ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

আমার জীবনে স্যার কী ছিলেন বোঝাতে পারব না : বিউটি

আমিনুল ইসলাম শান্ত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৫১, ২২ জানুয়ারি ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আমার জীবনে স্যার কী ছিলেন বোঝাতে পারব না : বিউটি

আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল, নাসরিন আক্তার বিউটি

নাসরিন আক্তার বিউটি : আজ সকালে অনেকটা ফুরফুরে মেজাজেই ঘুম ভাঙে। মন-মানসিকতাও অনেক সতেজ ছিল। ঘুম থেকে ওঠার কিছুক্ষণ পর কয়েকজন আমাকে মুঠোফোনে এসএমএস পাঠায়। তাতে লেখা ছিল-আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল স্যার আর নেই। দাঁড়িয়ে এ লেখাটুকু পড়ছিলাম। তারপর অনেকটা স্ট্যাচুর মতো হয়ে যাই। কিছুদিন আগে আমাদের এবি (আইয়ুব বাচ্চু) যখন মারা গেলেন তার মৃত্যু সংবাদ শোনার পর আমার প্রেসার ফল করেছিল। তারপর আমাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল। আজকেও বুলবুল স্যারের চলে যাওয়ার খবর শোনার পর হাতে পায়ে শক্তি পাচ্ছিলাম না। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। অনেকক্ষণ বসে থেকে কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করি। দিনটি দুর্বিষহ হয়ে গেছে, অসুস্থ হয়ে পড়েছি। এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে আমার স্বামীকে বাসায় চলে আসতে বলি।

ক্লোজ আপ ওয়ান প্রতিযোগিতায় কার প্রতি বুলবুল স্যারের কী অবদান ছিল সেটা আমি জানি না। কিন্তু আমার জন্য স্যারের যে অবদান সেটা আমি কখনো ব্যাখ্যা করে শেষ করতে পারব না। প্রথমত: আল্লাহ চাইছিলেন বলে এই প্রতিযোগিতায় আমি এ পর্যায়ে ছিলাম। দ্বিতীয়: স্যারের মন্তব্য, ভালোবাসার জন্য আপামর জনতা আমাকে এক নামে চিনেছিলেন। আমার জীবনে বুলবুল স্যার কী ছিলেন, সেটা আমি বোঝাতে পারব না। সংগীতাঙ্গনে ১২ বছরের যে জার্নি সেটা পেয়েছি বুলবুল স্যারের জন্য। ক্লোজ আপের মঞ্চে তিনি আমাকে ‘মা’ বলে ডেকেছিলেন। ‘লালন কন্যা’ উপাধিও তিনিই আমাকে দিয়েছিলেন। মঞ্চে উঠলে এখনো আপামর জনসাধারণ ‘লালন কন্যা’ বলেই সম্বোধন করেন। আমার প্রতিটা মঞ্চে বুলবুল স্যার বিরাজমান থাকেন।

বুলবুল স্যার একাধারে একজন সংগীতজ্ঞ, বীর মুক্তিযোদ্ধা। দেশের জন্য অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন। দেশাত্মবোধকে জাগিয়ে তুলতে রচনা করেছেন দেশাত্মবোধক গান। যা আজও মানুষের মুখে মুখে। মানুষ কী মনে করবে তা জানি না কিন্তু নিজের কষ্ট থেকে একটা কথা বলছি-বুলবুল স্যারের চলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে, একটি বন্দি জীবনের অবসান হলো। যে কোনো কারণেই হোক, স্যার শেষ জীবনে অনেকটা বন্দি জীবনের মতোই সময় কাটিয়েছেন। একজন সুস্থ মানুষ বন্দি জীবন কাটালে অসুস্থ হয়ে যায়। আর সেখানে একজন সৃষ্টিশীল, স্বাধীন মানুষ এভাবে জীবন কাটালে তার মনের অবস্থা কী হতে পারে! আমার মনে হয়, যা হলো ভালোই হলো। একটা বন্দি জীবনের অবসান হলো, তিনি মুক্তি পেলেন। এক প্রকার শান্তির দেশে চলে গেলেন। একজন শিল্পী বন্দি জীবন ডিজার্ভ করে না।

স্যারের সঙ্গে এত সময় কাটিয়েছি যে বলে শেষ করতে পারব না। ক্লোজ আপ ওয়ান প্রতিযোগিতায় জাজমেন্ট করতে করতে ব্যাক স্টেজে এসে স্যার একবার আমাকে বললেন, ‘আমি গাড়ি নিয়ে লং ড্রাইভে বের হই। বহু দূর চলে যাই। যেতে যেতে রাস্তার পাশের জমিতে সবুজ আর সবুজ দেখি। কখনো কখনো দেখি মাচায়-লাউ ঝুলছে। চারপাশ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা। কৃষকরা জমিতে কাজ করছে। এরকম জায়গায় গিয়ে কোনো একটি গাছের ছায়ায় বসে পড়ি। সেখান থেকে দুই লাইন লিখে আবার চলে আসি। এভাবে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন অবস্থানের প্রেক্ষাপটে আমি গান লিখি। কিন্তু বাসায় বসে বসে গান লিখতে পারি নারে মা। আমি বাসা থেকে বের হই, মানুষের জীবন যাত্রা দেখি তার উপর গান রচনা করি।’

আরেকটা বিষয় খেয়াল করে দেখবেন, স্যার কখনো মনের ভাব কোথাও লিখে বা বলে প্রকাশ করতেন না। সর্বশেষ তিনি ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছেন, ‘আমাকে যেন ভুলে না যাও... তাই একটা ছবি পোস্ট করে মুখটা মনে করিয়ে দিলাম’। এসবই যেন দীর্ঘশ্বাসের বহিঃপ্রকাশ। এমন একজন বরেণ্য সংগীত ব্যক্তিত্ব চলে যাওয়া আমাদের ইন্ডাস্ট্রির জন্য কথাটা ক্ষতির তা পরিমাপ করা যাবে না। আমার জীবনে স্যারের যে অবদান তা সারাজীবন মনে রাখব। আল্লাহর কাছে সবসময় দোয়া করব আল্লাহ যেন স্যারকে বেহেশত নসীব করেন।              

আমরা ব্যস্ততার কারণে স্যারের সঙ্গে কখনো যোগাযোগ না করতে পারলেও তিনি ঠিকই ম্যাসেঞ্জারে লিখতেন, ‘মা শুভ সকাল’ কিংবা ‘কী রে কেমন আছিস?’ ক্লোজ আপ ওয়ানের মাধ্যমে আমার মতো যেসব শিল্পীকে তুলে আনা হয়েছে তাদের সবার সঙ্গে স্যারের অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল। বাবা-মা জন্ম দিলেই সন্তান হয় শুধু তা না। এই রিয়েলিটি শোয়ের আমরা সবাই স্যারের সন্তান। ক্লোজ আপ ওয়ানের চতুর্থ রাউন্ডে স্যার আমাকে বলেছিলেন, ‘আমি যখন মরে যাব। কবরে শুয়ে থাকব তখন তুই গান গাইবি। তোর গাওয়া গান শুনে আমি জেগে উঠব।’ আমি যত দিন বেঁচে থাকব গান গাইব। নিশ্চয়ই স্যার আমার গান শুনবেন।

অনুলিখন : আমিনুল ইসলাম শান্ত




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২২ জানুয়ারি ২০১৯/শান্ত/মারুফ  

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়