ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

অতীশ দীপঙ্করের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এবং জন্মসূত্র মতভেদ

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:০৫, ৭ জুলাই ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অতীশ দীপঙ্করের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এবং জন্মসূত্র মতভেদ

ফেরদৌস জামান : গত ২৮ জুন, নীরবে, বলা যায় অলক্ষ্যে পেরিয়ে গেল অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের দেশে ফেরার দিন। প্রয়াণের প্রায় হাজার বছর পর এদিন বাংলার মাটিতে তাঁর দেহভস্ম স্মৃতিস্বরূপ ফিরিয়ে আনা হয় সুদূর তিব্বত থেকে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, খ্রিস্টীয় দশম শতকে তিব্বতে বৌদ্ধ ধর্মের আদর্শ দুর্বল হয়ে পড়ে। পরিস্থিতি বিবেচনায় রাজা যোশেও ধর্ম পুনঃপ্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে অতীশ দীপঙ্করকে তিব্বতে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিক্রমশীলায় দূত প্রেরণ করেন। বহু চেষ্টার পর দূত বিফল হয়ে ফিরে যায়। তারপরও রাজা ক্ষান্ত হলেন না। রাজা চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলেন। কিন্তু আশা পূরণ হওয়ার আগেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

অতঃপর তার পুত্র চংছুপ দ্বিতীয়বারের মতো একদল দূত প্রেরণ করেন। দূতগণের বহুবিধ চেষ্টার পর অতীশ দীপঙ্কর তিব্বতে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। সে মোতাবেক ৬০ বছর বয়সে তিনি তিব্বতের উদ্দেশে যাত্রা করেন এবং নেপাল হয়ে ১০৪০ খ্রিস্টাব্দে তিব্বত উপস্থিত হন। রাজ দরবারের পক্ষ থেকে এ সময় তাঁকে এমন সংবর্ধনা দেয়া হয়, যেন তাদের নিকট স্বয়ং দেবব্রহ্মা কিংবা বুদ্ধ বোধিসত্বরূপে উপস্থিত হয়েছেন। তারা অতীশ দীপঙ্করের অসাধারণ জ্ঞান ও গুণ লক্ষ্য করে তাঁকে ‘জো-বো-জে’ অর্থাৎ স্বামী ভট্টারক বা সর্বোচ্চ গুরু উপাধিতে ভূষিত করেন। এরপর তিনি সেখানে বৌদ্ধ ধর্ম পূনঃপ্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেন।

অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান তিব্বতে তেরো বছর অবস্থান করেন। ১০৫৪ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করার আগ পর্যন্ত তিনি সেখানেই ছিলেন। অতীশ বা অতীশা তাঁর পিতা-মাতা বা গুরু প্রদত্ত নাম নয়। বরং তিব্বতবাসীর অসীম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার নিদর্শন স্বরূপ উপাধি। যার অর্থ সর্বশ্রেষ্ঠ বা মহামানব। তিব্বতের ধর্ম ও সংস্কৃতিতে দীপঙ্করের প্রভাব আজও বিদ্যমান। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি তিব্বতের রাজধানী লাসার নিকটে তাঁর প্রতিষ্ঠিত থ্যানাং বিহারে অবস্থান করেন। এখানে অবস্থান কালে বৌদ্ধ ধর্ম ও সংস্কৃতি, দর্শন বিষয়ক এবং অনুবাদসহ রচনা করেন দুই শতাধিক গ্রন্থ।

অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান ইতিহাসখ্যাত পণ্ডিত, যিনি পাল সাম্রাজ্যের দশম ও একাদশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত হিসেবে স্বীকৃত। একইসঙ্গে তিনি বৌদ্ধ ভিক্ষু, দার্শনিক ও ধর্ম প্রচারক। বিদ্যা অর্জনের জন্য তিনি মগধ, সুমাত্রা ও শ্রীলঙ্কা ভ্রমণ করেন। তিব্বতে গমনের আগে তিনি ইতিহাসখ্যাত বিক্রমশীলা, দন্তপুরী ও সোমপুর বিহারে দীর্ঘ দিন অধ্যাপনা ও আচার্যের দায়িত্ব পালন করেন। ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ ও গবেষণায় এখন আমরা জানতে পারি, তিনি খ্রিস্টীয় দশম শতকের শেষ ভাগে ৯৮০ অথবা ৯৮২ খ্রিস্টাব্দে সামন্ত রাজ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। এর অবস্থান ছিল বিক্রমশীলায়। উল্লেখ্য, মুসলমান অধিকারের আগে বিক্রমশীলা সহোর বা ভাগলপুর নামে পরিচিত ছিল। যদিও তাঁর জন্মসূত্র বা জন্মস্থান নিয়ে রয়েছে নানা মত। অর্থাৎ প্রকৃতপক্ষে এই সহোরের অবস্থান কোথায় ছিল তা আজও একটি প্রশ্ন। তবে গবেষক ও পণ্ডিতদের প্রদত্ত তথ্য প্রমাণ বিশ্লেষণে বেশিরভাগ সমর্থন মেলে যে, তাঁর জন্ম বাংলাদেশের বিক্রমপুর, বর্তমান মুন্সিগঞ্জ জেলাধীন বজ্রযোগিনী গ্রামে।

মহাপণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন গত শতকের ত্রিশ খ্রিস্টাব্দে তিব্বত ভ্রমণ করেন। তিনি সেই ভ্রমণ বৃত্তান্ত নিয়ে রচনা করেন ‘তিব্বতে সওয়া বছর’ গ্রন্থ। এই গ্রন্থে উল্লেখ করেন, সহোরের ভৌগলিক অবস্থান প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে নয়, ইন্ডিয়ার বিহার রাজ্যে। তার আগে মহামহোপাধ্যায় শ্রী সতীশচন্দ্র বিদ্যাভূষণ বিহার প্রদেশেই প্রাচীন বিক্রমশীলা বৌদ্ধ বিহারের সঠিক স্থান বলে চিহ্নিত করেন। এই মতের সাথে রাহুল সাংকৃত্যায়ন সম্পূর্ণ একমত পোষণ করেন। একই সাথে উল্লেখ করেন, মুসলমান আমলের আগে বিক্রমশীলা অঞ্চল সহোর বা ভাগল নামে পরিচিত ছিল। সে সময় সমস্ত বিহার ও বঙ্গদেশে পাল বংশের বিজয় পতাকা উড্ডীন ছিল। দশম শতকের প্রথম ভাগে রাজা কল্যাণশ্রী ছিলেন পাল বংশের অধীন এক সামন্ত নৃপতি, যার রাজধানীর নাম ছিল বিক্রমপুরী (ভাগলপুরী/ভাগলপুর) এবং সহোর প্রাসাদের নাম ছিল কাঞ্চনধজ। সেই প্রাসাদে রাণী প্রভাবতি দেবীর গর্ভ জন্ম নেন দীপঙ্কর। পদ্মগর্ভ, চন্দ্রগর্ভ ও শ্রীগর্ভ এই তিন পুত্রের মধ্যে চন্দ্রগর্ভ অর্থাৎ দীপঙ্কর ছিলেন দ্বিতীয়।

উনিশ শতকের শেষ ভাগে কূটনীতিক ও পণ্ডিত শরৎচন্দ্র দাস ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ ভারতের দূত হিসেবে তিব্বত গমন করেন। সেখানকার সংস্কৃতি, প্রকৃতি ও ধর্মসহ অন্যান্য বিষয়ে উৎসাহ বোধ করেন। সে কারণে তিনি তিব্বতের প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরে বেড়ান এবং অনেক বিহার ও গুম্ফা (উপাসনালয়) দর্শন করেন। সেখানে সংরক্ষিত প্রাচীন পাণ্ডুলিপির প্রতি তার আগ্রহ জন্মে এবং গভীর মনোযোগে পাঠ করেন। পরে একই উদ্দেশ্যে ব্যক্তিগত উদ্যোগে তিনি একাধিকবার তিব্বত ভ্রমণ করেন। অতঃপর তিব্বতে অর্জিত অভিজ্ঞতার উপর দুটি গ্রন্থ রচনা করেন: ‘ইন্ডিয়ান পন্ডিতস ইন দা ল্যান্ড অব দা স্নোস’ এবং ‘ট্রাভেল অ্যাকাউন্টস অব তিব্বত’। বলা যায় এর আগে দীপঙ্কর বাঙালি স্মৃতির একেবারে পেছনেই চলে গিয়েছিলেন। শরৎচন্দ্র বাবুর এই দুটি গ্রন্থের কারণে দীপঙ্করসহ কয়েকজন বাঙালি পণ্ডিতের গৌরবজনক কির্তী প্রথমবারের মতো আমাদের নজরে আসে।

গ্রন্থগুলোতে অতীশ দীপঙ্করের কর্ম সম্পর্কেও আলোচনা রয়েছে। তিনি উল্লেখ করেছেন, অতীশ দীপঙ্কর বঙ্গের বিক্রমপুর অঞ্চলের রাজপরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম কল্যাণশ্রী এবং মাতার নাম প্রভাবতী। তাঁর পারিবারিক নাম চন্দ্রগর্ভ। ওদিকে দীপঙ্করের দুজন তিব্বতি শিষ্য দুটি স্তোত্র রচনা করেছেন। এঁদের একজন ‘ব্রোমত্রাপা’। তিনি লেখেন :

‘ত্রি-সম্পন্ন বঙ্গের সহোর রাজকূলে

যে মহান জীববংশে শান্তিজীব

জন্মেছিলেন সেই বংশজাত

দীপঙ্কর শ্রীর চরণে প্রণিপাত।’
 

অপর স্তোত্রটি লেখেন নাগছে ছুলঠিম জলবা। যিনি দীপঙ্করকে বিক্রমশীলা থেকে তিব্বত নিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর স্তোত্রেও সহোরের অবস্থান ভারতবর্ষের পূর্ব দিকে নির্দেশ করেছেন। তিব্বতি ঐতিহাসিক বু-তোন এর উদ্ধৃতি করে দীপঙ্করের জীবনীকার অলকা চট্টোপাধ্যায় বলেন, তিনি বঙ্গাধিপতি কল্যাণশ্রীর পুত্র। লক্ষণীয় বিষয় হলো, উপরোক্ত প্রায় অধিকাংশ তথ্যপ্রমাণেই সহোর কথাটি গুরুত্ব পেয়েছে।

আজ পর্যন্ত বাঙালির ইতিহাসের উপর রচিত সর্বাধুনিক গ্রহণযোগ্য গ্রন্থগুলির মধ্যে অন্যতম ড. নীহার রঞ্জন রায় এর ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস: আদিপর্ব’। এখানেও তিনি অতীশ দীপঙ্করের জন্মস্থান বাংলাদেশের বিক্রমপুর বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি এ কথাটিও বলেছেন যে, কেউ কেউ মনে করেন সমস্ত হিন্দুস্থানের নামই জহোর বা সহোর ছিল। পাগ-নাম-জো-জাং নামক তিব্বতি গ্রন্থে শান্ত রক্ষিতের (দীপঙ্করের শতাধিক বছর আগে তিব্বতে গমনকারী আরেক গুরুত্বপূর্ণ ধর্মপণ্ডিত) পরিচয় বাঙালি বলে উল্লেখ রয়েছে। গ্রন্থটিতে তাঁকে সহোরের রাজপরিবারের সদস্য বলা হয়েছে এবং দীপঙ্কর সম্বন্ধেও বলা হয়েছে, তিনি ছিলেন সহোর রাজবংশদ্ভূত। অধিকন্তু ঐতিহাসিক ও প্রত্নতত্ত্ববিদ ড. আহমেদ হাসান দানী এবং ইতিহাস গবেষক ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে দীপঙ্করের সময়ে বঙ্গে চন্দ্র বংশের রাজত্ব ছিল। উক্ত বিষয়ে তারা চন্দ্র বংশের বিভিন্ন রাজার নাম ও সময় সবিস্তারে উল্লেখ করেছেন, যাদের সকলেরই রাজ্যকেন্দ্র বা রাজধানী ছিল বিক্রমপুর।

যাই হোক, ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দের ২৮ জুন বাংলার বৌদ্ধ সমাজ তথা সমগ্র দেশের জন্য এক ঐতিহাসিক দিন। প্রয়াণের প্রায় হাজার বছর পর অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের দেহভস্ম এদিন বাংলার মাটিতে ফিরিয়ে আনা হয়। তৎকালীন বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সঙ্ঘের সভাপতি ছিলেন শ্রীমৎ বিশুদ্ধানন্দ মহাথের। তিনি বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ সহযোগিতায় চীন থেকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় অতীশ দীপঙ্করের চিতাভস্ম ঢাকায় নিয়ে আসেন, যা বর্তমানে ঢাকার ধর্মরাজিক বৌদ্ধ বিহারে সংরক্ষিত রয়েছে। অতীশ দীপঙ্করের জন্মভিটা রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় বিশ কিমি দূরে মুন্সিগঞ্জ জেলার বিক্রমপুরের বজ্রযোগীনি গ্রামে। সেখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে। ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে চীনের আর্থিক সহযোগিতায় তিব্বতের মডেল অনুকরণে স্তম্ভটি নির্মাণ করা হয়। দীপঙ্করের প্রকৃত জন্মস্থান নিশ্চিত হতে এখানে উল্লেখ করা তথ্যাদী এখন পর্যন্ত গবেষণাসমূহের অসামান্য একটি অংশ। তবে আলোচিত সমস্ত তথ্যের ভিত্তিতে বলা যেতে পারে যে, অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের জন্মস্থান বাংলাদেশের বর্তমান মুন্সিগঞ্জ জেলার বিক্রমপুর।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৭ জুলাই ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়