ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

আরাম করে বসতেই উড়াল দিলো টিয়া পাখি

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:০৮, ১২ জুলাই ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আরাম করে বসতেই উড়াল দিলো টিয়া পাখি

(ভিয়েতনামের পথে: ৩৫তম পর্ব)

ফেরদৌস জামান: সারা রাত আরামদায়ক বাস যাত্রার পর ব্যাংককে এসে যানজটে আটকে থাকতে হলো, যা ছিল একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত। দশ কি এগারো দিন পর ফিরে এলাম মো চিৎ-এর চাতুচক বাস টার্মিনালে। মাত্র কয়টি দিন। প্রতিটি দিন এতটাই ঘটনাবহুল কেটেছে যে, কেবলই মনে হচ্ছে বহু দিন পর ফিরে এলাম। হাতে সময় মাত্র আজকের দিনটি। আগামীকাল বেলা এগারোটা পঞ্চাশ-এ মালয়েশিয়ার ফ্লাইট। ভ্রমণ পরিকল্পনা যেভাবে সাজানো আছে তা যদি বাস্তবায়ন করা যায় তাহলে গত কয়েক দিনের স্বার্থকতার সাথে আজ যুক্ত হতে চলেছে নতুন আরেক অভিজ্ঞতা।

চাতুচক টার্মিনালে লোক সমাগম এখনও ঠিক চোখে পরার মতো নয়। সকাল সকাল ভেতরে ঢুকে প্রথমে ব্যাগ জমা রাখার খোঁজখবর করতে হলো। এত বড় ব্যাগ সাথে নিয়ে আয়ুথায়া যাওয়া, পিঠে নিয়ে ঘোরাফেরা করা এবং আবারও এখানে ফিরে আসা- অনেক কষ্টের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। অতএব, জমা রেখে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে। টার্মিনালের ভেতরেই জমা রাখার ব্যবস্থা ডিপজিটরি আছে। প্রতি ব্যাগের জন্য দিতে হবে পঞ্চাশ বাথ। তার আগে দাঁত মাজা থেকে শুরু করে সকালের প্রয়োজনীয় সমস্ত কাজ বাস টার্মিনালের ভেতরেই সারলাম। এমন পরিস্থিতিতে ভেতরের বন্দোবস্ত হিসেবে যা আছে তা নিঃসন্দেহে সাধুবাদ পাবার যোগ্য। এমনকি নাস্তার জন্যও বাইরে বেরুনোর দরকার পরল না। ভেতরেই একাধিক চেইন দোকানের শাখা, যেখান থেকে অনায়াসে খাদ্যি-খাওয়ার যোগাড় করা গেল।
 


এ পর্যায়ের সমস্ত কাজ শেষে ছুটলাম টিকিট কাউন্টারের দিকে। এখান থেকে এক ঘণ্টা পরপর আয়ুথায়ার মাইক্রোবাস সেবা আছে। ব্যাংকক থেকে দূরত্ব আশি কিলোমিটার উত্তরে। ভাড়া ৭০ বাথ। বাস কর্তৃক্ষের একজন পাশেই দাঁড়ানো। টিকিট কাটার পর যাত্রীদের এক জায়গায় বসতে বলছেন, সময় হলেই গাড়িতে পৌঁছে দেবেন। লোকটির অবস্থান খুব সতর্ক, একজন যাত্রীকেও চোখের আড়াল হতে দিচ্ছেন না। কিছুক্ষণ পরপর ওয়াকিটকিতে কারও সাথে কথা বলছেন। সময় হল বাস ছেড়ে দেয়ার। তিনি সকলকে সাথে নিয়ে পৌঁছে দিলেন বাসের নিকটে। নয় জন যাত্রীর সকলেই বিদেশি পর্যটক। গাড়ি ছেড়ে দেয়ার পর এলো বৃষ্টি। প্রায় সমস্ত পথেই বৃষ্টি, কোথাও ঝমঝম তো কোথাও টিপটিপ। যে কোন ধরণের যাত্রায় আমার তো সকলের সামনের আসন চাই। এ ক্ষেত্রে আমি স্বার্থপর তা মানতে দ্বিধা নেই। এ যাত্রায় সামনের আসনে আগেভাগেই জায়গা করে নিয়েছে অন্য একজন। নিরুপায় হয়ে সর্ব শেষ সারিতে ঠিক জানালার পাশের আসনটায় বসতে হলো। ইচ্ছা হলো জানালার কাঁচ সরিয়ে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি স্পর্শ করি। অথবা অর্ধেক শরীর বের করে দিয়ে জানালার উপর বসে পরি।  বৃষ্টিস্নাত যাত্রার পর নামিয়ে দেয়া হলো নতুন এক শহরে। মাইক্রোবাস থেকে নামতেই কয়েকটা টুকটুক এসে ঘিরে ধরল। অমনি গুড়ুম গুড়ুম শব্দে আকাশ কেঁপে উঠে শুরু হলো বৃষ্টি।

আমাদের গাড়িতে আসা দুই ইয়োরোপিয়ান পর্যটকের সাথে কথা একরূপ হয়ে ছিল- একসাথে ঘুরবো। তাতে আনন্দের মাত্রা যেমন বাড়বে তেমনি খরচাটাও পুশিয়ে যাবে। বৃষ্টির কারণে ভেস্তে গেল। কে কোথায় দৌড় দিলো তার ঠিকঠিকানা নেই। তারপরও আশপাশটায় খেয়াল করছি কোথায় গিয়ে আশ্রয় নিল। পাঁচ মিনিট পর দেখি নিজেদের মতো একটা টুকটুক নিয়ে মুখের সামনে দিয়ে চলে গেল। কারও জন্য এখন আর অপেক্ষায় থাকার দরকার নেই। নিজেদের মতো দরদাম করে টুকটুক ভাড়া করতে হবে। কথা হচ্ছে একজন ভ্রাম্যমাণ ট্যুর অপারেটরের সাথে। লেমিনেটেড ছবি দেখিয়ে তার ভ্রমণ প্যাকেজের বর্ণনা করলেন। প্যাকেজের ধরণ দুই থেকে তিন প্রকারের মধ্যে সীমাবদ্ধ। আমাদের লক্ষ্য প্রধানত তিনটি জায়গা ঘুরে দেখা। দাম যা হাঁকলেন তাতে বেপর্তা। কথাবার্তা শেষ হওয়ার অপেক্ষায় পাশেই চুপচাপ অথচ আগ্রহ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এক বৃদ্ধ। তার টুকটুক একটু পেছনের দিকে রাখা। কয়েক কথায় রাজি হলেন তিনশ বাথে বেড়িয়ে আনবেন।
 


টুকটুকের গায়ে টিয়া পাখির রং। ভেতরে উঠে আরাম করে বসতেই উড়াল দিলো আমাদের টিয়া পাখি। পাখির পাখা নেই, তিন চাকায় গড়িয়ে গড়িয়ে আমাদের নিয়ে যাচ্ছে আয়ুথায়া হিস্টোরিক্যাল পার্কে।

আয়ুথায়ার অবস্থান তিন নদীবেষ্টিত এক দ্বীপে। সমৃদ্ধ এই নগরী নদী দ্বারা সংযুক্ত ছিল সমুদ্রের সাথে। এক সময় স্থানীয় সিয়ামের রাজধানী আয়ুথায়া ছিল গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক এলাকা, ইয়োরোপের বণিক ও এশিয়ার ব্যবসায়ীদের মিলন কেন্দ্র। ১৩৫০ কি ৫১ খৃষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় রাজা উ থং-এর উদ্যোগে। পরবর্তী সময়ে বার্মিজ বাহিনীর আক্রমণের আগ পর্যন্ত অর্থাৎ ১৭৬৭ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত টিকে ছিল স্ব-মহিমায়। এখানে রাজত্ব করছে পাঁচটি রাজ বংশের তেত্রিশ জন রাজা। বার্মিজ বাহিনী আক্রমণ করে আয়ুথায়াকে ধ্বংস করে দেয় এবং অধিবাসীদের উচ্ছেদ করে। বহু মন্দির, মঠ ও মূর্তি সমৃদ্ধ আয়ুথায়া দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন হিসেবে বিশ্বে আজও পরিচিত। ১৯৯১ খৃষ্টাব্দে ইউনেস্কো হেরিটেজ সাইট হিসেবে স্বীকৃতি প্রাপ্ত হয়।

নদীর পানি প্রায় উছলে যাওয়ার উপক্রম। পাশ দিয়ে রাস্তা, সরু বাঁধের বদৌলতে পানির প্রবাহ রাস্তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বয়ে যাচ্ছে আপন গতিপথের দিকে। টিপটিপ বৃষ্টি এখনও চলমান। বৃষ্টির ফোঁটার পাতলা পড়ত গলে উপস্থিত হলাম ওয়াট চাইওয়ামানারামের সদর দরজায়। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে চাও প্রায়া নদী। নদীর পশ্চিম তীরে এর অবস্থান। এটা ছিল রাজ মন্দির। ১৬৩০ খৃষ্টাব্দে রাজা প্রাসার্ত থং তার মৃত মায়ের স্মৃতিস্বরূপ বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের ধ্যানের জন্য মন্দিরটি নির্মাণ করেন। সামনে ছোট্ট একটি কাঠের পুল। পুল পেরিয়ে গাঢ় সবুজ ঘাসের চত্বর। পোড়া ইটের চওড়া ভিত্তি মূল দ্বারা সমস্ত মন্দির এলাকা ঘেরা। ঠিক তার মাঝখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে মন্দিরের প্রধান মঠ। তাকে ঘিরে আছে আরও কিছু মঠ। পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে নদীর টইটুম্বুর ধারা। কখন না জানি বাঁধ ভেঙ্গে ঢুকে পরে মন্দির এলাকায়। স্থাপনার কোন অংশেই পলেস্তারা নেই। খসে পরেছে অনেক আগে। অথবা কখনও কোন পলেস্তারাই ছিল না। মেঘলা আকাশের নিচে সবুজ ঘাসে লেগেছে আমাদের টুকটুকের মত টিয়া রং। ঠিক তার বুক ফুড়ে বেরিয়ে আসা মঠগুলির প্রতিটি গাঁথুনি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আরও দেখা যাচ্ছে গাঁথুনি ফাকের চুন-সুরকির রেখাগুলি। কেন্দ্রীয় মঠের গোড়া থেকে উপরে উঠে যাওয়া দীর্ঘ এক সিঁড়ি, তবে সেখানে আরোহণ করা নিষেধ। চারপাশের অন্যান্য মন্দিরগুলি ইট বিছানো পথ দ্বারা সংযুক্ত। এই পথ এগিয়ে গেছে প্রতিটি মঠের ভেতর দিয়ে। সমস্ত পথের পাশে স্থাপিত পাথর কেটে গড়া বহু বুদ্ধ মূর্তি। মূর্তিগুলি কিসের স্বাক্ষী দিচ্ছে, কোন বর্বরতার কথা বলছে? দেখে যে কারোরই মনে হবে আক্রমণে ধ্বংসপ্রাপ্ত। একটি মাত্র মূর্তি ছাড়া সবগুলো দাঁড়িয়ে আছে একেকটি ভাঙ্গা পাথর টুকরো হয়ে। একটিরও মাথা নেই। কোন কোন মূর্তি এমনভাবে ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে যে, শুধু মূলটুকুই উৎপাটন করতে পারেনি। অর্থাৎ, উরুর অর্ধেক এবং কোমর থেকে নেমে আসা ঝালোর সদৃশ্য অংশটুকুই টিকে আছে। কে কবে চালিয়েছে এই বর্বরতা তার হদিস করা আমাদের সাধ্যের অতীত।
 


আশপাশে স্থানীয় কেউ নেই যে, তার কাছে জানা যাবে। থাকলেই বা কি? তাতে খুব একটা সুবিধা করা যাবে না। এসব মূর্তি যে কোন ঝড়-তুফানে ভাঙ্গা নয় তা নিশ্চিত করে বলা যায়। কারণ ঝড়-তুফান রসিকতা জানে না যে, সব কিছু ঠিকঠাক রেখে কেবল আস্ত পাথরের মূর্তিগুলো শুধু বিনাশ করে যাবে! আফগানিস্তানের বিশ্ববিখ্যাত ভাস্কর্যগুলোও তালেবান বাহিনী দাঁত কেলিয়ে ধ্বংস করেছিল। সিরিয়ায় আলেপ্পো ধ্বংস করেছে তাদের উত্তরসুরীগণ। ওয়াট চাইওয়ামানারমে এই কান্ড যারাই করুক তার নিঃসন্দেহে এদেরই পূর্বসুরী।

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১২ জুলাই ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়