বাংলা ভাষা রক্ষায় প্রয়োজন প্রমিত বানান
কমল কর্মকার || রাইজিংবিডি.কম
কমল কর্মকার
কমল কর্মকার
তখনো বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়নি। ১৯৭০ সালের ১৭ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ প্রাদেশিক ও জাতীয় উভয় পরিষদে নিরঙ্কুশ জয়লাভ করল।
পরের বছর ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির একুশের অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী ভাষণে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আমি ঘোষণা করছি, আমাদের হাতে যেদিন ক্ষমতা আসবে সেদিন থেকেই দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হবে। বাংলা ভাষার পণ্ডিতরা পরিভাষা তৈরি করবেন তার পরে বাংলা ভাষা চালু হবে, সে হবে না। পরিভাষাবিদেরা যত খুশি গবেষণা করুন, আমরা ক্ষমতা হাতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষা চালু করে দেব, সে বাংলা যদি ভুল হয়, তবে ভুলই চালু হবে, পরে তা সংশোধন করা হবে।’
বাংলা ভাষার প্রতি এমন অনুরাগ তখন শুধু বঙ্গবন্ধুরই ছিল না, আপামর বাঙালিরই ছিল বাংলা ভাষার প্রতি গভীর ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা। আর সেই বাংলা ভাষাকে ভালোবেসে বুকের তাজা রক্ত রাজপথে ঢেলে দিয়েই শেষ পর্যন্ত বাঙালি একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে জন্ম লাভ করেছে।
বঙ্গবন্ধুর উল্লিখিত বক্তব্যের পর আজ কত যুগ পার হয়ে গেল। স্বাধীন দেশে বাংলা ভাষা ও বানানরীতি ঠিক করল বাংলা একাডেমি। পরিভাষাবিদেরা তৈরি করেছেন পরিভাষা। তাও তো কত কাল কেটে গেল। তবুও কি আমাদের ভাষা-বানান নির্ভুল হয়েছে? আজ ভাবার সময় এসেছে, স্বাধীনতার ৪২ বছর পর আমাদের প্রাণের বাংলা আজ কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে।
চলুন এক চক্কর ঘুরে আসি। আমাদের বাংলা বানানের হালহকিকত দেখে আসি।
রাজধানীর সাইনবোর্ডগুলোর দিকে তাকালেই বাংলা ভাষার করুণ অবস্থা সহজে বোঝা যায়। অসংখ্য ভুল বানানের ছড়াছড়ি সাইনবোর্ডগুলোয়। ‘রেস্তোরাঁ’ শব্দটি প্রায়ই দেখতে পাওয়া যায় ‘রেঁস্তোরা’ বা ‘রেস্তোরা’ বানানে। ‘বেগম রোকেয়া সরণি’কে ভুল বানানে লেখা হচ্ছে ‘বেগম রোকেয়া স্মরণী’ বা ‘বেগম রোকেয়া স্বরণী’। সরণি মানে পথ বা রাস্তা। অর্থাৎ রোকেয়ার নামের পথটি হচ্ছে রোকেয়া সরণি। ‘গোল চত্বর’কে ভুল বানানে লেখা হচ্ছে ‘গোল চক্কর’। এতে ‘চত্বর’ আর ‘সরণি’র অর্থই পাল্টে গেল। সাইনবোর্ডের অসংখ্য ভুল বানানের মধ্যে আছে ‘গর্ভণর’, ‘মর্ডাণ’, ‘রেঁনেসা’, ‘রেজিষ্ট্রি’ ‘পঁচা সাবান’ (শুদ্ধ বানানগুলো হচ্ছে : গভর্নর, মডার্ন, রেনেসাঁ, রেজিস্ট্রি, পচা সাবান)।
শুধু সাইনবোর্ডের ভুলই নয়, রাজনীতিকদের বানানের ওপর ‘অগাধ জ্ঞান’ দেখে তো রীতিমতো ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। দেয়ালে চোখ পড়লে প্রায়ই দেখবেন ‘জাতীর পিতা’ বানান। শুদ্ধ বানানটি হচ্ছে ‘জাতির পিতা’।
সেদিন চোখে পড়ল একটি ছাত্রসংগঠনের অদ্ভুত ব্যানার। কী ভয়াবহ বানান! লিখেছে ‘দূরশ্বাষনের’, ‘বিরোদ্ধে’, ‘কন্ঠ সুর’, ‘স্বইরাচারী’, ‘বিক্ষুভ’ ইত্যাদি ভুল বানান। একটি ব্যানারে কয়টি ভুল হতে পারে! মনে হচ্ছিল ধরণী দ্বিধা হও। এই যদি হয় আমাদের ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীদের বানানজ্ঞান! তারাই তো একদিন ক্ষমতায় যাবে। দেশ চালাবে। তখন আমাদের বাংলা ভাষার হবেটা কী? আর তাদের দোষ দিয়েই কী লাভ? তাদের শিক্ষকদের মানটাও তো দেখতে হবে।
কলেজপড়ুয়া এই ছাত্রদের বানানের যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে কম শিক্ষিতদের তো দোষ দিয়ে লাভ নেই। কিন্তু হয়েছে উল্টোটাও। ওরা বরং কম জানার কারণেই অনেক সময় শুদ্ধ বানান লেখে। তালতলায় শ্রমজীবীদের একটি রেস্তোরাঁর নাম দেখলাম ‘শাহ পরান হোটেল’। খুব ভালো লাগল। বেচারারা অল্প লেখাপড়া করেও কী সুন্দর শুদ্ধ বানান লিখেছে। ভদ্রলোকরা হলে তো লিখতেন ‘শাহ পরাণ হোটেল’। এর কারণ, পরিপূর্ণ ণত্ববিধান না-জানা। আসলে, ‘প্রাণ’, ‘বর্ণ’, ‘বর্ষণ’- এই শব্দগুলোর কোমল রূপ হচ্ছে যথাক্রমে ‘পরান’, ‘বরন’, ‘বরিষন’। তাই ‘শাহ পরান’ বানানটাই সঠিক।
বলছিলাম শিক্ষকদের বানান-জ্ঞানের কথা। ভুল বানানের জন্য শিক্ষকরাও কম দায়ী নন। একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করতে হয়। আমি তখন প্রথম আলোয় সম্পাদনা সহকারী বিভাগে কাজ করি। উপপ্রধান হিসেবে। প্রথম আলোয় এক মহিলা পাঠক ফোন করেছেন। তিনি কোনো এক বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক। ফোনে তিনি কৈফিয়ত নিচ্ছেন ‘ধস’ বানান কেন ‘ধ্বস’ করিনি। তিনি নিশ্চিত, বানানটা হবে ‘ধ্বস’। আমরা যতই বোঝাচ্ছি তাকে যে ‘ধস’ বানানটাই সঠিক, তিনি ততই খেপে উঠছেন। অভিধান দেখতে বললাম তাকে। তিনি নাছোড়। কী মুশকিল, শেষ পর্যন্ত আমাদের বিভাগকে অশিক্ষিত বলতেও ছাড়লেন না তিনি। অথচ ‘ধস’ বানানটা সঠিক। একজন সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের শিক্ষকেরই যদি বানান সম্পর্কে এই ধারণা, তাহলে বাংলা ভাষার সঠিক প্রয়োগ কীভাবে হবে?
আমাদের দেশে প্রমিত, অর্থাৎ আধুনিক বানান চালু হয়েছে। শিশুদের পাঠ্য বইয়েও। তবু এখনো অনেক ভুল বানান রয়ে গেছে শিশুদের পাঠ্যবইয়ে।
একুশে গ্রন্থমেলা চলছে। লেখকরা কী বানানে লিখছেন, বানান জানা লোকমাত্রই তা জানেন। এমনকি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত বইয়েও অসংখ্য ভুল বানান রয়েছে। যারা বানান সংশোধন করেন, তাদের কজনই বা বানান-ব্যাকরণ ভালো জানেন। আর পত্রপত্রিকাগুলোয় যা ছাপা হচ্ছে, সে কথা না-ই বা বললাম।
রাজনৈতিক ব্যানার-ফেস্টুন-প্ল্যাকার্ডে বানান ভুলের অন্ত নেই। এখন কোন শ্রেণির লোকজন রাজনীতি করছেন, তা তাদের বানান দেখে চেনা যায় বৈকি।
সরকারি-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর বানানের অবস্থাটা কী। সরকারি পদবিগুলো হচ্ছে : ‘কীপার’, ‘এটর্নী জেনারেল’, ‘রেজিষ্ট্রার’, ‘টাইপিষ্ট’ ইত্যাদি। প্রমিত বানান তো তারাই অমান্য করছে। বাংলা একাডেমি কিছুদিন হলো তাদের প্রতিষ্ঠানের নামের বানান প্রমিত করেছে। শিল্পকলা ‘একাডেমী’, শিশু ‘একাডেমী’ এখনো সংশোধিত হয়নি।
সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বানান ঠিক করতে হবে সবার আগে। ‘সুপ্রীম কোর্ট’, ‘আপীল’. ‘রেজিষ্ট্রার’, ‘সরকারী’, ‘লিঁয়াজো’ ইত্যাদি (প্রমিত বানান হবে : সুপ্রিম কোর্ট, আপিল, রেজিস্ট্রার, সরকারি, লিয়াজোঁ) বানান সংশোধন করতে হবে। সরকারি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখা রয়েছে বর্জিত ‘সরকারী’ বানানটি। শিক্ষার্থী তো শিক্ষালয়ে ঢুকতেই ভুল বানানটি শিখে ফেলল। সে শুদ্ধ হবে কীভাবে?
আইন, আইনের ধারাগুলোয় বর্জিত, অপ্রমিত ভাষা ও বানানে ভরা। যেমন- ‘উর্দ্ধতন’ ‘তৈরী’, ‘অষ্ট্রেলিয়া’, ‘জার্মানী’, ‘জনশৃংখলা’ (প্রমিত বানান হবে : ঊর্ধ্বতন, তৈরি, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, জনশৃঙ্খলা)।
সাইনবোর্ড, ব্যানার, ফেস্টুন আর পাঠ্য বই থেকে আমাদের শিশুরা বানান শেখে। শিশুদের ব্যাকরণ বইগুলোও ভুল বানানে ভরা। শিক্ষকেরা প্রমিত বানান জানেন না। শুদ্ধ বানান চালু করার জন্য একটা নীতিমালা দরকার। ভুল বানানের জন্য জরিমানার ব্যবস্থাও করা যেতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে সবার আগে জরিমানা দিতে হবে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকেই।
যা-ই হোক, বাংলা ভাষাকে রক্ষা করতে হলে সর্বস্তরে প্রমিত ভাষা ও বানান চালু করা প্রয়োজন। এর কোনো বিকল্প নেই।
২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪
লেখক : কবি ও সাংবাদিক, ঢাকা।
রাইজিংবিডি / কমল কর্মকার / কে. শাহীন / লিমন
রাইজিংবিডি.কম