ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

বরফের হ্রদ টসমগো

গাজী মুনছুর আজিজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৫৯, ২ মে ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বরফের হ্রদ টসমগো

গাজী মুনছুর আজিজ: টসমগো হ্রদ সিকিমের রাজধানী গ্যাংটক থেকে প্রায় ৩৮ কিলোমিটার দূরে। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে এই হ্রদের উচ্চতা ১২ হাজার ৭০০ ফুট। ‘চাঙ্গু’ নামে এর পরিচিতি বেশি। সিকিমের টসমগো হ্রদের পাড়ে দাঁড়িয়ে কেবলই মনে হচ্ছে স্বপ্নের ভেতর আছি। কারণ এর আগে কখনও বরফ জমা লেক বা হ্রদ দেখিনি। অদ্ভুত এক অনুভূতি! প্রচণ্ড ঠান্ডা। এ কারণেই হ্রদের পানি জমে বরফ হয়ে আছে। আর এর মধ্যেই অসংখ্য পর্যটকের ভিড়।

হ্রদের প্রবেশ মুখে ছোট্ট একটি সেতু। সেতু পার হয়ে হ্রদের পাড় ধরে হেঁটে আসি ভেতরে। আমাদের সবার গায়ে পর্যাপ্ত কাপড় জড়ানো। পায়ে গামবুট। বুট ভাড়া নিয়েছি লেকের পাড়ের দোকান থেকে। ১০০ রুপি প্রতি জোড়া। কারণ বরফের ভেতর হাঁটতে হলে এই বুটের বিকল্প নাই। অনেকটা গোল আকৃতির এই হ্রদের চারপাশে পাহাড়। পাহাড় থেকে গলিত বরফের পানি বা তুষারপাতের পানিই এই হ্রদের উৎস। আশপাশে যেসব পাহাড় আছে, তার অধিকাংশই তুষারপাতে বরফে ঢাকা। যেনো বরফেরই পাহাড়।

পর্যটকরা সবাই হ্রদের পাড়ে হাঁটাহাঁটি করছেন। মাঝখানটায় কাউকে যেতে দেখছি না। তাই আমরাও যাইনি। হ্রদের পাড়েই আছি। সাদা তুলোর মতো এই বরফের রাজ্যে কোথাও কোথাও পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে ডেবে যাচ্ছে। আবার কোথাও শক্ত। আমাদের সবাই মহা খুশি এমন একটি জায়গায় আসতে পেরে। খুশির চোটে প্রচণ্ড ঠান্ডা সত্ত্বেও দলের এক সদস্য খালি গায়ে ছবি তুলতে শুরু করল। অন্যদিকে জাকির, মামুন, রাসেল, অর্নি, মিষ্টি ও তিথি যে যার মতো দুষ্টুমি করছে। কেউ কেউ বরফে গড়াগড়ি খাচ্ছে মহা আনন্দে। কেউ কেউ বরফ দিয়ে বল বানিয়ে একজন আরেকজনের দিকে ছুড়ে মারছে। আবার কেউ সাদা বরফের গায়ে নিজের নামের প্রথম অক্ষর লিখে প্লাস দিয়ে লিখছে প্রিয়জনের নামের প্রথম অক্ষর। ধারণা করি- ছেলেবেলায় স্কুলের দেয়ালে এমন লিখন অনেকেই লিখেছেন। হয়তো সেই স্মৃতিই তারা আরেকবার রোমান্থন করলো বরফের এই হ্রদে।

 



হ্রদের পাড়ে অনেক ইয়াক আছে। দেখতে আমাদের গরু-মহিষের মতো। তবে সে তুলনায় এদের পা একটু খাটো। অনেকেই ইয়াকের পিঠে চড়ে হ্রদের পাড়ে ঘুরছেন। কিছুক্ষণের জন্য ইয়াকের পিঠে চড়তে গুনতে হচ্ছে ১০০ রুপি। অধিকাংশ ইয়াকের গায়ের রঙ কালো। কিছু ইয়াকের মথার অংশটুকু কালচে-সাদা। তবে প্রায় সব ইয়াকের শিং দুটো লাল উলের ঝালর দিয়ে মোড়ানো। হ্রদের পাড়ে একটি বৈঠকখানা আছে। হাঁটাহাঁটি করে যাদের ক্লান্তি লাগছে তারা বসে বিশ্রাম নিচ্ছেন। এছাড়া হ্রদের প্রবেশ মুখেই আছে রোপওয়ে। উচ্চতা ১৪ হাজার ৫০০ ফুট। এটি এশিয়ার সবচেয়ে উঁচুতে অবস্থিত রোপওয়ে বলে দাবি করা হয়। রোপওয়েতে চড়ে পাখির চোখে দেখা মেলে কাঞ্চনজঙ্ঘা, ভারত-চীন সীমান্ত, ভুটান, দার্জিলিং ও টসমগো হ্রদ। হ্রদের পাড়ে বা হ্রদসংলগ্ন পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে ছোট ছোট কিছু গাছ আছে। গাছের পাতাগুলো প্রায় নিষ্প্রাণ। তবে বসন্তে এসব গাছ আবার সতেজ হয়ে ওঠে।

বেশ কিছুক্ষণ থাকার পর হ্রদ থেকে বের হই। হ্রদের অধিকাংশ পাহাড়ের সঙ্গে মিশেল হলেও একপাশ দিয়ে পথ আছে। অবশ্য এ পথের পরেই পাহাড়। পথে দাঁড়িয়ে অনেকে উপভোগ করছেন হ্রদের সৌন্দর্য। হ্রদের প্রবেশ এলাকায় অনেকগুলো চা-কফির স্টল, রেস্টুরেন্ট, গিফট শপ ও গরম কাপড়ের দোকান আছে। এসব দোকানের ছাদও তুষারপাতের বরফে ঢাকা। দোকানের আশপাশেও আছে বরফের স্তুপ। দোকানগুলোতে আছে গামবুট, জ্যাকেট, হ্যান্ডগ্লাভস, মোজাসহ বিভিন্ন গরম কাপড়। বিক্রির পাশাপাশি এসব গামবুট বা গরম কাপড় ভাড়া দেয়া হয় দর্শনার্থীদের কাছে। যেমন আমরা গামবুট ভাড়া নিয়েছি।

 



আমরা যখন হ্রদের এলাকায় আসি তখন পর্যটকের অসংখ্য গাড়ি দেখেছিলাম। এখন অনেক কম। অর্থাৎ হ্রদ দেখে এরই মধ্যে সবাই এলাকা ছেড়েছেন। তাই আমরাও গাড়িতে উঠি সিকিমের রাজধানী গ্যাংটকের উদ্দেশে।

গ্যাংটক থেকে এই হ্রদের দূরত্ব প্রায় ৩৮ কিলোমিটার। হ্রদ থেকে নামার পথের দুই পাশেও আছে বরফের স্তূপ। এই পথ পুরোটাই আঁকাবাঁকা। সাদা বরফ রাজ্যে পাহাড় ঘেঁষা পিচের আঁকাবাঁকা পথে চলছি। বলা চলে দারুণ অনুভূতি। বেশ কিছুক্ষণ চলার পর অতিক্রম করি পুলিশ চেকপোস্ট। যাওয়ার সময় এ চেকপোস্ট থেকে এক কপি ছবিসহ পাসপোর্ট ও ভিসার ফটোকপি দিয়ে অনুমতি নিতে হয়েছে। ফেরার পথেও তা দেখাতে হলো, যাতে যারা গিয়েছি, তারা আবার ফেরত আসলাম কিনা সেটা বুঝতে। অবশ্য অনুমতি ও কাগজপত্রের বিষয়গুলো চালকই দেখভাল করছেন। কারণ সিকিমের যেকোনো স্থান ঘুরতে হলে এখানকার সরকারের অনুমদিত ট্যুরিস্ট এজেন্টের মাধ্যমে অনুমতি নিতে হয়। আর চালক বা গাড়ির এজেন্টেরা এর অন্তর্ভূক্ত। আমাদের সঙ্গে একজন গাইডও আছেন। এই গাইডও এজেন্টের।

 



চেকপোস্ট পেরিয়ে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে বিরতি দিই একটি রেস্টুরেন্টের সামনে। যাওয়ার সময়ও এখানে বিরতি দিয়েছিলাম। তখনও এখানে চা-কফি পান করেছিলাম। এবারও তাই। চালক দুপুরের খাবার খেলেন। আর আমাদের তরুণী গাইড যাওয়ার সময় এখান থেকে গামবুট নিয়েছিলেন, সেটা এখন ফেরত দিলেন। চা-কফি শেষে আবার গাড়িতে উঠি। পাহাড়ের কোলঘেঁষে আঁকাবাঁকা পথে গাড়ি চলছে গ্যাংটকের দিকে। আর ঘড়ির কাটা বিকেল ছুঁইছুঁই।

ছবি : লেখক



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২ মে ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়