজয়ের মাস এই ডিসেম্বরে তেমনি প্রতিবেশী দেশ ভারতের এক পর্যটন এলাকার কথা আপনাদের জানাচ্ছি। ত্রিপুরাকে উত্তর-পূর্ব ভারতের সবচেয়ে দূরর্বতী স্থান হিসেবে গন্য করা হয়। ভারতের দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম রাজ্য হলো ত্রিপুরা। ছোট হলেও এটি সুন্দর একটি রাজ্য। শান্ত, সরল ও মনোরম পরিবেশ। এই রাজ্যের ইতিহাস মহাভারতের সময় কাল থেকে সূচনা হয়েছে। ধারণা করা হয়ে থাকে, ভূমি অধিষ্ঠাত্রী দেবী ‘ত্রিপুরা সুন্দরী’র নামানুসারে এই নামটি নামাঙ্কিত করা হয়েছিল। ত্রিপুরা পূর্বে মাণিক্য রাজবংশের মহারাজাদের দ্বারা শাসিত ছিল। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পর এই রাজ্যটি ভারতের সঙ্গে মিলিত হয় এবং ১৯৭২ সালে ত্রিপুরা রাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করে।
 


রাজ্যটি পূর্বে মিজোরাম, উত্তর-পূর্ব দিকে আসাম এবং উত্তর-দক্ষিণ এবং পশ্চিম দিকে বাংলাদেশ দ্বারা পরিবেষ্টিত। আর এই ত্রিপুরার বিলোনিয়া মহকুমার ‘চোত্তাখোলা’ নামক গ্রাম ছিল মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম ইতিহাস সমৃদ্ধ একটি ঐতিহাসিক স্থান। এখানে রয়েছে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী উদ্যান। রয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত অনেক ঘটনা। এখানেই মুক্তিযুদ্ধের সময় ২ নাম্বার সেক্টরের ট্রেনিং ক্যাম্প করা হয়েছিলো। স্বাধীনতা যুদ্ধের কে ফোর্স-এর অধিনায়ক খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বাধীন বাহিনী প্রশিক্ষণ নিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। একাত্তরে তৎকালীন ফেনীর খাজা আহম্মেদ চোত্তাখোলায় এই ঘাটি গড়ে তুলেছিলেন। চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে আগত শরণার্থীরা আশ্রয় নিতেন এই ঘাটিতে। এটিই ছিল মুক্তিবাহিনীর প্রথম রিক্রুট সেন্টার। এখান থেকে মুক্তিযোদ্ধারা প্রশিক্ষণ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন যুদ্ধে।

২০০৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্মৃতি রক্ষা পার্কটির ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয়। বাংলাদেশের সে সময়কার পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা থেকে ১৩০ কিলোমিটার দক্ষিণে বিলোনিয়ার চোত্তাখোলায় মুক্তিযুদ্ধ স্মরণে স্মারক উদ্যানের উদ্বোধন করেছিলেন। এই পার্কটি মোটেও ছোট একটি জায়গা না। প্রায় ২০ হেক্টর জায়গা নিয়ে তৈরি। জায়গার পুরোটাই ঘন বন আর পাহাড়ি এলাকা। বনের মাঝে আছে ৭টি টিলা আর একটি প্রাকৃতিক লেক। আমরা সবাই স্মারক উদ্যানের গল্প শুনে অবিভূত হলাম। সবচেয়ে উঁচু টিলার ওপর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের আদলে বঙ্গবন্ধুর ৩২ ফুট দীর্ঘ একটি ভাস্কর্য। সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধের আদলে স্তম্ভ তৈরি করা হয়েছে। ভাস্কর্যের পেছনে টেরাকোটায় চিত্রিত আছে সাতচল্লিশ থেকে একাত্তর পর্যন্ত বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের নানা বাঁক। রাজ্য সরকারের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, টিলা যেখানে জলাশয়ে মিশেছে, সেখানে দুই-তিনজন মুক্তিযোদ্ধার কবরের খোঁজ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া সবচেয়ে উঁচু টিলাসহ কয়েকটি টিলায় খোঁজ মিলেছে চারটি বাংকারের।
 


বিলোনিয়ার সেই ঐতিহাসিক সময়ের স্মৃতি ধরে রাখতে সচেষ্ট হয়েছিলেন বিলোনিয়ার এমএলএ বাবু সুধন দাস এবং ত্রিপুরা রাজ্য সরকার। যার ফলস্বরূপ গড়ে ওঠে ভারত-বাংলা মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী পার্ক। দেশের বাইরে দেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে তৈরী এই বৃহৎ স্মারকস্থান।  বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য। মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাঞ্চল ঘাটি হিসেবে এই ত্রিপুরার ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি।  অপূর্ব সুন্দর পাহাড়ে ঘেরা এই অঞ্চলটি মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়স্থল। এখানে প্রশিক্ষণ তো হতোই, তার পাশাপাশি যুদ্ধে ক্লান্ত যোদ্ধারা এখানে বিশ্রাম নিতেন। আবার এখান থেকেই ঢুকে পরতেন দেশের অভ্যন্তরে রণাঙ্গণে। মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে প্রতিটি বিষয়কে আমাদের রক্তক্ষয়ী ইতিহাস হিসেবে সংরক্ষণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর সেই কাজেই সহায়তা করেছে ত্রিপুরা সরকার। এখানে গড়ে তুলেছেন মুক্তিযুদ্ধকে প্রতিফলিত করে এমন সব ভাস্কর্য। তৈরি করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। এছাড়া আছে ১৯৭১ গণহত্যা জাদুঘর মঞ্চ। এখানকার স্থপত্যগুলো ঠিক সেই সময়ের প্রতিচ্ছবি বহন করছে। কোনো ভাস্কর্যে দেখা যাচ্ছে যুদ্ধরত সৈনিককে। আবার কোনো ভাস্কর্যে যুদ্ধাহত সৈনিককে কাঁধে নিয়ে যাচ্ছে চিকিৎসার জন্য সহযোদ্ধারা। যুদ্ধের সময়ে তৈরি বাংকারগুলোকেও তেমনি রাখা হয়েছে এখনো। এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধিও দেখতে পাবেন।
 


ঘুরে আসতে পারেন সেই মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম ইতিহাস সমৃদ্ধ ঐতিহাসিক স্থানটি। ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা হয়ে যেতে পারেন বিলোনিয়া। সেজন্য আপনাকে আখাউড়া সীমান্তের পোর্টটি বেছে নিতে হবে ভিসা করার সময়। সাধারণ ভিসার মতোই ভিসা নেবেন এবং আখাউড়া পোর্ট নির্বাচন করবেন। আপনার যদি ভিসা আগেই থেকে থাকে এবং ভিন্ন পোর্ট নির্বাচিত করা থাকে তাহলে পোর্ট পরিবর্তন করে নিতে হবে ভিসা অ্যাপ্লিকেশন সেন্টার থেকে নির্ধারিত ফি জমা দিয়ে।

আখাউড়া স্থল বন্দরে নিকটেই আগরতলা শহর। আগরতলা থেকেই চলে যেতে পারবেন বিলোনিয়। এখানে যাওয়ার পথটিও খুবই  সুন্দর। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা উঁচুনিচু পথ আপনার ভ্রমণ ক্লান্তি একদমই বুঝতে দিবে না। ত্রিপুরা একটি শুদ্ধ আবহাওয়ার রাজ্য হিসেবেই পরিচিত। এখানে প্রকৃতি এতই নির্মল যে বাতাসে কোনো দূষণ নেই। নেই কোথাও কোনো কৃত্তিমতার ছাপ।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ ডিসেম্বর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়