ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

ডিজিটাল উপকূল-৫

অনলাইনে বাজার প্রসার, জেলে-কৃষকের সুদিন

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:০৯, ২০ এপ্রিল ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অনলাইনে বাজার প্রসার, জেলে-কৃষকের সুদিন



প্রবীণ কৃষক মাহবুবুর রহমান (৫৫)। বিকেলের ন্যূয়ে পড়া রোদে বাড়ির সামনের অড়হর ক্ষেত পরিচর্যায় ব্যস্ত। হাতের নিড়ানি ফেলে চোখ ল্যাপটপের পর্দায়। অড়হর স্থানীয় ভাষায় ‘ফেলন ডাল’ নামে পরিচিত। এই ফসলের রোগবালাই সম্পর্কে তার কথা হচ্ছিল কৃষি কর্মকর্তার সাথে। ল্যাপটপের রোগবালাইয়ের ছবি দেখে মাহবুবুর রহমান বাস্তবের সাথে মিলিয়ে নিচ্ছিলেন।

এটি উপকূলীয় জেলা লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার তোরাবগঞ্জ গ্রামের চিত্র। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে কৃষকদের নানান বিষয়ে পরামর্শ দেয়া হয়। ফসলের জাত নির্বাচন থেকে রোগবালাই দমন, আগাছা নিধন ইত্যাদি বিষয়ে পরামর্শ দেয়া হয়। সেই কাজটিই করছিলেন কমলনগর উপজেলার উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মিহির কান্তি সাহা।

বেশকিছু স্থানে কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কৃষি সহায়তা নিতে কৃষকদের এখন আর কৃষি অফিসের দুয়ারে গিয়ে দিনের পর দিন ধর্না দিতে হয় না। সেবা চলে আসে মাঠে। কোন কোন এলাকার কৃষকেরা ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার কিংবা অন্য কোন স্থান থেকে অনলাইনে সেবা চাইলে কৃষি অফিস থেকে দেয়া হয়। ভালো ফলনের আশায় কৃষকেরা ফসলের জাত নির্বাচন, রোগবালাই দমন, নিড়ানি, ওষুধ প্রয়োগ ইত্যাদি বিষয়ে পরামর্শ চান। অনেকেই অনলাইন সেবায় ভালো ফলও পেয়েছেন।
 


সয়াল্যান্ড হিসেবে পরিচিত লক্ষ্মীপুরের বিভিন্ন এলাকার কৃষকেরা সয়াবিন চাষে বেশ সাফল্য পেয়েছেন। সম্প্রতি সয়াবিন চাষে জাত নির্বাচনের ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে তারা লাভবান হয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। কমলনগরের চর লরেন্সের মো. মামুনের বাবা নজির আহমেদ বেশ কয়েক বছর ধরে সয়াবিন চাষ করছেন। শুরু থেকেই ফলন বাড়ানোর নানান উপায় খুঁজেছেন তিনি। একবার তার ছেলে তাকে আধুনিক পদ্ধতিতে সয়াবিন চাষের কলাকৌশল দেখালে নজির আহমেদ নিজের অভিজ্ঞতার সংমিশ্রনে ৪০ শতক জমিতে সয়াবিন চাষ করেন। অল্প সময়ে তার অধিক ফলন এসেছে। আগে রবি মৌসুমে সয়াবিন হলেও এখন খরিপ মৌসুমেও এ ফসল আবাদের কলাকৌশল কৃষকেরা আয়ত্ব করেছেন। এ কাজে সহায়তা করেছে তথ্যপ্রযুক্তি।

সয়াবিন ছাড়াও অন্যান্য ফসলের জাত নির্বাচনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রেও তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে। এমন কথা বলছিলেন নোয়াখালীর সুবর্ণচরের চরবাটা ইউনিয়নের ডিজিটাল সেন্টারের পরিচালক জোবায়ের ইসলাম। তিনি বলেন, ‘ডিজিটাল সেন্টারে যারা তথ্যসেবা নিতে আসেন, তাদের মধ্যে কৃষকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তরমুজ, মরিচ, ধান, সয়াবিনসহ বিভিন্ন ফসলের রোগবালাই দমনের উপায় খুঁজতে কৃষকেরা আসেন। তথ্য পেয়ে এদের অনেকেই উপকৃত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন কৃষকেরা। কৃষি সেবার জন্য কৃষি ওয়েবসাইট রয়েছে। সেখানে ব্যক্তিগত পর্যায়ে অনেকেই যোগাযোগ করে তথ্য নিচ্ছেন।’

সূত্র বলছে, শুধু ফসলের বিষয়ে নয়, জমির পর্চা ওঠানোর ক্ষেত্রেও কৃষকেরা তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তা নিচ্ছেন। অফিসে গিয়ে কাগজ তুলতে যেখানে ৪-৫শ’ কিংবা কখনো আরও বেশি টাকা লাগতো, তখন অল্প খরচে মাত্র ৪০-৪৫ টাকায় জমির পর্চা তুলতে পারছেন কৃষকেরা। নোয়াখালীর চরবাটা ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার, কমলনগরের ফলকন ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার, পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালীর চরমোন্তাজ ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে এমন অনেক কৃষকের দেখা পাই, যারা তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে জমির কাগজপত্র তুলেছেন। 
 


ফসলের ভালো দাম পাওয়ার ক্ষেত্রেও অনলাইনের সহায়তা নেন কৃষকেরা। কৃষি পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে তারা বিভিন্ন স্থানের বাজার যাচাই করতে পারেন মোবাইলের মাধ্যমে। মরিচ, পেঁয়াজ, আলু, বাদাম, সয়াবিনসহ বিভিন্ন পণ্য বিক্রিতে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার কৃষকদের ভালো ফল দিয়েছে। ভোলার কাছিয়া দ্বীপের কৃষক মনিরুজ্জামান বলেন, ‘এখান থেকে বিভিন্ন কৃষিপণ্য আমরা বাজারে পাঠাই। কিন্তু কোন বাজারে পাঠাবো, সেটা ঠিক করে নেই মোবাইলে। অনেক সময়ে অনলাইনে বাজারদর যাচাই করি। এটা আমাদের পণ্য বাজারজাতকরণ অনেকটা সহজ করে দিয়েছে।’

লক্ষ্মীপুর জেলা উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. আবুল হোসেন বলেন, ‘অনলাইনে কৃষিসেবা এখন সহজ হয়েছে। অতি সহজেই তারা কৃষি বিষয়ক সব সমস্যার সামাধান পাচ্ছেন। কৃষকদের জন্য রয়েছে কৃষি কল সেন্টার। এখানে কল দিলে ফসলের জাত নির্বাচন, রোগবালাইসহ বিভিন্ন বিষয়ে তারা তথ্য জানতে পারেন। ছোটখাট সমস্যায় অনেকেই এখন এ সেবা নিচ্ছেন।’

চাষাবাদের ফাঁকে শেষ খবরটা জানতে ইচ্ছা করলে মোবাইলে বাটন টিপে অনলাইনে চোখ বুলিয়ে নেন পটুয়াখালীর চরমোন্তাজের  কৃষক আবদুস সালাম। বললেন, ‘খবর জানতে অনলাইন দেখি। বাজেটে চাষির ভাগ্যে কী জুটেছে, ঝড়ের গতিবেগ কোনদিকে ধাবিত হচ্ছে, এমন সব তথ্য এই চাষির হাতে মুঠোয়। কোন বাজারে কী দরে পণ্য বিক্রি হচ্ছে, তা-ও জানা যায় মোবাইল যোগাযোগের মাধ্যমে।’  আবদুস সালামের মত আরও বহু কৃষক-জেলের দেখা মেলে উপকূলের বিচ্ছিন্ন জনপদে, যারা অনলাইনে ভরসা রাখেন। নিজের মোবাইল থেকে অনলাইনে ঢুকে শেষ খবরটা জেনে নেন। তারা বলছিলেন, তথ্য তাদের জীবন আরও সাচ্ছন্দ্য করে তুলেছে। সব খবর তারা অনলাইনেই পান। ফলে তাদের জীবন অনেকটাই সহজ হয়েছে। কৃষক হোসেন আলী বলেন, ‘এক সময় মনে হতো আমরা বিচ্ছিন্ন এলাকায় আছি। এখন তা মনে হয় না। প্রয়োজনের সময় সবকিছুই আমরা জানতে পারি।’ 

ভোলার চরফ্যাসন উপজেলার দ্বীপ ইউনিয়ন ঢালচরের চেয়ারম্যান আবদুস সালাম হাওলাদা বলেন, ‘এক সময় তো মনে হতো আমরা দুর্গম দ্বীপে বসবাস করছি। ভৌগোলিকভাবে এখনও দুর্গম দ্বীপেই আছি। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তির সহজলভ্যতার কারণে সংকট অনেকখানি কমে এসেছে। প্রায় সব পরিবারের জন্যই মোবাইল এখন অপরিহার্য। মোবাইলে তারা যে শুধু স্বজনের খবর নেন তা নয়, এর মাধ্যমে কৃষক, জেলেসহ সব পেশার মানুষ নিজ নিজ তথ্য জানতে পারেন।’
 


তিনি আরো বলেন, ‘বর্ষায় ইলিশ ধরার মৌসুমে ঢালচরে অন্তত ১০ হাজার মাছধরার ট্রলার ভেড়ে। মাছ নিয়ে তারা এখানে আসে। সেই মাছ এখানে বরফজাত হয়ে বিভিন্ন স্থানে যায়। মাছ বরফজাত করে বিভিন্ন স্থানে সুষ্ঠুভাবে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির বিরাট ভূমিকা রয়েছে।’

তথ্যপ্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে মাছ চাষ ও মাছ ব্যবসায়ও। অনেকে ইউটিউব থেকে আধুনিক মাছ চাষের কলাকৌশল দেখে মাছ চাষ করছেন। এতে তারা ভালো ফল পাচ্ছেন। উৎপাদন বেড়েছে, আয় বেড়েছে। নদী-সমুদ্রে মাছ ধরারত জেলেদের অনেকে ফেসবুকের মাধ্যমে অনলাইনে সম্পৃক্ত। ফলে যেকোন খবর তার কাছে পৌঁছাচ্ছে অনেক সহজেই। দুর্যোগের খবর পেলে অতিদ্রুত কিনারে আসতে পারছেন। আবার মাছের বাজার দরের বিষয়েও অনলাইনে খোঁজ নিতে পারছেন। এভাবে মাছ ব্যবসায়ীরাও বিভিন্ন বাজারের খোঁজখবর নিয়ে সেখানে মাছ পাঠাচ্ছেন।

অনলাইনে বাজার প্রসারের ব্যতিক্রমী এক তথ্য পাওয়া যায় কমলনগরের তোরাবগঞ্জ বাজারে। এই বাজারের তরকারি গলিতে রয়েছে সুমন দধি বিতান। মোহাম্মদ সুমন এর স্বত্বাধিকারী। এখানে মহিষের দুধের দধি বিক্রি হয়। এ এলাকা থেকে অনেক আগে থেকেই মহিষের দুধের দধি বিভিন্ন এলাকায় বেচাকেনা হতো। কিন্তু এখন অনলাইনে বেচাকেনা হচ্ছে। ফলে বেচাকেনা আগের চেয়ে বেড়েছে। সুমন জানালেন, ‘দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অনলাইনে অর্ডার পাওয়া যায় এবং যেখানে যেভাবে সম্ভব দধি পৌঁছানো হয়। বাজারজাতকরণে তথ্যপ্রযুক্তির ছোঁয়া লাগায় বাজার অনেক প্রসারিত হয়েছে।’  

জানা গেছে, দেশ-বিদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে উপকূলের স্বজনদের কাছে টাকা পাঠাতেও তথ্যপ্রযুক্তির সেবা নেওয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে এসেছে বিরাট পরিবর্তন। আগে টাকা পাঠাতে ভোগান্তি পোহাতে হতো। এখন ভোগান্তি অনেকখানি কমেছে। মুহূর্তেই স্বজনরা টাকা পাঠাতে পারেন বাড়িতে। দ্বীপ জেলা ভোলার দ্বীপ উপজেলা মনপুরার চর কলাতলীর বাসিন্দা শেফালী বেগম বাড়িতে একা থাকেন । বার্ধক্যজনিত কারণে স্বামী প্রয়াত। ছেলে আবদুস সোবাহান ঢাকায় কাজ করে। মাসে মাসে টাকা পাঠায় বাড়িতে। মা তাকিয়ে থাকেন ছেলে কবে টাকা পাঠাবে। তা দিয়ে চলবে সংসার। বাড়িতে টাকা পাঠাতে ছিল বিরাট ঝামেলা। সোবাহান অপেক্ষা করতেন কবে তার পাশের বাড়ির লোক ঢাকা থেকে এলাকায় যাবেন। তাদের কাছে দিতেন টাকা। কিন্তু এখন আর সেই সমস্যা নেই। শেফালি বেগম বলেন, মোবাইলে ছেলের খোঁজখবর পাই। কেমন আছে জানতে পারি। ছেলে টাকাও পাঠায় মোবাইলে। টাকার জন্য এখন আর দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হয় না। দেনাদারের কথাও শুনতে হয় না।

কলাতলীর চরে আরও কয়েকজন বয়োঃবৃদ্ধের সাক্ষাত মিলল। শাহাদাত হোসেন, মফিজ উদ্দিন, আলতাফ হোসেন, আবদুল লতিফসহ কয়েকজন জানালেন তারাও একইভাবে বাড়িতে বসেই দূরে থাকা স্বজনদের কাছ থেকে টাকা পান। শেষ বয়সে এসে সহজ জীবনে প্রবেশ করে এই বয়সী ব্যক্তিরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। তারা বলেন, মোবাইল-ইন্টারনেট জীবনের অনেক ঝামেলা কমিয়ে দিয়েছে।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২০ এপ্রিল ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়