ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

উপকূলের পথে

আন্ডারচরের দুঃখ ঘোচেনি!

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১২, ২৬ আগস্ট ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আন্ডারচরের দুঃখ ঘোচেনি!

রফিকুল ইসলাম মন্টু: আন্ডারচরের দুঃখ ঘোচেনি। জলবায়ু পরিবর্তন ফান্ডের অর্থে বাঁধ দেওয়া হয়েছিল চরের চারদিকে। নির্মাণের পরেই জোয়ারের প্রবল তোড়ে ভেসে গেছে বাঁধের অর্ধেক। এখন সব এলোমেলো। জনজীবন বিপন্ন বিপর্যস্ত। জোয়ারে পানি ঢুকলে আর বের হতে পারে না। ফলে দুর্ভোগ বেড়েছে। বাঁধ নির্মাণের আগে ভালো ছিলেন, নাকি এখন ভালো আছেন? চরের মানুষের কাছে এমন প্রশ্ন রাখলে তারা নিঃসংশয়ে জবাব দিতে পারেন না। তবে অনেকেরই অভিমত, বাঁধ হওয়ার আগেই তারা ভালো ছিলেন। তখন জোয়ারের পানি উঠলেও নেমে যেত। 

আন্ডারচরের অবস্থান পটুয়াখালী জেলার রাঙ্গাবালী উপজেলার দ্বীপ ইউনিয়ন চরমোন্তাজের একেবারে ‘আন্ডার’-এ। সমুদ্রলাগোয়া চর বলে সেকালে বিদেশি সাহেবেরা এ চরের নাম দিয়েছে ‘আন্ডারচর। চরের নামকরণ সম্পর্কে আরও দু’টি মতভেদ আছে। অনেকে বলেন, চরটি ডিম্বাকৃতির বলে এমন নামকরণ। আবার কারও মতে এক সময় এখানে প্রচুর পরিমাণে পাখির ডিম পাওয়া যেতো। ডিমের আঞ্চলিক শব্দ ‘আন্ডা’ থেকে আন্ডারচর। তবে যেভাবে নামকরণ হোক না কেন, এখানকার বাসিন্দাদের বেঁচে থাকার লড়াইটাই এখানে সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।

ভয়াল এক নদী আন্ডারচরকে আলাদা করেছে চরমোন্তাজ থেকে। স্থানীয় বয়সী ব্যক্তিদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ২০০ বছরের পুরনো এ চরে প্রায় তিন হাজার মানুষের বাস। এটি চরমোন্তাজ ইউনিয়নের একটি ওয়ার্ড। নদী-সমুদ্রে খেটে খাওয়া সব বিপন্ন মানুষদের বাস এখানে। সমুদ্র থেকে আসা ঝড়-জলোচ্ছ্বাস এদের জীবন বারবার ওলটপালট করে দেয়। তবুও এদের নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা হয়নি। দুর্যোগের সময়ে আশ্রয় নেয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই এখানকার মানুষদের। মাত্র দু’টি আশ্রয়কেন্দ্র থাকলেও একটি রয়েছে ঝুঁকিতে। চরমোন্তাজের খেয়াঘাট থেকে ছোট্ট নৌকায় ভয়াল নদী পেরিয়ে আন্ডারচর ঘাটে উঠে বোঝার উপায় নেই, এখানকার মানুষগুলো কতটা ঝুঁকিতে আছে। চরের উত্তর ও পশ্চিমে দাঁড়িয়ে আছে বেড়িবাঁধ। দু’ধারে সারিবদ্ধ বাবলা গাছ। দক্ষিণ থেকে আসা প্রবল বাতাস গাছের শাখায় লেগে শো শো আওয়াজ সৃষ্টি করেছে। বাঁধের আশপাশে উঠেছে ছড়ানো ছিটানো বাড়িঘর। কাজের প্রয়োজনে কিংবা জমিজমা হারিয়ে নিঃস্ব মানুষেরা ফাঁকা চরে এসে ঠাঁই নিয়েছেন। ফসলহীন খোলা মাঠে গরু-মহিষ চড়ায় রাখাল বালকের দল। এসব দৃশ্য দেখে মনে হবে আন্ডারচরে তেমন কোনো সমস্যাই নেই। কিন্তু সমস্যা দেখতে যেতে হবে চরের দক্ষিণপ্রান্তে। আর বর্ষায় সবখানেই থাকে সমস্যার ক্ষতচিহ্ন।

আন্ডারচরের সর্বদক্ষিণে সাগরপাড় বাজারে আলাপ বাসিন্দাদের সঙ্গে। ‘কেমন আছেন?’- জিজ্ঞেস করতেই সবার এক জবাব- ‘ভালো নেই। আমাগো লাই বাঁধ অইছিলো। বালির বাঁধ পানিতে ভাইস্যা গ্যাছে। এহন পানি ওঠে, আর নামতে পারে না।’ বাসিন্দারা জানালেন, চরের একাংশে বাঁধ না থাকায় গোটা চরেই জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। এসময় অনেকে ঘরের বাইরে বের হতে পারেন না। অনেকে আবার বাইরে থেকে ঘরে যেতে পারে না।’  আবুল কাশেম খা, বয়স ৬৫। সাগরপাড় বাজার জামে মসজিদের মোয়াজ্জিন। বললেন, বর্ষাকালের তিনমাস আমরা সবচেয়ে বেশি সমস্যায় থাকি। পানিতে গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি পর্যন্ত ভেসে যায়। ঘরের ভিটির ওপর দিয়ে পানির স্রোত বয়ে যায়। একটু ভালো থাকার জন্য প্রায় ৪৫ বছর আগে বরিশালের বাকেরগঞ্জ থেকে এখানে এসে ঘর বেঁধেছিলাম। কিন্তু ভালো নেই। সমুদ্রের ঝড়-ঝাপটা সবার আগে আমাদের ওপর লাগে। একটু বড় বাতাস কিংবা একটু বড় জোয়ার এখানকার মানুষদের ব্যাপক ক্ষতি করে।
 


আরেকজন মজিবর প্যাদা, বয়স ৩৩। সাগরপাড় বাজারে ক্ষুদ্র ব্যবসায় জীবন চলে। বাজারের পশ্চিম পাশে থাকার ছোট্ট বসতি। বললেন, জোয়ারের পানি এলে এখানে আর বসবাসের সুযোগ থাকে না। ফসলি মাঠ, রাস্তাঘাট, বাড়িঘর সব ডুবে যায়। পুকুরের মাছ ভেসে যায়। ঘূর্ণিঝড়ের পুর্বাভাস দেওয়া হলেও আমরা বাড়ি থেকে বের হয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে পারি না। কারণ রাস্তাঘাট পানিতে ডুবে থাকে। পাশে থাকা আরেকজন বেলাল প্যাদা, বয়স ৪২। মজিবরের কথার সূত্র ধরে বলেন, বেড়িবাঁধই পানিতে তলিয়ে যায়। তখন আমরা কোথায় যাই। ছেলেমেয়েরা স্কুলে যেতে পারে না। খাওয়া, ব্যবসা-বাণিজ্য এমনকি টয়লেটে যেতেও সমস্যা দেখা দেয়। সূত্র বলছে, আন্ডারচরের জনজীবনের নিরাপত্তা, কৃষি উৎপাদন বাড়ানোসহ জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় জলবায়ু ফান্ডে ২০১১ সালে এখানে প্রথমবারের মত বেড়িবাঁধ নির্মিত হয়। নির্মাণের এক বছরের ব্যবধানে আন্ডারচরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পূর্ব ও দক্ষিণের বাঁধ ধ্বসে গেছে। উত্তর ও পশ্চিম অংশের বাঁধ মোটামুটি ছিল। তবে স্লুইজগেটগুলোর অবস্থা নাজুক। সেগুলোর অবস্থা এখনও একই। অন্যদিকে বাঁধের এক প্রান্তে বাগানের সাইনবোর্ড থাকলেও কোন গাছের চারা চোখে পড়েনি। এখন কিছু গাছ লাগানো হয়েছে। বাসিন্দারা জানালেন, দু’দিকে বেড়িবাঁধ থেকে তো কোন লাভ নেই। কারণ অপর দু’দিক থেকে যে পানি উঠছে, তাতেই তলিয়ে যাচ্ছে গোটা চর।

বাসিন্দারা আরো জানান, আন্ডারচরের চারদিক ঘুরে বেড়িবাঁধ রয়েছে ১১ কিলোমিটার। এরমধ্যে ৪ কিলোমিটারের বাঁধ জোয়ারের পানিতে ভেসে গেছে। এই অংশে  স্লুইজগেট ছিল ৫টি। সেগুলোও ধ্বসে গেছে। স্লুইজ গেট দিয়ে আর পানি ওঠার প্রয়োজন নেই। বাঁধের ওপর দিয়ে চরের ভেতরে পানি আসতে পারে। অনেকে বলেছেন, বেড়িবাঁধ হওয়ার আগেই ভালো ছিল। কারণ, তখন পানি উঠলে তা আবার ভাটার সময় নেমে যেত। এখন জোয়ারে পানি উঠে আর নামতে পারে না। এরফলে দেখা দেয় জলাবদ্ধতা। ২০০৭ সালে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় সিডরে পানিতে ডুবেছিল গোটা চর। কিন্তু ভাটায় পানি নেমে গেছে। এখন আর পানি নামতে পারছে না। সাগরপাড় বাজারের পূর্বপ্রান্ত ঘেঁসে বেড়িবাঁধ মাটির সঙ্গেই মিশে গেছে। বাঁধ নির্মাণের স্থানগুলোতে সামান্য উঁচু ভিটের মত আছে। নিচু স্থানগুলো দিয়ে স্বাভাবিক জোয়ারেই পানি ঢুকে পড়ে। এই বিধ্বস্ত বাঁধের পাশেই আবার নতুন আবাসন তৈরি করা হয়েছে। শতাধিক পরিবার নানামূখী দুর্যোগের শিকার হয়ে এখানে এসে ঘর বাঁধলেও তাদের জীবন ঝুঁকির মুখেই থাকছে প্রতিনিয়ত। আবাসনের বাসিন্দারা দেখালেন, তাদের ঘরের আঙ্গিনা, টয়লেট, ঘরের ভিটির আশপাশ পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে।

আবাসনগুলো পেরিয়ে আরও খনিক দূরে একটি এক পাইপ বিশিষ্ট স্লুইসগেট। এর দু’পাশে যে বাঁধ ছিল তা বোঝার কোন উপায় নেই। চারপাশে কাদামাটির মাঝে  স্লুইসগেটটি অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে আছে, যেন তার কোন কাজ নেই। স্লুইজের কপাট খুলতে কিংবা বন্ধ করতে হয় না, কারণ তার আগেই পানি উপচে বিধ্বস্ত বাঁধের ভেতরে চলে যায়। এই স্লুইজগেটের কাছের ঘর বেঁধে থাকেন মৎস্যজীবী রুহুল খাঁ। সাগরপাড় বাজার থেকে বাড়ি যাওয়ার সময় রুহুল খাঁ’র স্ত্রী পিয়ারা বেগমের সঙ্গে দেখা। পটুয়াখালীর আরেকটি দ্বীপ চরকাজলে থাকতেন তারা। নিরূপায় হয়ে এখানে এসেছেন প্রায় ১৬ বছর আগে। পিয়ারা জানালেন, জোয়ার এলে সব তলিয়ে যায়। সিগন্যাল পড়লে ঘরের ভিটির ওপরে হাঁটুর ওপরে পানি উঠে যায়। স্বামী রুহুল খাঁ নিজের ছোট্ট নৌকায় মাছ ধরে যা রোজগার করে তা দিয়েই চলে সংসার। নদী-সমুদ্রের মোহনায় মাছ ধরে সংসারটা কোনভাবে চালিয়ে নিলেও মাথা গোঁজার সমস্যাটাই এই পরিবারের কাছে সবচেয়ে বড় সমস্যা।

আলাপ হলো আন্ডারচর ৯নং ওয়ার্ড ইউপি সদস্য মনিরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, এলাকার মানুষের কল্যাণের কথা বিবেচনা করেই ২০১১ সালে নতুন বেড়িবাঁধ হয়েছিল। এখানকার মানুষেরা আশায় বুক বেঁধেছিল, তারা ভালোভাবে বসবাস করবে, জমিতে চাষাবাদ করবে, যাতায়াতে- রোজগারে সুযোগ বাড়বে। কিন্তু প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে সে সুযোগ আর আসেনি। বাঁধের একাংশ ধ্বসে যাওয়ায় আগের সমস্যা রয়েই গেছে। এ বিষয়ে ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে জানানো হয়েছে।

ভর দুপুরেও সাগরপাড় বাজারে মানুষের আলাপ শুনছিলেন ৮৫ বছর বয়সী হাতেম আলী ঢালী। এই এলাকার বহু ঘটনার সাক্ষী তিনি। আলাপে তিনি জানালেন, সত্তরের ঘূর্ণিঝড়ে নিজের জীবন বিপন্ন হয়েছে। ভাইবোনসহ পরিবারের চারজনকে হারিয়েছেন। ওই ঘূর্ণিঝড়ের আগে এই চরে মাত্র ৬০-৭০টি পরিবার ছিল। সবগুলো ঘর বিধ্বস্থ হয়। মাত্র ৭০জন মানুষ বেঁচেছিলেন; বাকিরা মারা যায় কিংবা নিখোঁজ হয়। হাতেম আলী ঢালীর দাবি, মানুষকে বাঁচাতে হলে, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে এখানে শক্ত বেড়িবাঁধ দিতে হবে।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৬ আগস্ট ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়