ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

অবকাঠামো বাড়লেও ভোগান্তি কমেনি বিচারপ্রার্থীদের

মামুন খান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৩৩, ২৫ জুন ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অবকাঠামো বাড়লেও ভোগান্তি কমেনি বিচারপ্রার্থীদের

মামুন খান : সপ্তাহের কর্ম দিবসগুলোতে মানুষের মিলন মেলায় পরিণত হয় পুরান ঢাকার নি¤œ আদালত চত্ত্বর। কারাগার থেকে যে সব আসামিকে আদালতে হাজির করা হয় তাদের আত্মীয়-স্বজন ভিড় করেন। পাশাপাশি নতুন আসামি যারা জামিন নিতে আসেন তাদের সঙ্গেও থাকেন অনেক মানুষ। এ মানুষের ভিড়ে আদালত প্রাঙ্গণ থাকে জমজমাট।

কিন্তু আদালত প্রাঙ্গণে মানুষদের বসার ও নিরাপত্তার তেমন কোন ব্যবস্থা নেই। নেই টয়লেটের ব্যবস্থা। পুরো আদালত প্রাঙ্গণে জটলা বেঁধে এই মানুষরা অবস্থান করেন। এতে আদালতের স্বাভাবিক কার্যক্রমও মাঝে মধ্যে বিঘিœত হয়। এরমধ্যে বাড়তি ঝামেলা হলো দালালদের উৎপাত। আসামিদের আনা নেয়ার ক্ষেত্রেও পুলিশকে বেগ পেতে হয়। অনেক সময় আসামি এবং দর্শণার্থীদের চিৎকার, চেঁচামেচিতে বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।

সবকিছু মিলিয়ে নানা সমস্যায় জর্জরিত পুরান ঢাকার নিম্ন আদালত প্রাঙ্গণ। বিচারক, এজলাস ও চেম্বার সংকটের পাশাপাশি রয়েছে দেওয়ানি আদালতেরও স্বল্পতা। এ স্বল্পতার কারণে বিচার কার্যক্রমে দেখা দিয়েছে স্থবিরতা। কোন কোন মামলা বছরের পর বছর পড়ে আছে। প্রতিদিন যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন মামলা। নির্ধারিত সময়ে এসব মামলার কার্যক্রম শেষ না হওয়ায় সৃষ্টি হয়েছে মামলা জট। হাজার হাজার মামলার চাপে কাহিল সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এসব মামলা কবে শেষ হবে তা বলতে পারছেন না কেউ। একদিকে মামলার জট অন্যদিকে এজলাসের স্বল্পতার কারণে অনেক নিরাপরাধ মানুষও কারাগারে বন্দি রয়েছে।

এদিকে মামলার নথিপত্র সংরক্ষণে রেকর্ড রুমের অভাব এবং বিচারক-কর্মচারিদের বাসস্থানের অভাবসহ বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে এখানকার শতাধিক আদালতে। এখানে আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীদের জন্য নেই পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা, নেই পর্যপ্ত লিফট ও টয়লেটের সুবিধা। এমনকি আদালতের ভেতর যেসব টয়লেট রয়েছেÑ তার অধিকাংশই ব্যবহারের জন্য বিচারপ্রার্থী ও আইনজীবীদের টাকা খরচ করতে হয়। নারী ও শিশু বিচারপ্রার্থীদের জন্য রেবতী ম্যানশনে বিশ্রামাগার থাকলেও সেখানে তেমন লোকজন যান না। বিশেষ করে আদালতের অভ্যন্তরীণ সড়কগুলোয় যানবাহনের পর্যাপ্ত পার্কিং ব্যবস্থা না থাকায় বিচারপ্রার্থীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। বিচারপ্রার্থীরা লিগ্যাল এইডসহ বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য সুবিধা পেতে পারেন এমন ‘ওয়ান স্টপ ইনফরমেশন ডেস্কও’ নেই এখানে। এছাড়া আদালত প্রাঙ্গণ অরক্ষিত থাকায় দিনে এখানে ফেরিওয়ালাদের মেলা বসে। আর রাতে রয়েছে ভবঘুরে ও মাদকসেবীদের দৌরাত্ম। সম্প্রতি আদালতে চুরির ঘটনাও ঘটেছে। আদালতের ভেতর চুরির এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন আইনজীবীরা।

এদিকে আদালতের অবকাঠামোগত সুবিধা বাড়লেও ভোগান্তি কমেনি বিচারপ্রার্থীদের। দিন দিন মামলা বৃদ্ধির পাশাপাশি বিচারপ্রার্থীর সংখ্যাও বাড়ছে। একই সঙ্গে বাড়ছে মামলার জট। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে মামলার সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও বর্তমানে সারা দেশের মামলার সংখ্যার তুলনায় বিচারকের সংখ্যা অপর্যাপ্ত।

ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর মো. আব্দুল্লাহ আবু বলেন, ‘পুরান ঢাকার নি¤œ আদালতে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা রয়েছে। বিশেষ করে আমাদের আদালতের নিরাপত্তার বিষয়ে নজর দিতে হবে। আদালত চত্বরে নানা ধরনের ফেরিওয়ালা দিনভর আনাগোনা করতে থাকে। তারা নানা ধরণের পণ্যের মেলা বসিয়ে এখানে বিক্রি করে। শসা, গাজর, পেঁপে বিক্রেতা ও পান-বিড়ি-সিগারেটের ভ্রাম্যমাণ দোকানিরা প্রায়ই আদালত প্রাঙ্গণে প্রবেশ করে এসব বিক্রি করে। বিচারপ্রার্থী লোকজন ছাড়াও বহু বহিরাগত লোকজনের আনাগোনা রয়েছে আদালত প্রাঙ্গণে। এসব কারণে আদালতের নিরাপত্তায় বিঘœ ঘটে। এ এলাকায় বিচারসংশ্লিষ্ট লোকজন ছাড়া বহিরাগতদের প্রবেশে বাধা-নিষেধ আরোপ করতে হবে। উন্নত দেশের মত আমাদেরও আদালত প্রাঙ্গণকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘আদালতে আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীদের গাড়ি রাখার পর্যাপ্ত সুযোগ নেই। আদালতের অভ্যন্তরীণ রাস্তাগুলোয় অধিকাংশই পার্শ্ববর্তী ব্যবসায়ীরা তাদের গাড়ি রেখে থাকেন। সব মিলিয়ে আদালতের সার্বিক নিরাপত্তার স্বার্থে বিচারক, আইনজীবী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও তৎপর হতে হবে।’

ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান খান রচি বলেন, ‘আদালত প্রাঙ্গণে যাতে বহিরাগতরা (আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থী ছাড়া) প্রবেশ করতে না পারে সে বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও সচেতন থাকতে হবে। এছাড়া আদালত প্রাঙ্গণ ঝাড়– দেওয়ার জন্য সরকারি একজন ঝাড়–দার পর্যন্ত নেই। বাইরে থেকে লোকের ব্যবস্থা করে এখানে ঝাড়– দেওয়া হয়। মোট কথায় আদালত পাড়ার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সকলের দায়িত্ব। সকলকেই এ ব্যাপারে আরও উদ্যোগী হতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘এজলাস সংকট ও বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি দূর করতে ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ভবন নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। ওই ভবনে রয়েছে আধুনিক সুবিধা। এ ভবনে বিচারকাজ চালু হলে পুরাতন টিনসেড ভবনটি ভেঙে ফেলা হবে। এতে করে কিছু গাড়ি পার্কিংয়ের স্থানও হবে।

এজলাস ভাগাভাগির বিষয়ে বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনালের স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম শামীম বলেন, ‘প্রতিদিনই নতুন নতুন মামলা আসছে। একটি এজলাস ভাগাভাগি করে বিচারকাজ চালাতে আমাদের চেয়ে বিশেষ জজ আদালত-৪ এর সমস্যা বেশি হয়। কোনো কোর্টই শান্তিপূর্ণভাবে মামলার বিচারকাজ করতে পারে না। সব মিলিয়ে এ ট্রাইব্যুনালের নিজস্ব এজলাস না থাকায় বিচারক, রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী, মামলার সাক্ষী ও আসামি সবাই ভুক্তভোগী।

এজলাস ও চেম্বার সংকট : সরেজমিনে দেখা যায়, পুরান ঢাকার অর্থঋণ আদালত নং-৪ এবং পারিবারিক দুটি আদালতের উপযুক্ত কোনো এজলাস ও চেম্বার নেই। ঢাকা জেলা জজ আদালত ভবনের নিচতলায় গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গায় অস্থায়ীভাবে চলছে দুটি পারিবারিক আদালতের এজলাস ও চেম্বারের বিচার কাজ। অর্থঋণ আদালত নং-১ এর সেরেস্তা জায়গা সংকটের কারণে ভিন্ন ভবনে রাখা হয়েছে। এছাড়া ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের ৬ তলায় অবস্থিত বিশেষ জজ আদালত-৪ এর বিচারকক্ষ ভাগাভাগি করে চলছে সাইবার ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম। সকালে চলে বিশেষ জজ আদালত-৪ এর বিচারিক কাজ। দুপুরের পর একই এজলাসে চলে সাইবার ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম। এর আগে বিশেষ জজ আদালত-৪ এর বিচারকক্ষ ভাগাভাগি করে চলতো সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারকাজ। এছাড়া রেবতী ম্যানশনের তৃতীয় তলায় সকালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭-এর কার্যক্রম শেষে দুপুরের পর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১-এর কার্যক্রম শুরু হয়। জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পুরনো ভবনের পঞ্চম তলায় সকালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২ এর কার্যক্রম শেষে দুপুরে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৮ এর কার্যক্রম শুরু হয়। একই ভবনের পঞ্চম তলায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৩ এর কার্যক্রম শেষে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৫ এর কার্যক্রম শুরু হয়। এছাড়া ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পঞ্চম তলায় যেখানে আগে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৫ এর এজলাস ছিল, সেখানে বর্তমানে সকালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৬ এবং দুপুরের পর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৯ এর বিচার কার্যক্রম পরিচালিত হয়।

অরক্ষিত আদালত প্রাঙ্গণ : আদালত প্রাঙ্গণে আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থী ছাড়াও বহিরাগত লোকজনের আনাগোনা রয়েছে। অনেকেই দালালদের খপ্পরে পড়ে নিঃস্ব হচ্ছেন। অনেক সময় আদালত প্রাঙ্গণে স্কুল-কলেজের ড্রেস পড়–য়া ছাত্র-ছাত্রীদেরও আড্ডা দিতে দেখা যায়। আদালতের চারিদিকে নিরাপত্তা আরও জোরদারের দাবি জানিয়েছেন আইনজীবীরা।

দিনে ফেরিওয়ালা ও রাতে মাদকসেবীদের দৌরাত্ম : পুরান ঢাকার নি¤œ আদালত প্রাঙ্গণে বিভিন্ন ভবনের সামনে নানা পণ্যের পসরা নিয়ে বসেন হকাররা। কেউ বিক্রি করছেন ডাব, কেউা শসা, গাজর, পেপে, চা, সিগারেট, ছোলা-মুড়ি। এমনকি অনেক সময় কাপড় ব্যবসায়ীদেরও আদালত প্রাঙ্গণে শার্ট-প্যান্ট বিক্রি করতে দেখা যায়। এছাড়া আদালতের বারান্দায় ও ভেতরে অনেক সময়ই দেখা মেলে ভ্রাম্যমাণ চা-সিগারেট বিক্রেতা ও বাদাম বিক্রেতাদের। আর রাত হলে এ আদালত প্রাঙ্গণে মাদকসেবীদের দৌরাত্ম শুরু হয়। শুধু রাতেই নয়, দিনের বেলায়ও কিছু মাদকসেবীর আনাগোনা চলে এ প্রাঙ্গণে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকজনের সামনেই তারা চলাচল করে। অনেক সময় ধারালো চাকু কিংবা নোংরা আবর্জনা হাতে নিয়ে বিচারপ্রার্থীদের জিম্মি করে তাদের টাকা-পয়সা হাতিয়ে নিতে দেখা যায়।

আদালতে চুরির ঘটনায় উদ্বিগ্ন আইনজীবীরা : সম্প্রতি পুরান ঢাকার নি¤œ আদালতে চুরির ঘটনা ঘটেছে। আদালত সূত্র জানায়, ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের ৬ষ্ঠ তলায় অবস্থিত বিশেষ জজ আদালত-৩ ও বিশেষ জজ আদালত-৪ এ চুরির ঘটনা ঘটে। তবে কোনো নথিপত্র বা গুরুত্বপূর্ণ কিছু খোঁয়া না যায়নি। আদালত কক্ষের জানালার কাঁচ চুরি হয়েছে। একটি সূত্র জানায়, গভীর রাতে একজন মাদকসেবী এই চুরি করেছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। অবশ্য কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিকভাবে জানালার কাঁচ পুনরায় লাগিয়েছে।

অবকাঠামোগত সুবিধা বাড়ছে : ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিচার বিভাগের জন্য অবকাঠামো তৈরির বিশেষ উদ্যোগ নেন। ওই উদ্যোগের অংশ হিসেবে ৬৪টি জেলা সদরে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ভবন নির্মাণ প্রকল্প নেয়া হয়। এই প্রকল্পের আওতায় ৪টি জেলায় সম্পূর্ণ ভবন নির্মাণ শেষে বিচার কার্যক্রম চলছে। ৪টি জেলায় ভবনের কাজ প্রায় সম্পন্ন ও ব্যবহার উপযোগী। ১৬ জেলায় গত ডিসেম্বরের মধ্যে ভবন নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। ১০টি জেলায় চলতি বছরের জুনের মধ্যে নির্মাণ কাজ শেষ হবে। নতুন অন্তর্ভুক্ত ৮টি জেলার মধ্যে ৬টিতে ভবন নির্মাণ কাজ চলছে। এছাড়া ২২টি জেলায় আদালত ভবন নির্মাণের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। শুধু সিজেএম আদালত ভবন নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণই নয়, ২৮টি জেলায় আনুষঙ্গিক সুবিধাসহ জেলা জজ আদালত ভবনের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ প্রকল্প নেয়া হয়েছে। এজলাস সংকট ও বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি দূর করতে ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ভবন নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। ওই ভবনে সার্বক্ষণিক জেনারেটর সুবিধাসহ ৪টি লিফট রয়েছে। রয়েছে পর্যাপ্ত টয়লেটের ব্যবস্থাও। প্রতিবন্ধীদের জন্যও বিশেষ সুবিধা রাখা হয়েছে। রয়েছে পুরুষ ও নারী আসামিদের জন্য আধুনিক সুবিধা সম্বলিত পৃথক হাজতখানা।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ জুন ২০১৯/মামুন খান/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়