ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

মুক্তিযোদ্ধার পথ ধরে

গাজী মুনছুর আজিজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:১৪, ৪ এপ্রিল ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মুক্তিযোদ্ধার পথ ধরে

গাজী মুনছুর আজিজ : সূর্য কেবল উঁকি দিয়েছে অকাশে। ঠিক তখন আমরা হাঁটা শুরু করি শহিদ মিনার থেকে। উদ্দেশ্য জাতীয় স্মৃতিসৌধ। হাঁটার এ দলে আছি তরুণ-যুবা, শিশু-বৃদ্ধা মিলে প্রায় দেড়শ নারী-পুরুষ। মূলত একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধাদের পথ ধরে হাঁটার এ অভিযান।

একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধারা কিংবা স্বাধীনতাকামী মানুষ কষ্ট করে হেঁটে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গিয়েছেন; সেই কষ্টের অনুভূতি পেতেই এ অভিযান। সেইসঙ্গে এ অভিযানে পাঁচশ টাকার অনুদান দিয়ে যারা নিবন্ধন করেছি, সেই অর্থ যোগ হবে আগারগাঁওয়ের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের নির্মাণ তহবিলে। অভিযানের আয়োজক অভিযাত্রী। ‘শোক থেকে শক্তি’ স্লোগান নিয়ে ২৬ মার্চ এই অভিযানে নামি আমরা। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক, মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, পাখিবিদ ইনাম আল হক, এভারেস্টজয়ী প্রথম বাংলাদেশী নারী নিশাত মজুমদারসহ আরও অনেক পরিচিত বিশিষ্টজন অভিযানের সঙ্গী হয়েছেন।

শহিদ মিনার থেকে হেঁটে প্রথমে আসি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের সামনে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক বর্ণনা করেন, এই জগন্নাথ হলের আবাসিক শিক্ষক ছিলেন ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা। এ হলেই একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে তাকে পাকিস্তানি সৈন্যরা অত্যাচার ও গুলি করে। আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাধীন থাকার পর ৩০ মার্চ তিনি শহিদ হন। বর্ণনা দিতে গিয়ে মফিদুল হকের চোখ ভিজে ওঠে। সেইসঙ্গে ভিজে ওঠে আমাদের চোখও।



জগন্নাথ হল থেকে আসি মধুর কেন্টিনের সামনে। এখানেও বর্ণনা করা হয় একাত্তরের গণহত্যার। তারপর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের শিখা চিরন্তন প্রাঙ্গণ। এই স্থানে বঙ্গবন্ধু একাত্তরের ৭ মার্চ ভাষণ দেন। এই স্থানে ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করে। সেজন্য স্থানটি স্মরণীয় করতে ১৯৯৬ সালে শিখা চিরন্তন স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়। এ উপলক্ষে ১৯৯৭ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিখা চিরন্তন প্রজ্বলন ও দেশব্যাপী শোভাযাত্রার উদ্বোধন করেন। ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মস্থান গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া ছুঁয়ে ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পৌঁছায় শিখা চিরন্তন। এ দিনই এটি স্থাপন করেন শান্তিতে নোবেলজয়ী দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপতি নেলসন ম্যান্ডেলা, ফিলিস্তিনের ইয়াসির আরাফাত, তুরস্কের সুলেমান ডেমিরেল ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়া জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ।

শিখা চিরন্তনের সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কথা শোনান অভিযানে অংশ নেয়া মুক্তিযোদ্ধারা। তারপর আবার হাঁটা শুরু। শাহবাগ, নিউ এলিফ্যান্ট রোড ধরে ঢাকা সিটি কলেজের সামনে আসলে অভিযানে সংহতি জানিয়ে আমাদের সঙ্গে হাঁটেন সিটি কলেজসহ বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, শিক্ষকসহ নানা শ্রেণিপেশার মানুষ। হাঁটতে হাঁটতে অভিযাত্রীদের কেউ কেউ গান ধরেন। আবার সেই গানের সঙ্গে সুর মেলান অন্য অভিযাত্রীরাও। ধানমন্ডির সাতমসজিদ রোড ধরে অভিযান এসে থামে মোহাম্মদপুর শারীরিক শিক্ষা কলেজে। মফিদুল হক জানান, এ কলেজেই ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে পাকিস্তানি সৈন্যরা বুদ্ধিজীবীদের ধরে এনে বন্দী করে অত্যাচার চালায় এবং এখান থেকেই ১৪ ডিসেম্বর অনেক বুদ্ধিজীবীকে নিয়ে যাওয়া হয় রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে। এখানে আমাদের গান শোনান ছায়ানটের সেসময়ের সাধারণ সম্পাদক লাইসা আহমদ লিসাসহ ছায়ানটের কয়েকজন শিল্পী।

পরবর্তি সময়ে বিরতি দিই রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে। এই বধ্যভূমিতেই একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর হত্যা করা হয় আমাদের অসংখ্য বুদ্ধিজীবীকে। এখানে বুদ্ধিজীবী হত্যার বর্ণনা দেন মুক্তিযুদ্ধের ৮নং সেক্টরের কমান্ডার আবু ওসমান চৌধুরী, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক ও শহিদ বুদ্ধিজীবী সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের ছেলে তৌহিদ রেজা নূর। বর্ণনা শুনে রায়ের বাজার শহিদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের ভেতর দিয়ে আবার হাঁটা শুরু করি। থামি মোহাম্মদপুরের বসিলা সেতু ঘাটে এসে। তারপর এ ঘাট থেকে উঠি ইঞ্জিনের নৌকায়। উদ্দেশ্য সাভারের বিরুলিয়ার সাদুল্লাপুর ঘাট। পাঁচটি ইঞ্জিনের নৌকা, একটি নৌ পুলিশের বোট ও একটি ফায়ার সার্ভিসের বোটসহ আমাদের নৌ-যাত্রা শুরু হয়। প্রায় দুই ঘণ্টা শেষ করি তুরাগ নদে যাত্রা। নৌকা থেকে নেমে ক্ষাণিক বিরতি দিই বেগুনবাড়ী স্কুল মাঠে। এখানকার স্কুলের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরাও আমাদের অভিযানে সংহতি জানান।



সাদুল্লাপুর এলাকাটি গোলাপ চাষের জন্য এরই মধ্যে ব্যাপক পরিচিত। পথের দুপাশে অসংখ্য গোলাপবাগান। সব বাগানেই ফুটে আছে লাল টকটকে গোলাপ। দেখতে দারুণ! এ গোলাপবাগান দেখতে দেখতে গ্রামের আঁকাবাঁকা মেঠোপথ ধরে এগিয়ে চলি। ততক্ষণে দুপুর হয়ে গেছে। আমরা পৌঁছে যাই, আরকান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে। এখানকার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরাও আমাদের অভিযানে সংহতি জানাতে এসেছেন। দুপুরের খাবার আমরা এখানেই খেয়ে নেই। খাবার শেষে আবার যাত্রা। বউ বাজারের পথ ধরে সামনে আগাই। পথের দুই পাশে দেখি নানা প্রজাতির বিদেশি ফুলের বাগান। এসব ফুল বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে এখানে। দেখে ভালো লাগলো।

জিনজিরা, কলমা, অরুণাপল্লী হয়ে এগিয়ে যেতে থাকি। ডেইরি ফার্মের ভেতর দিয়ে আসি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানে কিছু সময় বিরতি দিয়ে আবার পথ ধরি। পুরো যাত্রায় প্রায় সাড়ে ১৮ মাইল হাঁটার পর আমরা ১৫২ অভিযাত্রী পৌঁছি যাই জাতীয় সৃতিসৌধে। ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমেছে। সৃতিসৌধকে সামনে রেখে অভিযাত্রীদের শপথবাক্য পাঠ করান অভিযাত্রী সংগঠনের সংগঠক ও এভারেস্টজয়ী প্রথম বাংলাদেশী নারী নিশাত মজুমদার।

ছবি : লেখক



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৪ এপ্রিল ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়