ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

অচল নগরী এবং যে প্রশ্নের উত্তর জানা নেই

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৩৫, ২৮ অক্টোবর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অচল নগরী এবং যে প্রশ্নের উত্তর জানা নেই

ফেরদৌস জামান : প্রেসক্লাবের সামনে ফুটপাথের বেঞ্চে বসে চায়ের জন্য অপেক্ষা করছি। সাথে আছেন অগ্রজতুল্য এক বন্ধু। দিনটি হবে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে কোনো এক দিন। কোনো এক কর্মসূচি শেষে চায়ের অপেক্ষা আর সদ্য সম্পন্ন হওয়া কর্মসূচির নানা দিক নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা হচ্ছিল।  ফেব্রুয়ারি হলেও বেশ গরম লাগছিল। আমাদের চা-পানও শেষ। বসে আছি প্রায় আধাঘণ্টা হলো। যানজটে আটকে থাকা সামনের বাসটি তখনও ঠিক একই জায়গায় দাঁড়িয়ে, এক ইঞ্চিও নড়েনি। কখন নড়বে জানে না কেউই।

খেয়াল করলাম সেই ফেব্রুয়ারিতেও লোকটির কপাল থেকে দরদর করে ঘাম ঝড়ছে, গায়ের শার্ট ভিজে গেছে ইতিমধ্যেই। অস্বস্তিতে মাথা ও হাত জানালা দিয়ে বের করে দিলেন। এই সময়টুকুর মধ্যে লোকটি একটু আরামের জন্য বাসের সিটে বসেই কত বার যে অবস্থার পরিবর্তন করলেন, দেখতে দেখতে আমার প্রায় মুখস্ত হয়ে গেল। নিশ্চই অফিসে আসার সময়ও তাকে যানজটে এমন করে আটকে থাকতে হয়েছিল? এমন পরিস্থিতিতে পড়া কোনো মানুষকে এত দীর্ঘ সময় ধরে এর আগে আর কখনও পর্যবেক্ষণ করা হয়নি। এ কারণেই সম্ভবত পত্রিকায় যানজটের খবর দেখলেই দৃশ্যটি আজও আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আর ঠিক তখনই মনে পড়ে যানজটে আটকে থাকা ফেসবুক বন্ধুদের হরেক রকম প্রতিক্রিয়ার কথা। সেগুলো বিরক্তি, ব্যঙ্গ, ক্ষোভ-বিক্ষোভ অথবা বিদ্রোহের বহিঃপ্রকাশ। একদিন দেখলাম একজন লিখেছেন: ‘গত পরীক্ষায় মেয়ে গণিতে খারাপ করেছে, অনেক দিন নিয়ে বসতে পারি না। আজ ইচ্ছা ছিল বাসায় ফিরে ওকে গণিত পড়াব। তা আর হলো কই- পল্টন মোড় থেকে বাংলামটর পৌঁছাতেই পেরিয়ে গেল আড়াই ঘণ্টা! আর কত কত ঘণ্টা বিসর্জন দিলে এই মৃত্যুকূপ থেকে মুক্তি মিলবে?’

জানি না ভদ্রলোকের মেয়েটি পরবর্তী পরীক্ষায় গণিতে কেমন করেছিল। আর এক বন্ধুর স্ট্যাটাস মনে পড়লে আজও কষ্ট পাই। ‘বাড়ি যাওয়ার সুযোগ পাই না। দেড় মাস হলো মা অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে অছে। আজ বাড়ি যাব বলে বেরিয়েছিলাম। কাল সারাদিন মায়ের কাছে বসে মাথা টিপে দেব, হাত-পা টিপে দেব, মুখে ডালিমের রস চিপে দেব- তা আর হলো না! অফিস থেকে বেরিয়ে বাসস্ট্যান্ডে যেতে যানজটেই পেরিয়ে গেল চার ঘণ্টা। রাত বারোটার পর বাড়ি যাওয়ার আর কোনো বাস পাওয়া যাবে না। এ দেশে জন্মে কি অন্যায়টা করেছি যার খেসারত এমন করে দিতে হবে?’

বন্ধুটি এমন করেই তার অসহায়ত্বের কথা লিখেছিলেন। জানি না শেষ পর্যন্ত তিনি তার অসুস্থ মায়ের সেবা করার সুযোগ পেয়েছিলেন কিনা? আবার দেখলাম সেদিন একজন লিখেছেন: ‘নিম্ন থেকে মধ্যম আয়ের লক্ষে সোনার বাংলার রাজধানীতে এক কিলোমিটার পাড়ি দিতে চার ঘণ্টা- হা হা হা! দশ মিনিটের পথ দুই ঘণ্টায় পাড়ি না দিলে ডিজিটাল বাংলায় রাস্তার পাশের গাছে আর বিভিন্ন খুঁটিতে টানানো ছবির অ্যালবামগুলি জনগণ দেখবে কেমন করে!’

ভেবে দেখলাম কথাটি অমূলক নয়। কারণ এত এত অর্থ ব্যয়ে শুভেচ্ছা, অভিনন্দনের বাণী-বার্তা আর নিজেকে সমর্পণ ও অনুগত করে দেয়ার ঘোষণার উদ্দেশ্যে ঝুলানো ছবির সমাহার যদি জনগণ এক নজর না-ই দেখে তাহলে লাভ কী? অন্য একজন দেখলাম লিখছেন: ‘বিমানবন্দর থেকে কাকলি যাব, দুই ঘণ্টায় মাত্র খিলক্ষেত পৌঁছেছি। মনে হচ্ছে হাতে পিস্তল থাকলে নিজের মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করতাম!’ আহারে বন্ধুটির নিশ্চয়ই জরুরি কাজ ছিল, সময় মতো না পৌঁছুতে পারলে হয়ত জীবনের কোনো অপুরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে।

কে জানে প্রেসক্লাবের সামনে আটকে থাকা ঐ লোকটির পরিস্থিতিও হয়তো এদেরই কোনো এক জনের মতো। অথবা আর কিছু না হোক বাসায় ফিরে পরিবারকে একটু সময় দেয়া, পরের দিন কর্মক্ষেত্রে কাজ করার শক্তি অর্জনের জন্য আরাম করে খানিকটা বিশ্রাম করা, খাতা মেলে দুই লাইন কবিতা লেখা বা পছন্দের বইটি থেকে দুই-চার পাতা পড়া। দুই কোটি মানুষের আবাসস্থল ঢাকার রাস্তায় প্রতিনিয়ত কত মানুষের আবেগ, ভালোবাসা, দায়িত্ববোধ, স্বপ্ন এবং সৃজনশীলতার মৃত্যু ঘটে- সে খবর রাখার সময় কি আমাদের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হবে?

বসবাসের জন্য পৃথিবীর কোন নগরী কেমন তার সূচক বের করে ইকনোমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) নামক একটি সংস্থা। পত্রিকা মারফত জানলাম ইআইইউ-এর সমীক্ষা মতে বসবাসের অযোগ্য নগরগুলোর মধ্যে ২০১৩ সালে ঢাকা ছিল এক নাম্বারে। আনন্দের খবর হলো এই বছর উঠে এসেছে তিন নাম্বারে। কিন্তু আনন্দ ম্লান হয়ে যায় তখনই, যখন জানলাম, এক ও দুই নাম্বারে রয়েছে যথাক্রমে লিবিয়ার ত্রিপলি এবং সিরিয়ার দামেস্ক। দুটোই যুদ্ধবিদ্ধস্ত নগরী। সমীক্ষা বলছে ২০০৪ সালে ঢাকায় যানবাহণের গতি ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার, বর্তমানে তা নেমে এসেছে ৭ কিলোমিটারে এবং এই অবস্থা চলতে থাকলে ২০২৫ সালে নেমে যাবে ৪ কিলোমিটারে। অথচ, মানুষের স্বাভাবিক হাঁটার গতিই ঘণ্টায় ৫ কিলোমিটার।

সামান্য বৃষ্টিতেই মহানগরের পথঘাট পানিতে তলিয়ে যায়। উন্নয়ন ও সংস্কারের নামে অপরিকল্পিতভাবে একাধারে চলে নগরীর রাস্তা খোড়াখুরি এবং অন্য দিকে জলাশয় ভরাট করে নতুন নতুন তিলোত্তমা নগর-বন্দর গড়ে তোলার কায়কারবার। এই কাজ যাদের দায়িত্বে তাদের সমন্বয়হীনতার কারণে সৃষ্ট দুর্ভোগের ইতি আমরা কবে দেখতে পাব? এই ভয়বহ দুর্ভোগের সমাধান আসলে কার হাতে সেটাও অবশ্য এক প্রশ্ন বটে! রাজউক, দুই সিটি কর্পোরেশন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, যোগাযোগ মন্ত্রণালয় নাকি আসমানী কোনো মোজেজার হাতে? সমাধান যার হাতেই থাকুক দেশের মানুষ বুঝে গেছে প্রকল্প ব্যয় ধাপে ধাপে কোন মধুচক্রের কারণে বেড়ে যায় আর পৃথিবীর মধ্যে নির্মাণ ব্যয় সবচেয়ে বেশি কোন দেশে? সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, গোলটেবিল আর চারকোণা টেবিল যে বৈঠকই বলা হোক না কেন এসব যে কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না তা বহু আগেই প্রমাণিত হয়ে গেছে অন্তত আমাদের জন্য। এ সমস্ত খোশ মজলিস বৈঠক আর টুপি-জার্সি পড়ে অমুক দিবস, তমুক দিবস সেলিব্রেশন আর দাবি-দাওয়ার কর্মসূচি প্যানপানানি ছাড়া অন্য কিছু নয়। সামগ্রিক পরিকল্পনার অভাব, সমন্বয়হীনতার অভাব, রাষ্ট্রের শিরায় শিরায় দুর্বৃত্তায়ন ইত্যাদির উল্লেখ করে যেসমস্ত সুপারিশ, রূপকল্প ও গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরা হয় আদতে কর্তৃপক্ষ এসব প্রকৃতির বিশেষ কর্ম শেষে ব্যবহারের উপযোগী টিস্যু হিসেবেও গণ্য করে কি না সন্দেহ আছে।

প্রশ্ন আসতে পারে এর থেকে পরিত্রাণের জন্য জনগণ তাহলে কার কাছে যাবে? এইটি একাধারে একটি খাঁটি ও জটিল প্রশ্ন। বর্তমানে সরকারে আওয়ামী লীগ। সুতরাং বিএনপি দিতে পারে এর সমাধান। আবার বিএনপির মেয়াদ শেষ হতে না হতে আশা ভঙ্গের হতাশ জনগণ সমাধানকারী হিসেবে ফের আওয়ামী লীগকে বেছে নেবে। এই গোলক ধাঁধার খেলা চলছে গত আড়াই দশক। অর্থাৎ পাঁচ বছর অন্তর অন্তর এদের দুয়ের মধ্যে একের অযোগ্যতা অন্যের গ্রহণযোগ্যতা হিসেবে অবিষ্কার হয়ে আসছে। কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, শ্রেণী চরিত্রের বিবেচনায় এরা আসলে টাকার এ-পিঠ, ও-পিঠ।

তাহলে জনগণ কার কাছে যাবে? কারণ এই দুই দল ছ্ড়া আর কে আছে? তথাকথিত বাম বা দক্ষিণ মণ্ডলীদের মধ্যে আর যাদের চোখে পড়ে তাদের ওপর জনগণ ভরসা করতে পারে না। এদের নীতি হলো পরিস্থিতি বুঝে লেজুর বনে যাওয়া। এ তাদের বহু পুরনো চরিত্র। জনগণ সবসময় ভরসার অনুসন্ধান করে। সুতরাং, জনগণের ভরসার জায়গাটুকু তারা তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং জনগণ এদেরকে দুই বলয়েরই অংশ মনে করে। অতএব, দুই বলয়ের বাইরে তিন নাম্বার হিসেবে কার্যত কেউ নেই। এরও বাইরে একটু দূরে আর যারা যারা আছে তারা কোনো নাম্বারেই নেই, নাম্বার ছাড়া। দেখা যায়, আছে হয়ত পনের জন তার মধ্যে আবার চৌদ্দটি ভাগ। তত্ব নিয়ে চিন্তা-ফিকির করতে করতে মাথা কেশশূন্য হয়ে যাওয়ার উপক্রম। জনগণের সাথে চরমভাবে সম্পর্কহীন, বদ্ধ ঘরে বসে ভাবনা, গবেষণা আর স্বপ্নে বিভোর। এই হলো তাদের বর্তমান বাস্তবতা। মাঝে মধ্যে রাস্তায় নামলেও দেখা যায় তাদের কথা কেউ বোঝে না, শোনেও না। অনেক দিন আগের কথা, প্রেসক্লাবের সামনে এক সমাবেশ চলছে, জমায়েত পনের-কুড়ি জনের হবে। রাস্তায় হালকা যানজট বেঁধে গেল। সময়টা ছিল রমজান মাস। বাসে বসা সামনের সারির এক যাত্রী পাশের জনকে বলছে, এগুলো বোধহয় রোজা রাখে না এবং রোজাদারদের পেরেশানির কথাও বোঝে না! প্রতিক্রিয়ায় পাশের জন বলল, মাঝে মধ্যে একটু আধটু ঘেউ ঘেউ না হলে মানানসই লাগে না। এই হলো পরিস্থিতি।

আসলে উন্নয়ন কিন্তু কম হয়নি। তারপরও জনগণের দুরবস্থা কাটছে কোথায়? তাহলে কি বলব পরিকল্পনার অভাব? অনেক সময় দেখা যায়, দুরবস্থার পেছনের কারণ চিহ্নিত হওয়া সত্বেও সমাধানের কোনো লক্ষণ নেই! কারণ সমাধান যাদের দ্বারা হবে, দেখা যায় সমস্যার পেছনের কলকব্জা তাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। একটি দেশের জন্য এর চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক আর কিছু হতে পারে না। সুতরাং শুধুমাত্র বৈঠক করে, আর্টিকেল-কলাম লিখে আর গবেষণা প্রতিবেদনে কাজ যে হবার নয় তা জনগণের জানা হয়ে গেছে। তেমনি ফেসবুকে মুহূর্তে মুহূর্তে পোস্ট দিয়েও কোনো কাজ হবে না। দরকার এই ক্ষোভ-বিক্ষোভের সমন্বয় বা ঐক্য। যে প্রশ্নের আপাতত কোনো উত্তর জানা নেই তা হলো- কে দেবে সেই সমন্বয় বা ঐক্য গড়ে তোলার ভরসা, কে দেবে সেই দিশা?



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ অক্টোবর ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়