ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

অভিনয়ের অপর পিঠে গানের মানুষ

শাহনেওয়াজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:৪৪, ২৪ জুলাই ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অভিনয়ের অপর পিঠে গানের মানুষ

নাজমুল হুদা বাচ্চু

খান মো. শাহনেওয়াজ : অভিনয় শিল্পী নাজমুল হুদা বাচ্চু সবার কাছে পরিচিত চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন অভিনেতা হিসেবে। তিনি অনেক ছায়াছবিতে এবং টেলিভিশন নাটকে অভিনয় করেছেন। তার বিচরণ যেমন ছিলো বড় পর্দায় তেমনি ছিলো ছোট পর্দায়।

রূপালি জগতের এই মানুষটি ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী, অমায়িক ও বন্ধুবৎসল। সহযোগিতা করার মানসিকতা তার মধ্যে ছিলো প্রবল। সিনেমা ও টেলিভিশনের জগতে শিল্পী ও কলাকুশলীদের অনেকেই তার হাত ধরে এসেছেন। অভিনয় ছিলো তার প্রাণ। একজন সফল অভিনয় শিল্পী হিসেবে তিনি অত্যন্ত পরিচিত একটি মুখ।

কিন্তু এই অভিনয় শিল্পী পরিচয়ের বাইরেও তার আলাদা একটা পরিচয় আছে। খুব বেশি মানুষ তার সেই পরিচয় পাননি। তিনি নিজেও এই পরিচয় প্রকাশ করার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন না। তিনি মনেপ্রাণে ছিলেন একজন অভিনয় শিল্পী আর অভিনেতা পরিচয় নিয়েই থেকেছেন।

এই অভিনেতা পরিচয়ের বাইরে তার সেই আলাদা পরিচয় হচ্ছে, তিনি একজন গুণী কণ্ঠশিল্পী। গাইতেন সব ধরনের গান। এটি ছিলো তার অন্যতম একটা শখ। ষাটের দশকে তিনি ছায়াছবিতে গানে নেপথ্য কণ্ঠ দিয়েছেন। একক কণ্ঠ যেমন দিয়েছেন তেমনি দ্বৈত কণ্ঠের গানেও কণ্ঠ দিয়েছেন। তার গাওয়া সিনেমার গান সে সময় জনপ্রিয়তাও পেয়েছে। তিনি গেয়েছেন টেলিভিশন অনুষ্ঠানেও। তবে সিনেমা-টেলিভিশনে তার গানের সংখ্যা খুব বেশি নয়। গানের ব্যাপারে তিনি ছিলেন প্রচার বিমুখ। সব ধরনের গান গাইলেও তার বেশ দখল ছিলো কবি কাজী নজরুল ইসলামের গানে। পল্লীগীতি, ভাওয়াইয়া, শ্যামা সংগীত, অতুল প্রসাদী, কীর্তন (নাম ও পদাবলী) এমনকি উচ্চাঙ্গ সংগীতেও ছিল ভালো দখল।

তার সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৮০- এর দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশন ভবনে, স্টুডিওতে। নাটক রেকর্ড করা হবে, তার আগে মহড়া চলছিলো সেখানে। সালটা ঠিক মনে নেই। নাটকের নাম ‘টাকায় কি না হয়।’ নায়কের চরিত্রে ছিলেন চিত্রনায়ক বুলবুল আহমেদ, নায়িকা চরিত্রে ছিলেন অভিনয় শিল্পী চম্পা। তখনও চম্পা সিনেমায় অভিনয় শুরু করেননি। নাজমুল হুদা বাচ্চু এই নাটকে নায়কের মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপকের চরিত্রে অভিনয় করেছেন। নাটকটি টেলিভিশনে সম্প্রচার হওয়ার পর ব্যাপক প্রশংসা পায়। 

সেদিন আমি বিটিভি ভবনে গিয়েছিলাম টেলিভিশনের তৎকালীন চিফ ডিজাইনার এস এ কিউ মঈনুদ্দিনের (মনি) কাছে। তখন তিনি স্টুডিওতে নাটকের সেট তৈরির নির্দেশনায় ব্যস্ত ছিলেন। স্টুডিওর একপাশে সেট তৈরি হচ্ছে আরেক পাশে নাটকের মহড়া চলছে। এসএকিউ মঈনুদ্দিন ব্যস্ততার মাঝেই আমায় নিয়ে গিয়ে নাজমুল হুদা বাচ্চুর পাশে একটা চেয়ারে বসালেন। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই সেটের কাজ শেষ হয়ে যাবে জানিয়ে আমায় অপেক্ষা করতে বললেন। আমি একেবারে পাশে বসে কাছে থেকে দেখলাম রূপালি পর্দার মানুষ নাজমুল হুদা বাচ্চুকে। এক পর্যায়ে কথা বলা শুরু করলেন তিনিই এবং আলাপের অল্প সময়ের মধ্যেই হয়ে গেলেন বাচ্চু ভাই।

এরপর তার সঙ্গে বিটিভি ভবনেই দেখা হয়েছে আরো তিনবার। তিনি ছিলেন ব্যস্ত অভিনেতা। কিন্তু দেখা হওয়া মাত্র কুশল জিজ্ঞাসা করেছেন, যতটুকু সম্ভব সময় দিয়েছেন। আর আমি অভিভুত হয়েছি।

১৯৯৩ সালের সেপ্টেম্বর বা অক্টোবর মাসে সাপ্তাহিক মনোরমা থেকে ফরমায়েশ পেলাম নাজমুল হুদা বাচ্চু ভাইকে নিয়ে একটা ফিচার করার জন্য। যোগাযোগ করার পর তিনি আমায় দিনক্ষণ জানিয়ে রাজধানীর মগবাজারে শ্রুতি রেকর্ডিং স্টুডিওতে যেতে বললেন। শ্রুতি স্টুডিওতে মূলত গান রেকর্ড করা হতো। নির্ধারিত সময়ে গিয়ে দেখি সেখানে অন্যান্যের মধ্যে চিত্রনায়ক, চলচ্চিত্র পরিচালক ও সঙ্গীতজন খান আতাউর রহমান, কণ্ঠশিল্পী নিলুফার ইয়াসমিন, ওস্তাদ ফজলুল হক, গীতিকার নজরুল ইসলাম বাবু, কণ্ঠশিল্পী ও সংগীত শিক্ষক শহীদুল ইসলাম আছেন। নাজমুল হুদা বাচ্চু ভাই এবং কয়েকজন যন্ত্রশিল্পীও আছেন।

বাচ্চু ভাই আমাকে বললেন, এখান থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় কথা বলবেন এবং আমার তাড়া নেই জেনে আশ্বস্ত হলেন। সেদিন গানের রেকর্ডিং হয়নি তবে গান হয়েছে। যারা গেয়েছেন প্রত্যেকেই চার পাঁচটি করে গান করেছেন। আমার অবাক হওয়ার পালা যখন দেখলাম সকলেই নাজমুল হুদা বাচ্চু ভাইকে গান গাওয়ার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছেন। তিনি হারমোনিয়াম টেনে নিলেন এবং গান ধরলেন। পরিশীলিত কণ্ঠ। গাইলেন নজরুল সংগীত, একে একে তিনটি। নিলুফার ইয়াসমিনের অনুরোধে কীর্তন গাইলেন একটি। ওস্তাদ ফজলুল হক ফরমায়েশ করলেন ধ্রুপদী পরিবেশনের জন্য। নাজমুল হুদা ভাই ধরলেন রাগ কাফি, ছোট খেয়াল, দ্রুত লয়, তিনতাল। এর বন্দেশ- আজি খেলো শ্যাম সঙ্গ হরি / পিচকারি রঙ ভরি কেশরকি ।। কুমার কানহাইয়া সঙ্গ সখি রাধা / রঙ ভরি জড়ি সোহতরী ।। আজি খেলো শ্যাম সঙ্গ হরি …।

গানের মানুষদের বেশিরভাগের কাছেই কাফি রাগে খেয়ালের এই বন্দেশটি পরিচিত। নাজমুল হুদা বাচ্চু ভাই একজন বহমান উচ্চাঙ্গ সংগীত শিল্পীর মতই শুদ্ধভাবে পরিবেশন শুরু করলেন। আরোহন-অবরোহন, পকড়, আলাপ পেশ করে চলে গেলেন গায়নে। স্বর সংগতি, স্বর গাঁথুনি, স্বর প্রকার ও চলনে শুদ্ধ ছাপ রেখে স্পষ্ট আলগে নামিয়ে নিলেন খেয়াল। সুর আবহ লেগে থাকলো সকলের কানে ও মনে।

তিনি ছিলেন অত্যন্ত গুণী কণ্ঠশিল্পী। বিটিভিতে আয়োজিত হাসির গানের অনুষ্ঠানে তিনি পরিবেশন করেছেন কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা রসের গান- আজকা হইবো মোর বিয়া, কালকা আইমু বউ লইয়া, থাকবা তোমরা ফ্যালফ্যালাইয়া বুঝলা গোকলা মাকুন্দা, তাইরে নাইরে নাইরে না …।

অভিনেতা ও কণ্ঠশিল্পী নাজমুল হুদা বাচ্চু ভাই চলে গেছেন চিরদিনের জন্য। ২৮ জুন ২০১৭ তারিখ ভোরে তিনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আমাদের ছেড়ে চলে যান। তার বয়স হয়েছিলো ৭৮ বছর। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার দুদিন আগেও তিনি শুটিং করেছেন।

অভিনয়ে তিনি জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। কিন্তু কণ্ঠসংগীতেও কম যাননি। খানিক ব্যতিক্রমী কণ্ঠের অধিকারী ছিলেন। নিজস্ব গায়কিতে শ্রোতাকে ধরে রাখতে পারতেন। তার গান যারা শুনেছেন তারা বিস্মিত না হয়ে পারেন নি, প্রশংসা না করে পারেন নি। অভিনয়ের জন্য তো বটেই, সংগীতের জন্যও তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
 


১৯৬৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘জিনা ভি মুশকিল’ নামের ঊর্দু ছায়াছবিতে নাজমুল হুদা বাচ্চুর গাওয়া গান।





লেখক : সাংবাদিক।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ জুলাই ২০১৭/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়