‘আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিতে ইতিহাস কলঙ্কমুক্ত হবে’
আবু বকর ইয়ামিন : একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বর হত্যাযজ্ঞ গণহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে । সরকার দিনটিকে জাতীয় গণহত্যা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে। তাই এবার ২৫ মার্চ নানা উদ্যোগে দেশব্যাপী দিবসটি পালিত হয়। তবে দিবসটির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনও প্রয়োজন মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, গণহত্যা দিবস আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেলে ইতিহাস কলঙ্কমুক্ত হবে।
বিষয়টি নিয়ে শিক্ষাবিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, ইতিহাসবিদদের সঙ্গে কথা হয় জনপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল রাইজিংবিডি ডটকমের। স্বাধীনতার অনেক পরে হলেও দিবসটি স্বীকৃতিতে তারা সরকারের সিদ্ধান্তে স্বাগত জানান। পাশাপাশি তারা ২৫ মার্চের গণহত্যা দিবসটির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিরও প্রয়োজন উল্লেখ করে বলেন, জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে দিবসটি স্মরণ করা জরুরি। তবে এটি খুব সহজে অর্জন করা সম্ভব নয়। এর জন্য পররাষ্ট্র পর্যায়ে কুটনৈতিক ও বুদ্ধিভিত্তিক তপরতা চালাতে হবে। ইন্টারনেট, পিডিএফসহ বিভিন্ন জায়াগয় এ সম্পর্কে প্রচুর লেখালেখি করতে হবে। ব্লগ তৈরি করতে হবে। বিভিন্ন ভাষায় এ সম্পর্কে গবেষণা, নিবন্ধ প্রকাশ করতে হবে।
শিক্ষাবিদ, কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, আমি মনে করি এর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অত্যন্ত জরুরি। এটা পৃথিবীর চোখের সামনে ঘটেছে। এটাতে লুকানো, চাপানোর কিছু নেই। যেখানে রাস্তায় মানুষকে গুলি করে মেরেছে, যেখানে মানুষ পেয়েছে সেখানে মেরেছে। ছাত্রদের হলে ঢুকে মেরেছে। নির্বিচারে মানুষ মারার যে চর্চা তারা করেছে। এটি গণহত্যার বিভৎস একটা রূপ এবং এ কারণে এটি বিশ্বে স্বীকৃতি পাওয়া উচিত।
তিনি বলেন, যদি এটি বিশ্বে স্বীকৃতি পায় তাহলে বিশ্বব্যাপী গণহত্যার বিষয়টি দ্বিতীয়বারের মতো ভাববে। অনেকে এ বিষয়ে চর্চা করবে। এর মধ্যেই বিশ্বে অনেক গণহত্যা চলছে। মিয়ানমার তার প্রত্যক্ষ উদাহরণ। এ স্বীকৃতি পেলে বিশ্বে অনেক সিদ্ধান্ত আসবে। জাতিসংঘ অধিভুক্ত রাষ্ট্রগুলো এ নিয়মের মধ্যে দায়বদ্ধ থাকবে। তাদের ওপর গণহত্যার মতো হত্যাকান্ডের বিষয়ে চাপ প্রয়োগ করা যাবে। যে দেশে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে তাদের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। এতে আহামরি যে লাভ হবে তা নয়। কিন্তু ইতিহাস কিছুটা কলঙ্কমুক্ত হবে।
শুধু দিবস পালন নয়। এ থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। নিজেদের ভেতর সেটির চর্চা করতে হবে। বিশেষ করে দেশে যেসব সংখ্যালঘু আছে বা অন্য ধর্মাবলম্বী আছে তাদের প্রতি সদ্ভাব বজায় রাখতে হবে। তাদের ওপর যেন নির্যাতন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তাদের প্রতি সবসময় সম্মান বজায় রাখতে হবে। বৈষম্য তৈরি করা যাবে না।
এ দিবসটি আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে স্বীকৃতি পেলে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের আন্তর্জাতিক একটি স্বীকৃতি আসবে। আমাদের দেশে যে গণহত্যা হয়েছিল, নির্বিচারে মানুষ মারা হয়েছিল সেটি গোটা বিশ্ব খুব ভালভাবে জানবে। তারা শহীদদের সম্পর্কে জানতে চাইবে। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেলে শোকের সাথে এটি আমাদের গর্বও হতে পারে।
শিক্ষাবিদ এমিরেটাস সিরাজুল ইসলাম বলেন, অবশ্যই এটির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়া উচিত। বিশ্বে অনেক কম দেশ আছে যেখানে এভাবে গণহত্যা চলেছে। নিরীহ মানুষের উপর নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়েছে অন্য দেশ। এর স্বীকৃতির জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের মাধ্যমে কুটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাতে হবে। আগে থেকে কাজ করা উচিত ছিল। এর জন্য ঐক্যবদ্ধ কাজ করা উচিত। এটাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করা উচিত হবে না। যাতে নতুন প্রজন্ম প্রভাবিত না হয়।
ভাষা সৈনিক ড. রফিকুল ইসলাম বলেন, জাতিসংঘে ইতোমধ্যে একটি দিবসকে (৯ ডিসেম্বর) গণহত্যা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। তাই এটি আরো আগে জাতীয় সংসদের পাশ হলে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিটা পাওয়া সহজ হতো। তবে এখনো পররাষ্ট্র পর্যায়ে প্রচেষ্টা চালালে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করা যেতে পারে। তবে এটি অনেক কঠিন হবে। এর জন্য সরকারি উদ্যোগে কুটনৈতিক আলোচনা চলতে পারে।
এটি সত্য যে, জাতীয়ভাবে হলেও এ দিবসটির স্বীকৃতি মিলেছে বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের বিজয় দিবসের আগে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস, অন্যদিকে স্বাধীনতা দিবসের আগে গণহত্যা দিবস। এসব দিবসের মাধ্যমে কত ত্যাগ তিতিক্ষার বিনিময়ে স্বাধীনতা ও বিজয় অর্জিত হয়েছে সেটি প্রকাশ পায়।
তরুণদের এ ইতিহাস জানানো উচিত। তাই ইন্টারনেট, পিডিএফসহ বিভিন্ন মাধ্যমে এটি সম্পর্কে লেখালেখি করা উচিত। পাঠ্যপুস্তকে এটি যুক্ত করা উচিত। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এ বিষয়ে গবেষণা বাড়ানো উচিত। একাধিক ভাষায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রচার করা উচিত। বিশ্বের বিভিন্ন হত্যাকান্ডের জাদুঘর আছে। আমাদের দেশের গণহত্যার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে একটি যাদুঘর করা উচিত। এটি মুক্তিযোদ্ধা যাদুঘরের সাথেও হতে পারে আবার আলাদা হতেও পারে। এর মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম পড়ার পাশাপাশি জাদুঘরে এটি দেখে আরো ভালভাবে জানতে পারবে।
অধ্যাপক ড. আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, এটি আরো আগেই স্বীকৃতি প্রয়োজন ছিল। জাতীয় পর্যায়ে স্বীকৃতি বড় কথা নয়। বড় কথা হচ্ছে গণহত্যা থেকে আমরা কি শিক্ষা নিলাম। সেদিকটা দেখতে হবে। গণহত্যার মতো হত্যাকান্ড যাতে বিশ্বব্যাপী পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে বিষয়ে কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। পররাষ্ট্র পর্যায়ে এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ যে গণহত্যা শুরু হয়েছে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত সে গণহত্যা নানাভাবে অব্যাহত ছিল। এ ধরনের গণহত্যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। সে কারণে জাতিসংঘের উদ্যোগে পৃথিবীব্যাপী যুদ্ধ, গণহত্যাগুলো ব্ন্ধ করতে হবে, গণহত্যা প্রতিরোধের জন্য ২৫ মার্চ দিবসটিকে নির্বাচিত করে সারা বিশ্বে দিবসটিকে গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করা যেতে পারে।
বিশিষ্ট এ শিক্ষাবীদ বলেন, জাতীয়ভাবে স্বীকৃতির আগেও আমরা সবসময় ২৫ মার্চের কালোরাত্রির ঘটনাকে প্রতিবছরিই স্বরণ করি এবং ভবিষ্যতে যাতে এ জাতীয় ঘটনা না ঘটে সেজন্য সবরকম দায়িত্ব পালন করে চলেছি। এর সাথে আন্তঃরাষ্ট্রীয় কার্যক্রম যুক্ত হওয়া প্রয়োজন। তাই জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে দিবসটি পালন করা জরুরি। এক্ষেত্রে আমাদের কূটনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনার দরকার আছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমেদ বলেন, এমন একটি মর্মান্তিক হত্যাকান্ড অবশ্যই স্মরণ রাখা দরকার। সে রাত্রিতে যে ভয়ঙ্কর হত্যাকান্ড ঘটেছে সেটি অবর্ণনীয়। এতদিন পর জাতীয় সংসদের শুভবুদ্ধি হয়েছে যে তারা দিবসটিকে জাতীয়ভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। স্বীকৃতিতো বহু আগে থেকেই বিভিন্নভাবে জানিয়ে আসছে। অনেক দেরিতে স্বীকৃতি জানানোর পরও আমি তাদের অভিনন্দন জানাচ্ছি।
এখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃতি পেতে বিভিন্ন উদ্যোগ প্রয়োজন। যেকোনো জায়গা থেকে এমন একটি প্রস্তাব ইউনেস্কোর প্রধান কার্যালয়ে পৌঁছানো যেতে পারে। এর জন্য একটি কমিটি গঠন করা যেতে পারে। এর একটি বিশেষ সুবিধা হলো কমিটি গঠনের মাধ্যমে কোনো প্রস্তাব দিলে ইউনেস্কো সেটি গ্রহণ করে। এক্ষেত্রে এক জাতির ব্যপার তুলে না ধরে আরো কয়েক জাতির নাগরিক এরসঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকলে সহজ হয়। যেমন ২১ ফেব্রুয়ারির স্বীকৃতির জন্য ভারত, চীন, জার্মানি, জাপানসহ আর্ন্তাজিতক ৯টি জাতির তরুণ প্রতিনিধি নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। গণমাধ্যম এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করতে পারে। ২৫ মার্চের জন্য ৯টি কেন ২০-২৫টি জাতিও পাওয়া যেতে পারে।
ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, জাতীয় সংসদের এমন একটি উদ্যোগ সত্যিই খুশির খবর। ২৫ মার্চের যে গণহত্যা হয়েছে পৃথিবীর ইতিহাসে এমন ঘটনা খুব আছে বলে আমার জানা নেই। কাজেই অবশ্যই আমরা জাতিগতভাবে যদি সেটি পালন না করি সেটি খুবই দুঃখজনক হবে। সংসদের এমন উদ্যোগকে স্বাগত। ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। আমার ধারণা সরকার সচেষ্ট হলে ২৫ মার্চও আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেতে পারে। আমি মনে সেটার জন্য আরো ভালোভাবে চেষ্টা করতে হবে। ভবিষ্যত প্রজন্ম বিষয়টি সম্পর্কে অনেক ভালভাবে জানতে পারবে।
ব্যারিষ্টার আমিরুল ইসলাম বলেন, ২৫ মার্চের যে হত্যাকান্ড সেটি পৃথিবীর জঘন্যতম হত্যাকান্ড। এটিকে জার্মানির হিটলারের হলোকাস্টের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। তুলনামূলকভাবে এটি তার চেয়েও মর্মান্তিক হত্যাকান্ড ছিল। নারী শিশু নির্বিশেষে সব ধরনের মানুষের ওপর যে অত্যাচার তারা করেছিল আন্তর্জাতিক আইনে এটি অনেক বড় অপরাধ। এটি গণহত্যা দিবস হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিকভাবে যে প্রক্রিয়ায় স্বীকৃতি পেয়েছে সেভাবে ২৫শে মার্চ গণহত্যা দিবসও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেতে পারে।
ইতিহাসবীদ অধ্যাপক ড. মুনতাসীর উদ্দিন খান মামুন বলেন, এটি জাতীয় পর্যায়ে প্রভাব ফেলবে। উপজেলা পর্যায়ে যখন দিবসটি পালিত হবে, গণহত্যার কথা যখন বার বার স্মরণে আসবে তখন একটি প্রভাব ফেলবে। আবার অন্যদিকে সরকার যদি চেষ্টা করে আমরা জাতীয়ভাবে পালন করছি আমরা এটার স্বীকৃতি চাই যে এটা গণহত্যা ছিল তাহলে একটা প্রভাব পড়বে। পাকিস্তান যেসব কাজ করছে এগুলো প্রতিহত করা যাবে। তবে ২৫ মার্চকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেওয়াটা সম্ভব হবে না। বিভিন্ন দেশের সংসদে দিবসটির কথা স্মরণে জাতিসংঘে উদ্যোগ নিতে পারে। জাতিসংঘ গণহত্যার তালিকায় দিবসটি নিয়ে আসতে পারে। এ বিষয়ে আলোচনা হতে পারে।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৬ মার্চ ২০১৭/ইয়ামিন/এনএ
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন