ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

অন্তরে অন্দরে মোম ফুল

শাহনেওয়াজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:৩৯, ২০ জানুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অন্তরে অন্দরে মোম ফুল

মোম ফুল বা হয়া ফুল

খান মো. শাহনেওয়াজ : বাংলাদেশে জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে শখ ও সৌখিনতার বহর। বাড়িঘর সাজানোয় যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন ধরণের গাছ। রাজধানী ঢাকায় জায়গা স্বল্পতার কারণে মাটিতে গাছ লাগানোর সুযোগ নগরবাসীর হয় না। ফলে তারা গাছ রাখেন টবে, বাসার বাড়ান্দায় অথবা ছাদে। কিন্তু সবার জন্য ছাদে গাছ রাখার সুযোগও নেই। তারা অন্দরে রাখেন নানা ধরনের গাছ। ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে মানুষের অন্তরে ও বাড়ির অন্দরে সগৌরবে স্থান করে নিয়েছে মোম ফুল। এটি হয়া ফুল নামে সমধিক পরিচিত।

মোম ফুল অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক। এর গঠন ও গাঁথুনি খুবই জোড়ালো। এটি মুলত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ও পরাশ্রয়ী উদ্ভিদ লতা। বহুপত্রী ও পাতা হয় গাঢ় সবুজ। প্রতিকূল পরিবেশে লড়াই করে বেঁচে থাকতে সক্ষম এবং বহু বছর বেঁচে থাকে। ভাইন (Vine) অর্থাৎ দ্রাক্ষা লতা বা আঙুর লতা, সিম, তরমুজ, মটরশুটি গাছের মত ঝাঁকড়া আকার ধারণ করে না। অন্য গাছের ওপর নির্ভর করে লতিয়ে বেড়ে ওঠে তবে আশ্রয় গাছ থেকে খাদ্য গ্রহণ করে না। বাতাস, বৃষ্টির পানি ও ধুলোবালি থেকে খাবার গ্রহণ করে।

হয়া ফুল মুলত তারকা বা তারা (Star) আকৃতির হয়ে থাকে। প্রতিটি ফুলে মোমের মত পাঁচটি পুরু পাঁপড়ি থাকে। এর উপরে তারা আকৃতির আরও পাঁচটি পাঁপড়ি থাকে । ফুলে দেখা যায় নজর কাড়া রঙের বৈচিত্র্য। গাঢ় লাল, গোলাপী, হলুদ, কমলা, সাদা ও কালচে রঙের মিশ্রনে অপরূপ সুন্দর হয়ে ফোঁটে এই ফুল। হালকা ও মিষ্টি ঘ্রণযুক্ত এই ফুল প্রচুর পরিমাণে মধু তৈরি করে। রাজধানীর রমনা পার্কে, বলধা গার্ডেনে, বোটানিক্যাল গার্ডেনে এর বেশ কিছু প্রজাতি রয়েছে। ধানমণ্ডি, গুলশান, বনানি, বারিধারা, মিরপুর, উত্তরা এবং মহাখালি ডিওএইচএস এলাকায় অনেক আবাসিক ভবনের আঙিনায় এই গাছ ও ফুল দেখা যায়।

মোম ফুল বা হয়া (hoya) ফুল গাছ আসক্লেপিয়াড (Asclepiad) গণের অ্যাপোসাইন্যাসিয়া (Apocynaceae)  পরিবার ও আসক্লেপিয়াডোইডিয়া (Asclepiadoideae) উপ-পরিবার ভুক্ত। উদ্ভিদ বিজ্ঞানী রবার্ট ব্রাউন তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু উদ্ভিদ বিজ্ঞানি থমাস হয় (Thomas Hoy)- এর নাম অনুসারে এই গণের নাম রেখেছেন। এদেরকে মিল্কভিড পরিবারের (Milkweed family) গাছও বলা হয়। এদের দুশ থেকে তিনশ প্রজাতি রয়েছে। ইংরেজিতে এদেরকে ওয়াক্সফ্লাওয়ার (waxflower), ওয়াক্সপ্ল্যান্ট  (waxplant) ওয়াক্সভাইন (waxvine) নামেও ডাকা হয়।

হয়া ফুলের বেশির ভাগ প্রজাতির আদিবাস এশিয়া মহাদেশে। বিশেষ করে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, চীন,  ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনাম অঞ্চলের স্থানীয় গাছ এরা। ফিলিপাইনে হয়া ফুলের বিভিন্ন প্রজাতির অনেক বৈচিত্র্য (Diversity) পাওয়া গেছে। বিভিন্ন দেশে ও বিভিন্ন সংস্কৃতিতে বিশেষ করে পলিনেশিয় সংস্কৃতিতে হয়াকে ঔষধি গাছ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।

বৃক্ষপ্রেমী ও ফেসবুকে উদ্ভিদ চত্বর গ্রুপের সদস্য আসমা খাতুন গত বুধবার (১৮ জানুয়ারি, ২০১৭) এই গ্রুপে এক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, হয়া গাছ আদৃত হয় আকর্ষণীয় ফুলের জন্য ও ফুলের সুগন্ধির জন্য। অনেক কাল্টিভারকে হাউসপ্ল্যান্ট হিসেবে নির্বাচন করা হয় এদের পাতা, ফুলের সৌন্দর্য ও অসাধারণ সুন্দর রঙের কারণে। মিষ্টি ঘ্রাণের কারণেও হয়া ইনডোর প্ল্যান্ট হিসেবে লাগানো যায়। এরা উজ্জ্বল আলো পেতে পছন্দ করে কিন্তু অল্প আলোতেও বেঁচে থাকতে পারে। অল্প আলোতে এরা ফুল তৈরি নাও করতে পারে। হয়া নার্সারিতে বিক্রি হয় হাউসপ্ল্যান্ট হিসেবে। বিশেষ করে হয়া কার্নোসা (H. carnosa), হয়া পারপারিয়া-ফুসকা (H. purpurea-fusca), হয়া কেরি (H. kerrii) প্রজাতির গাছ। হয়া সহজেই বংশবিস্তার করতে পারে। কাটিং ও গ্রাফটিং এর মাধ্যমে এর বংশবিস্তার করা যায়। নার্সারিতে সাধারণত কাটিং চারাই বেশি বিক্রি হয়।

হয়া ফুল সাধারণত একটি পুষ্প বৃন্তের মাথায় গুচ্ছাকার (Umbellate cluster) বা থোকা হয়ে ফুটে থাকে। আম্বেল অর্থাৎ অনেকগুলো ছোট ফুলের বোঁটা যখন একত্রে একটি অভিন্ন (Common) বোঁটার সাথে যুক্ত থাকে তখন তাকে পেডিসেল (Pedicel) বলে। দেখতে অনেকটা ছাতার শলাকা খাঁচার (Umbrella ribs) মত মনে হয়। ফুলের দণ্ডগুলো সাধারণত পাতার বৃন্ত বা বোঁটার কোনা থেকে বের হয় এবং বেশির ভাগ প্রজাতিতে এই দণ্ডগুলো অনেক বছর ধরে বেঁচে থাকে। বার বার ফুল হওয়াতে ফুলের দণ্ডগুলো বড় হতে থাকে। ফুলের থোকার ব্যাস ৩ মিলিমিটার থেকে ৯৫ মিলিমিটার পর্যন্ত হতে পারে।

এদের পরাগায়ন সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য নেই। তবে পোকামাকড় দ্বারা পরাগায়ন ঘটে বলে মনে করা হয়। যে গাছগুলো পর্যাপ্ত সূর্যের আলো পায়, সেগুলোতে বীজ হয়। বীজ বেশ হালকা এবং বাতাসে ভেসে ভেসে দূর দূরান্তে গিয়ে বংশবিস্তার করতে পারে। বীজ থেকে অঙ্কুরোদগম বেশ তাড়াতাড়ি হয় কিন্তু চারা সহজে বাঁচে না।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এক গবেষণায় দেখা গেছে, হয়া কারনোসা (Hoya carnosa) প্রজাতির গাছ খুবই ভালোভাবে বাড়ির অন্দরের বায়ুদুষণ দূর করতে পারে।

বৃক্ষপ্রেমী ও শখের বাগানী সানজিদা শাহনাজ বলেন, ‘হয়া ফুলের বিন্যাস দেখে মনে হয় রমনী মাথার চুলে খোপা করেছেন, সেই খোপায় ক্লিপ দিয়ে বসিয়ে রাখা আছে অনেকগুলো তারার ফুল। বসন্তে ও বর্ষায় ফুলের সুবাস ছড়িয়ে পড়ে। এর সৌন্দর্যের কোন জুড়ি নেই।’

রাজধানীর লালমাটিয়া এলাকার বাসিন্দা ও বৃক্ষপ্রেমী গৃহবধু ফেরদৌসী মহল বলেন, ‘মোম ফুল বা হয়া ফুলের রঙ ও মিষ্টি ঘ্রাণ মনোমুগ্ধকর। গাছে এর উপস্থাপনা অত্যন্ত সুন্দর। মোম ফুল প্রকৃতির অপরূপ সৃষ্টি ।’

রাজধানীর গুলশানে বৃক্ষপ্রেমী ইয়াসমিন মায়মুনের বাসভবনে আছে হয়া ফুল। তিনি বলেন, ‘ফুলের সুবাস এতই সুন্দর যে, সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর মনে হয় এই সুবাস আমার ঘরের দরজার কাছে কেউ বুঝি ছড়িয়ে দিয়ে গেলো।’



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২০ জানুয়ারি ২০১৭/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়